সূরা বাকারাহ;(১৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(১৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:45:41 3-10-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ৩৪-৩৫
সূরা বাকারাহ'র ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآَدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ

"যখন আমি আদমকে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিলাম,তখনই ইবলিস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।"(২:৩৪)
আগের আয়াতগুলোতে মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক নেয়ামত এবং সুযোগ সুবিধার কথা এক এক করে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- মানুষের বিশেষ মর্যাদার কারণেই তাকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে মানুষের জন্য একটি মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আদমের প্রতি ফেরেশতাদের সিজদার ঘটনা মানুষের বিশেষ মর্যাদার ইঙ্গিত বহন করে। যেমনটি সূরা স্বোয়াদ এবং সূরা হেজরে বলা হয়েছে, "মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির সময় ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বলেছেন-"যখন আমি মানুষকে সুগঠিত করবো, তখন তার মধ্যে স্বীয় প্রাণ সঞ্চার করবো। এরপর তোমরা তার সামনে সেজদাকারীরূপে প্রণত হবে।" কাজেই বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের জন্য ফেরেশতারা মানুষকে সেজদা করেননি, বরং মানব হিসাবে সৃষ্টির কারণেই তাকে সিজদা করেছিলেন। আদমের ওপর ঐশী প্রতিনিধিত্ব অর্পন করার পর যদি মহান আল্লাহ সেজদার নির্দেশ দিতেন তাহলে সেটা ফেরেশতাদের জন্য গৌরবের কারণ হতো না। কারণ তখন তারা আদমের বিশেষ মর্যাদার কারণেই তার সামনে মস্তক অবনত করতেন। আল্লাহর নির্দেশ পালন করাটা তাদের জন্য মূখ্য হয়ে উঠতো না। সূরা কাহাফের ৫০ নম্বর আয়াতের আলোকে বলা যায়, জ্বীন সম্প্রদায়ের ইবলিস একনিষ্ঠ ইবাদতের কারণেই ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিল। কিন্তু অহংকার ও আত্মম্ভরীতার কারণে সে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে। ইবলিস ভেবেছিল সৃষ্টির দিক থেকে সে আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা মর্যাদাবান। কাজেই আদমকে সেজদা করা তার জন্য মোটেই শোভনীয় নয় বরং আদমের উচিত তাকে সেজদা করা। ইবলিস কেবল কাজের ক্ষেত্রেই আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে পাপ করেনি। বরং ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকেও সে আল্লাহর নির্দেশকে ইনসাফহীন ও অবিবেচনা প্রসূত ভেবে কুফরী করেছে এবং ঈমান হাতছাড়া করেছে। ফেরেশতারা উপাসনার উদ্দেশ্যে আদমকে সিজদা করেননি। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা বৈধ নয়। বরং তারা আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য আদমের সম্মানার্থে সিজদা করেছেন। কাজেই ফেরেশতারা মূলত আল্লাহকেই সেজদা করেছেন।
এবারে সূরা বাকারাহ'র ৩৪ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো তুলে ধরা হচ্ছে-
এক. আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য কোন কাজ করাই প্রকৃত ইবাদত।
দুই. সমস্ত ফেরেশতা মানুষকে সিজদা করবে অথচ মানুষ আল্লাহর সামনে সেজদা করবে না, এটা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়।
তিন. স্রষ্টার সামনে অহঙ্কার ও আত্মম্ভরীতা প্রদর্শন করলে ঈমান থাকে না।
চার. আল্লাহর নির্দেশে অন্য কারো সামনে সেজদা করা শিরক তো নয়ই বরং ইবাদতের শামিল।

এরপর ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَقُلْنَا يَا آَدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ
"আমি বললাম হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং সেখান থেকে যা ইচ্ছা তাই খাও। কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইও না, অন্যথায় তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।" (২:৩৫)
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্বের জন্য মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য প্রথমেই তার জন্য সঙ্গিনীও সৃষ্টি করেছেন, যাতে আদমের প্রশান্তির পাশাপাশি পৃথিবীতে মানবজাতির বংশ বিস্তার ঘটে। তিনি তাদের জন্য সুন্দর দু'টি বাগানও তৈরী করেন, যাতে সেখানে তারা বসবাস করতে পারেন এবং নানা রকম খাদ্যেরও সংস্থান হয়। এভাবে মহান প্রতিপালক হযরত আদমের জন্য পৃথিবীতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেন যাতে ধীরে ধীরে তারা এসবের ব্যবহার করতে শেখে। সব খাবার দাবারই মানুষের জন্য উপকারী নয়। তাই মহান আল্লাহ,বিশেষ কিছু খাবার দাবার বর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা এসব ফল-মূল বা খাবার খেলে দেহের ক্ষতির পাশাপাশি, মানুষের আত্মারও ক্ষতির আশঙ্কা ছিল। এমনকি বেহেশত থেকে বহিষ্কারের সম্ভাবনা ছিল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে- হযরত আদম যে বেহেশতে ছিলেন সেটা পরকালের প্রতিশ্রুত বেহেশত নয়। কেননা ওই বেহেশত মূলত: ভলো কাজের প্রতিদান দেবার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাছাড়া হযরত আদম (আ.) তখনও কোন ভালো কাজ করেননি তাই প্রতিদান পাওয়ার অর্থই হয় না। যারা প্রতিশ্রুত বেহেশতে প্রবেশ করবেন তারা সেখান থেকে বহিষ্কৃত হবেন না। যেমনটি সূরা হিজরের ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-"তারা জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হবেন না।" এছাড়া প্রতিশ্রুত বেহেশতে নিষিদ্ধ গাছের কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানকার সবকিছু হালাল এবং বৈধ। পৃথিবীর বিভিন্ন সবুজ শ্যামল বাগানের ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহ 'জান্নাত' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কাজেই কেবলমাত্র পরকালের প্রতিশ্রুত বেহেশতের জন্যই 'জান্নাত'শব্দটির ব্যবহার হয় না। সূরা ক্বালামের ১৭ নম্বর আয়াতে রয়েছে-"আমি ওদের পরীক্ষা করবো, যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম উদ্যান অধিপতিদেরকে"।
সূরা বাকারাহ'র ৩৫ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. স্ত্রী, বাসস্থান, ও খাদ্য হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের আরাম-আয়েশ ও প্রশান্তির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত স্বরূপ।
দুই. গৃহে নারী, পুরুষের অধীন। এ আয়াতে সব ক্ষেত্রে হযরত আদম ও হাওয়াকে উদ্দেশ্য করে সব কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু বাসস্থানের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র হযরত আদমকে সম্বোধন করা হয়েছে, আর তার স্ত্রী হাওয়াকে তার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, হে আদম আপনি নিজ সহধর্মিনীর সাথে জান্নাতে বসবাস করুন।
তিন. আল্লাহর নিষিদ্ধ কোন কাজ করলে তার ক্ষতি মূলত: মানুষেরই হয়। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা নিজের ওপর জুলুম করারই শামিল। এর ফলে মানুষকে আল্লাহর নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
চার: খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও মানুষকে পুরোপুরি আল্লাহর অনুগত হতে হবে। আল্লাহ যেসব খাবার মানুষের জন্য উপকারী ও বৈধ করেছেন তাই খাওয়া উচিত। আর যেসব খাবার নিষিদ্ধ করেছেন, সেসব বর্জন করা উচিত।