সূরা আন নিসা;(৯ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা;(৯ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:44:11 3-10-1403

সূরা আন নিসা; আয়াত ৩২-৩৩

সূরা নিসার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 
وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبُوا وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبْنَ وَاسْأَلُوا اللَّهَ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا ((৩২

 
"যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে,তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে,তা তার প্রাপ্য অংশ। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে অবহিত।" (৪:৩২)

সৃষ্টি জগত পার্থক্য ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। মহান আল্লাহ সৃষ্টি জগত পরিচালনার জন্য মানুষ, উদ্ভিদ, নানা জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ ও সরীসৃপসহ বহু জীবন্ত সত্ত্বা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ মানুষের মধ্যেও একদলকে নারী ও অন্য একদলকে পুরুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন ভিন্ন ধরনের। সৃষ্টিজগত এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও এর যথাযথ পরিচালনার জন্যেও শতশত কোটি সৃষ্টি বা অস্তিত্বের প্রয়োজন। আর প্রতিটি সৃষ্টিরই রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। তেমনি মানব সমাজেও শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে প্রত্যেক মানুষেরই বিশেষ মেধা ও ক্ষমতা থাকায় সমাজের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়। মানুষের মধ্যে এসব পার্থক্যের অর্থ কিন্তু বৈষম্য নয়। তার কারণ হচ্ছে,
প্রথমত : আল্লাহর কাছে কোন সৃষ্টিরই কোন পূর্ব প্রত্যাশা ছিল না, যে কেউ তার দাবি করতে পারে।
দ্বিতীয়ত : মানুষের মধ্যে এই পার্থক্য কৌশলময়। জুলুম, হিংসা বা কৃপণতার কোন ভূমিকা এতে নেই। তবে, আল্লাহ যদি সব সৃষ্টি বা মানুষের কাছে একই ধরনের কাজের আশা করেন, তাহলে তা হবে অন্যায়। কারণ, সবাই একই ধরনের ক্ষমতা, শক্তি ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী নয়। কোরআন ও হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে তাদের সামর্থ অনুযায়ী কাজ আশা করেন। যেমন, সূরা তালাক্কের সপ্তম আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ কারো কাছ থেকেই তার জন্য অর্পিত দায়িত্বের বেশী কিছু চান না। অবশ্য মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে একটা বড় পাথর্ক্য হলো, একমাত্র মানুষই চিন্তাভাবনার ক্ষমতা রাখে এবং সৎ পথ বা অধঃপতনের পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন। তাই স্বাভাবিকভাবেই অর্জন যোগ্য বিষয়ে মানুষের উন্নতি নির্ভর করে তাদের প্রচেষ্টার ওপর। এ ক্ষেত্রে অলসতা ও নিস্ক্রিয়তার জন্য আল্লাহ দায়ী নন। তাই এ আয়াতে মানুষের ক্ষমতার বাইরে থাকা আল্লাহর নেয়ামতগুলোর কথা ও মানুষের পক্ষে অর্জনের যোগ্য বিভিন্ন নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ কোন কোন মানুষকে এমন বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্য অনেককেই দেননি,ফলে তা নিয়ে তোমরা একে অপরকে হিংসা করো না। এ ক্ষেত্রে অসম্ভব কিছু কামনা করা উচিত নয়। আর অর্জন যোগ্য বিষয়ে নারী ও পুরুষেরা তাদের প্রচেষ্টার ফলই পেয়ে থাকে। তোমরাও চেষ্টা ও পরিশ্রম কর এবং তা যেন সফল হয় সে জন্যে আল্লাহর দয়া প্রার্থনা কর।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : অন্যদের প্রতিভা ও নেয়ামতের দিকে নজর না দিয়ে আমাদের নিজেদের যোগ্যতা, প্রতিভা এবং সুযোগ-সুবিধের দিকে লক্ষ্য করা উচিত। অন্যের নেয়ামতের ব্যাপারে হিংসা না করে নিজের নেয়ামত ও প্রতিভাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত : অসম্ভব আকাঙ্ক্ষা বা দূরাশার মূলোৎপাটন করতে হবে। কারণ, দূরাশাই নৈতিক অধঃপতনের অন্যতম মূল কারণ।
তৃতীয়ত : মানুষের নিজের চেষ্টা ও অধ্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের আায় উপার্জনে আল্লাহর কোন ভূমিকা নেই এমন ধারণা করা উচিত নয়। আমরা চেষ্টাও করবো এবং আল্লাহর কাছেও সাহায্য চাইবো।
চতুর্থত : পুরুষের মত মহিলারাও মালিকানার অধিকারী হতে পারেন। মোহরানা বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ছাড়াও মহিলারা চাকরী ও ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদের মালিক হতে পারেন।

সূরা নিসার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,


وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَالَّذِينَ عَقَدَتْ أَيْمَانُكُمْ فَآَتُوهُمْ نَصِيبَهُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدًا ((৩৩

"আমি প্রত্যেকের জন্য উত্তরাধিকার বা মীরাস নির্ধারণ করেছি, যা তাদের বাবা,মা ও আত্মীয় স্বজন ত্যাগ করে যায় এবং তোমরা যাদের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ তাদের অংশ প্রদান কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে সাক্ষী।" (৪:৩৩)

আগের আয়াতে বলা হয়েছে নারী ও পুরুষ যা অর্জন করে তা তাদের নিজস্ব সম্পদ। আর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, প্রত্যেক নারী ও পুরুষ উত্তরাধিকার সূত্রে যা পায়,সেগুলোও তাদের নিজস্ব সম্পদ। এরপর আরো বলা হয়েছে, উপার্জন ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ ছাড়াও কারো সাথে বৈধ চুক্তির ভিত্তিতে মানুষ যেসব সম্পদ অর্জন করে, সেগুলোর মালিকও তারাই। ইসলাম পূর্ব যুগে আরবদের মধ্যে এক ধরনের চুক্তি প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুযায়ী দুই ব্যক্তি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হত যে, তারা জীবনে একে অপরকে সহায়তা করবে। একজন কোন ক্ষতির সম্মুখীন হলে অন্যজন সেই ক্ষতিপূরণ করবে এবং তাদের কারো মৃত্যুর পরে অন্যজন মৃত ব্যক্তির সম্পদ উত্তরাধিকার হিসেবে ভোগ করবে। ইসলাম অনেকটা বীমার মত এই চুক্তিপ্রথা মেনে নিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার পাবার জন্য মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী না থাকার বিষয়কে শর্ত করে দিয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পূর্ণরূপে খোদায়ী আইন। কেউ এর মূলনীতি বা এর কোন অংশ বিশেষে পরিবর্তন আনার অধিকার রাখে না।
দ্বিতীয়ত : চুক্তি ও প্রতিজ্ঞা পালন করা ধর্মীয় দৃষ্টিতেও ফরজ বা অবশ্য পালনীয়। বিশেষ করে, যেসব চুক্তি অর্থ লেনদেন সম্পর্কিত তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কারণ, এসব চুক্তি লঙ্ঘনের ফলে অন্যপক্ষ আর্থিকভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তৃতীয়ত : প্রতিজ্ঞা এবং চুক্তিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুর পরও কার্যকরী রাখতে হবে। মৃত্যুর কারণে চুক্তির অমর্যাদা করা উচিত নয়।