সূরা আন নিসা;(৮ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা;(৮ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:45:47 3-10-1403

 

সূরা আন নিসা;আয়াত ২৬-৩১

 

সূরা নিসার সূরার ২৬,২৭ ও ২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

يُرِيدُ اللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ (২৬) وَاللَّهُ يُرِيدُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَيُرِيدُ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الشَّهَوَاتِ أَنْ تَمِيلُوا مَيْلًا عَظِيمًا (২৭) يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُخَفِّفَ عَنْكُمْ وَخُلِقَ الْإِنْسَانُ ضَعِيفًا ((২৮

"আল্লাহ এই সব বিধান বর্ণনা করে তোমাদের জন্য সৌভাগ্যের পথ স্পষ্ট করতে চান এবং পূর্ববর্তীদের জীবন-চরিত্র তুলে ধরতে চান। আল্লাহ তোমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করে পুণরায় তোমাদেরকে অনুগ্রহ করতে চান।" (৪:২৬)
"আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হতে চান,কিন্তু যারা কামনা-বাসনার অনুসারী,তারা তোমাদের ঘোর অধঃপতন চায়।" (৪:২৭)
"আল্লাহ তোমাদের দায়িত্বের বোঝা হাল্কা করতে চান। কারণ মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই দুর্বল।" (৪:২৮)

পূর্ববর্তী আয়াতে বিয়ে করতে উৎসাহ দেয়া এবং এ সম্পর্কিত বিধান ও শর্ত উল্লেখের পর এ তিন আয়াতে এটা মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে,এ সব বিধি বিধান দেয়া হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্যেই। আল্লাহ মানুষের সৌভাগ্য নিশ্চিত করা এবং তাদেরকে অপবিত্রতা থেকে দূরে রাখার জন্য এই সব বিধান দিয়েছেন। মানুষকে পথ দেখানো আল্লাহর একটি রীতি। আর এ জন্যেই তিনি নবী- রাসূল এবং ধর্ম গ্রন্থ পাঠিয়েছেন। কিন্তু একদল লোক যারা কিনা নিজেরাও বিভ্রান্ত তারা চায় অন্যরাও তাদের মত পথভ্রষ্ট হোক। আর এ জন্যে তারা অন্যদেরকেও কু-প্রবৃত্তি ও যৌন লালসার দাস বানানোর ষড়যন্ত্র করে।
শেষের আয়াতটিতে আল্লাহ বলছেন,আমার বিধি-বিধান কঠিন কিছু নয়। বরং মানুষের দুর্বল মনের কথা বিবেচনা করে বহু বিবাহ ও বিভিন্ন ধরনের বিয়ের বৈধ পন্থা দেখিয়ে দেয়া হয়েছে,যাতে তারা প্রবৃত্তির তীব্র তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং নিজেকে ও সমাজকে পবিত্র রাখতে পারে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমতঃ ধর্মীয় বিধি-বিধান মানবজাতির জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ । কারণ,এসব বিধান মানুষকে জীবন যাপনের সঠিক পথ দেখায়।
দ্বিতীয়তঃ যৌন কামনা মানুষের অন্যান্য কামনার মতই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। কিন্তু অবাধ যৌনাচার ও অবৈধ সম্পর্ক পরিবার ব্যবস্থা এবং সমাজ ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে।
তৃতীয়তঃ ইসলাম সহজ সরল কর্তব্য কাজের ধর্ম এবং সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে বলে এ ধর্মে অচলাবস্থার কোন অবকাশ নেই। তাই, ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হলো,বিভিন্ন দায়িত্বের পরিধি বর্ণনা করা যাতে সেগুলো পালন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়।

সূরা নিসার ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا (২৯) وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ عُدْوَانًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًا وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا ((৩০

"হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না,কিন্তু পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতে তোমাদের মধ্যে ব্যবসা বৈধ এবং তোমরা নিজেদের হত্যা করো না,আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়াময়।" (৪:২৯)
"এবং যে কেউ সীমালংঘন করে এবং অন্যায়ভাবে তা করবে,সে শিগগিরই আগুনে দগ্ধ হবে। আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ।"(৪:৩০)

