সূরা বাকারাহ; আয়াত ৫৩-৫৬
বনী ইসরাইলীদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ পাক সূরা বাকারাহ'র ৫৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
وَإِذْ آَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَالْفُرْقَانَ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
"আর (স্মরণ কর) যখন আমি মূসাকে কিতাব এবং ফোরক্বান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বিধানকারী নির্দেশ) দান করেছি, যাতে তোমরা সরল পথ প্রাপ্ত হতে পার।" (২:৫৩)
ফোরক্বান শব্দের অর্থ হলো সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথককারী। আসমানী কেতাব ও নবীদের মোজেজার মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করা যায় বলেই আসমানী কিতাব ও নবীদের মোজেজাকে ফোরক্বান বলা হয়। মহান আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে আসমানী কিতাব বা ঐশী গ্রন্থ এবং পথনির্দেশক হিসাবে নবীদেরকে পাঠিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি মানুষের কাছে মিথ্যাবাদী ও সত্যবাদীদেরকে চিহ্নিত করার জন্য পয়গম্বরদেরকে অলৌকিক নিদর্শন বা মোজেজা প্রদর্শনের ক্ষমতা দিয়েছেন।
এরপর ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنْفُسَكُمْ بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ عِنْدَ بَارِئِكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
"এবং যখন মূসা নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিল,হে আমার সম্প্রদায়!তোমরা বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে ঘোর অনাচার করেছ, সুতরাং তোমরা তোমাদের স্রষ্টার দিকে ফিরে যাও এবং তোমরা নিজ নিজ প্রাণ উৎসর্গ কর। তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় বা কল্যাণকর। তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাপরবশ হবেন, নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়। " (২:৫৪)
তুর পাহাড় থেকে ৪০ দিন পর হযরত মূসা (আঃ) যখন ফিরে এলেন, তখন তিনি দেখলেন তার জাতি গরুর বাছুরের পূজা করছে। এই আয়াতে মূসা (আঃ)এর সম্প্রদায়কে দু'টি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রথমত: তাদেরকে এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, তোমরা এ কাজ করে নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছ এবং বাছুরকে উপাস্য করে মানুষের মর্যাদা ও সম্মানকে পদদলিত করেছ।
দ্বিতীয়ত: তোমাদের অপরাধ কুফরীর চাইতেও বেশী। কারণ তোমরা সত্যকে উপলব্ধি করে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করার পর পুনরায় তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ। এ ভাবে তোমরা কট্টর বা চরম অবিশ্বাসী হিসাবে মূর্তাদ হয়ে গেছ। আর মূর্তাদ হবার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড বা প্রাণহরণ। মহান আল্লাহ দয়া ও করুণার আধার। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি মানবজাতির একজন আন্তরিক ও কল্যাণকামী অভিভাবক। তাই আল্লাহ মাঝে মধ্যে তিরস্কার ও কঠিন শাস্তির মাধ্যমে অন্যদেরকে এ শিক্ষা দিতে চান যে, ধর্ম নিয়ে কেউ যেন হেলা-ফেলা না করে এবং এভাবে আল্লাহ সমাজকে নোংরা ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে মুক্ত করেন। মূর্তি পূজা ও গরুর বাছুর পূজা এমন কোন সাধারণ বা ছোট-খাট অপরাধ নয় যে শুধু মৌখিক ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমেই ক্ষমা লাভ করা যেতে পারে। বিশেষ করে কোন সম্প্রদায়ের এ ধরনের অপরাধকে সহজেই ক্ষমা করা যায় না, যারা আল্লাহর নিদর্শনগুলো দেখেছিল এবং আল্লাহর অনেক নেয়ামত বা অনুগ্রহ ভোগ করে তার প্রতি বিশ্বাস বা ঈমানও এনেছিল।
এরপর ৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَى لَنْ نُؤْمِنَ لَكَ حَتَّى نَرَى اللَّهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ
"হে বনী ইসরাইল! স্মরণ কর যখন তোমরা বলেছিলে,হে মূসা! আমরা আল্লাহকে প্রত্যক্ষভাবে না দেখা পর্যন্ত তোমাকে কখনও বিশ্বাস করবো না। তখন তোমরা বজ্রাহত হয়েছিলে এবং তোমরা প্রত্যক্ষ করেছিলে।" (২:৫৫)
এখানে বনী ইসরাইল বা ইহুদী জাতির আরেকটি বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা একবার গরুর বাছুর পূজায় লিপ্ত হয়েছিল সে কথা এরআগে বলা হয়েছে। এরপর তারা হযরত মূসার কাছে এই দাবী তোলে যে আমরা আল্লাহকে নিজ চোখে সরাসরি দেখতে চাই। আর আল্লাহকে এভাবে দেখার পরই তোমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করব এবং তোমার অনুগত হব। আল্লাহ তাদেরকে এটা বোঝাতে চাইলেন যে, মানুষ চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখা তো দূরের কথা তার অনেক সৃষ্টিকে দেখারও ক্ষমতা রাখে না। তাই আল্লাহর নূর বা আলোর এমন এক ঝলক তাদের ওপর এসে পড়লো যে,তারা বজ্রাহত হয়ে ভয়ে-আতঙ্কে মৃত্যুমুখে পতিত হলো।
এরপর ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন,
ثُمَّ بَعَثْنَاكُمْ مِنْ بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
"অতঃপর আমি মৃত্যুর পর তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম যাতে তোমরা আমার অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।'"(২:৫৬)
বজ্রপাতের ঘটনায় বনী ইসরাইল বা ইহুদীগোত্রের ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মারা গিয়েছিল। হযরত মূসা (আঃ)এর দোয়ার কারণে আল্লাহ তাদের পুনরায় জীবিত করেন, যাতে তারা ও পুরো ইহুদীগোত্র আল্লাহ ও তার শক্তিতে বিশ্বাস করে।
সূরা বাকারাহ'র ৫৩,৫৪,৫৫ ও ৫৬ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. খোদা নয়,পাপীরা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করে। মানুষের প্রকৃত সত্ত্বা তার দেহ নয় বরং আত্মা। আর পাপ বা গোনাহ মানুষের আত্মাকে কলুষিত করে এবং আত্মাকে রোগাক্রান্ত করে। ফলে আত্মার মৃত্যু ঘটে। আর তখন মানুষের মধ্যে পাশবিক কাঠামো ছাড়া আর কিছুই বাকী থাকে না।
দুই. প্রত্যেক গোনাহ বা পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা তওবা হতে হবে পাপের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে দিয়ে গরুর বাছুরের উপাসনার পাপ শুধু কান্না ও ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মোচন হতে পারে না। মৃত্যুদণ্ড গ্রহণের মাধ্যমেই এই পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে হবে।
তিন. অনেকেই বলে থাকেন যে আল্লাহকে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তারা হয় অজ্ঞতা অথবা একগুঁয়েমীর কারণেই এ ধরনের কথা বলেন। কারণ আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। অবশ্য আল্লাহর শক্তি, ক্ষমতা ও মহত্বকে মানুষ নিজেদের মধ্যে ও সমগ্র সৃষ্টিজগতে দেখতে পারে।
চার. মৃতদেরকে জীবিত করা অসম্ভব কোন ব্যাপার নয়। মহান আল্লাহ এই পৃথিবীতেই অনেক মৃত মানুষকে জীবিত করেছেন। যেমন বজ্রপাতের ঘটনায় যে ৭০ জন ইহুদী নেতা মারা গিয়েছিল, হযরত মূসা (আঃ)-এর দোয়ায় আল্লাহ তাদেরকে পুনরায় জীবিত করেছিলেন।