আগের আয়াতে চারিত্র্যিক পবিত্রতা রক্ষা এবং কারো সম্ভ্রমহানি করা ও ব্যাভিচার থেকে দূরে থাকার জন্য মানুষকে আআহ্বান জানানোর পর এই দুই আয়াতে অন্যের সম্পদ ও জীবনের ওপর আগ্রাসন চালানো থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন, অন্যদের জীবন ও সম্পদকে নিজের জীবন ও সম্পদের মতই গুরুত্ব দেবে। অন্যের ওপর অত্যাচার এবং অন্যের সম্পদ গ্রাস করা অবৈধ। অবশ্য পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে ব্যবসায়িক লেনদেন বৈধ। অন্যদের হত্যার মত আত্মহত্যা ও অত্যাচারী ও আগ্রাসী মানসিকতারই লক্ষণ। তাই আত্মহত্যার জন্যেও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। পরকালে জাহান্নামের আগুন হত্যাকারীদেরকে দগ্ধ করবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলামে ব্যক্তি-মালিকানা স্বীকৃত এবং ব্যক্তির মালিকানাকে ইসলাম সম্মান করে। তাই ব্যক্তিগত সম্পদের লেনদেনের ক্ষেত্রে মালিকের সন্তুষ্টিকে প্রধান শর্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত : সঠিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অভাবেই সমাজে বৈষম্য,হত্যাকাণ্ড ও দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে।
তৃতীয়ত : মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। নিজেকে এবং অন্যদের হত্যা করা সম্পূর্ণ হারাম।
চতুর্থত : আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি দয়ালু । কিন্তু আল্লাহ অত্যাচারীদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর। কারণ,আল্লাহর কাছে মানুষের অধিকার সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

সূরা নিসার ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا ((৩১

"হে ঈমানদারগণ, তোমরা যদি নিষিদ্ধ ঘোষিত বড় বড় পাপ থেকে দূরে থাক, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ছোট পাপগুলো গোপন রাখবেন এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থান দেবেন।" (৪:৩১)

এ আয়াত থেকে যেটা বোঝা যায় তা হলো, গোনাহ বা পাপ আল্লাহর কাছে দু'ধরনের। প্রথমত : ছোট গোনাহ ও দ্বিতীয়ত : বড় গোনাহ। অবশ্য এটা স্পষ্ট যে, গোনাহ বড় হোক বা ছোট হোক তা আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী বলে খুবই নোংরা ও অপছন্দনীয় কাজ। পাপের পরিণতি এবং এর কুফলের ব্যাপকতা অনুযায়ী গোনাহকে ছোট ও বড় গোনাহ এ দু'ভাগে ভাগ করা যায়। বিভিন্ন হাদীসে ও বর্ণনায় এসব গোনাহর বৈশিষ্ট্য বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যে গোনাহর পরিধি বা সীমানা যত বেশী বিস্তৃত এবং যে গোনাহ যত বেশী মানুষ, পরিবার ও সমাজের ক্ষতি করে তাকে তত বড় বা কুৎসিততর গোনাহ বলা হয়। একজন সাধারণ মানুষ কোন ছোট গোনাহ করলে তাকে ছোট গোনাহ বলে ধরা হয়। কিন্তু কোন বড় ব্যক্তিত্ব বা নেতা যেমন কোটি জনতার নেতা যদি খুব ছোট গোনাহও করে থাকেন তাহলেও তা বহু মানুষের বিভ্রান্তির জন্য দায়ী বলে তাকে অনেক বড় গোনাহ বলে ধরা হয়। মোট কথা,এই আয়াতে আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে বলছেন,মানুষ যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে থাকে তাহলে আমি তাদের ছোট ছোট গোনাহ উপেক্ষা করব এবং তাদেরকে ক্ষমা করে তাদেরকে বেহেশতে স্থান দেব।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আল্লাহ মানুষের ছোট-খাট অপরাধ মাফ করে দেবেন। তাই আমাদেরও উচিত অন্যদের ছোট-খাট অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া,সামান্য অপরাধের ব্যাপারে ছিদ্রান্বেষী হওয়া উচিত নয়।
দ্বিতীয়ত : যদি আমাদের কাজ কর্ম ও চিন্তাধারার মূলনীতি সঠিক হয়, তাহলে আমরা তওবা করার আগেই আল্লাহ আমাদের ছোট-খাটো অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
তৃতীয়ত : আমরা যেন মানুষের সম্ভ্রম,সম্পদ ও জীবনের ওপর সব ধরনের আগ্রাসন থেকে দূরে থাকতে পারি এবং আল্লাহর বিধান যথাযথভাবে মেনে চলতে পারি।