সূরা বাকারাহ; আয়াত ৪৮-৫২
সূরা বাকারাহ'র ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ
"আর সেদিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও কবুল হবে না;কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না।" (২:৪৮)
এই আয়াতে পরকাল সম্পর্কে মানুষের চার ধরনের ভুল ধারণা তুলে ধরে সেগুলোর জবাব দেয়া হয়েছে। ইহুদীরা মনে করত তাদের পূর্বপুরুষেরা তাদেরকে পরকালের আজাব থেকে রক্ষা করতে পারবে। অথবা তাদের ধর্মীয় নেতারা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। কিংবা তাদের বন্ধুরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে। ইহুদীদের মধ্যে অনেকে আবার ভাবতো ক্ষতিপূরণ দেয়ার মাধ্যমে তারা পরকালের শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে। পবিত্র কোরআন তাদের এসব ভুল ধারণার জবাবে বলেছে,ওই দিন কেউ কাউকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। কেয়ামতের দিন সবাই ব্যস্ত নিজের মুক্তি চিন্তায়। তাই তোমরা শুধু তোমাদের ঈমান ও সৎকাজের ওপর আস্থা রেখ। অবশ্য আল্লাহ তার অফুরন্ত দয়া ও রহমতের কারণে সৎ পথে ফিরে আসার পথ বন্ধ রাখেননি। দুনিয়াতে তওবা আর পরকালে সুপারিশের পথ খুলে দিয়ে আল্লাহ গুনাহগারদেরকে ক্ষমা লাভের আশা দিয়েছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সুপারিশের কিছু শর্ত আছে। ওইসব শর্তের ফলে মানুষের মধ্যে পাপকাজের সাহস থাকে না এবং সে পুনরায় অপরাধ করা থেকে দূরে থাকে। তাই এ আয়াতে নিঃশর্ত সুপারিশের যে ধারণা ইহুদীদের মধ্যে ছিল তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আর খ্রিস্টানদের বিশ্বাস হচ্ছে হযরত ঈসা মাসিহ (আ) তাঁর অনুসারীদের পাপ মার্জনার জন্য নিজের জীবনকেই উৎসর্গ করেছেন। কোরআন এই ধারণাও বাতিল করে দিয়েছে।
এরপর ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ نَجَّيْنَاكُمْ مِنْ آَلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبْنَاءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ نِسَاءَكُمْ وَفِي ذَلِكُمْ بَلَاءٌ مِنْ رَبِّكُمْ عَظِيمٌ
"হে বনী ইসরাইল, তোমরা ওই সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন আমি ফেরাউনী সম্প্রদায় থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলাম যারা তোমাদেরকে অত্যন্ত মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিত। তারা তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করতো এবং নারীদেরকে দাসী হিসাবে ব্যবহার করার জন্য জীবিত রাখত। এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ছিল এক মহা পরীক্ষা।" (২:৪৯)
ফেরাউন তার শাসন ক্ষমতা রক্ষার জন্য বিভিন্ন অজুহাতে বনী ইসরাইল জাতির তরুণ ও পুরুষদেরকে হত্যা করতো। আর ওই গোত্রের মহিলাদেরকে ব্যবহার করতো ক্রীতদাসীর মত। এভাবে ফেরাউন ও তার দলবল বনী ইসরাইল জাতিকে দুর্বল করে রেখেছিল। কোরআনের দৃষ্টিতে ওই দুঃখ-দুর্দশা এবং এই মুক্তি ও শান্তি, দু'টিই মানুষের জন্য পরীক্ষা। মানুষের প্রকৃত অবস্থা যাতে উন্মোচিত হয় এবং সে পূর্ণতায় পৌঁছে, সেজন্যে আল্লাহ পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছেন।
এরপর ৫০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ فَرَقْنَا بِكُمُ الْبَحْرَ فَأَنْجَيْنَاكُمْ وَأَغْرَقْنَا آَلَ فِرْعَوْنَ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ
"হে বনী ইসরাইল, তোমরা ওই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন তোমাদের জন্য সাগরকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলাম। তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলাম কিন্তু ফেরাউনী সম্প্রদায়কে নিমজ্জিত করেছিলাম। আর তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।" (২:৫০)
এই আয়াতে ফেরাউনের হাত থেকে বনী ইসরাইল জাতি কিভাবে রক্ষা পেয়েছিল,তা ইঙ্গিত করা হয়েছে। বনী ইসরাইল জাতির উদ্ধার পাওয়ার ঘটনাটি ছিল স্পষ্ট মুজেযা এবং আল্লাহর অলৌকিক কাজের দৃষ্টান্ত। আল্লাহর নির্দেশে হযরত মূসা (আ.) তার জাতিকে মিশর থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু যখন হযরত মূসা ( আঃ) নীল নদের কাছাকাছি পৌঁছলেন তখন বুঝতে পারলেন যে, ফেরাউন ও তার বাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করছে। প্রচণ্ড উদ্বেগ আর আতঙ্কে বনী ইসরাইল গোত্র কাঁপতে থাকল। তখন আল্লাহর আদেশে হযরত মূসা (আ.) তার হাতের লাঠিখানা দিয়ে সাগরে আঘাত করলেন। সাগরের পানি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল এবং নীল নদ অতিক্রমের জন্য একটি পথ সৃষ্টি হলো। ফেরাউনের বাহিনী নীল নদের মধ্যেই তাদের পিছু ধাওয়া করল। কিন্তু যখন তারা মাঝামাঝি পৌঁছল তখন নীল নদের পানি একত্রিত হল এবং ফেরাউন বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেল। বনী ইসরাইল জাতি নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পেল। তারা আল্লাহর মুজেযা দেখলো ও স্বচক্ষে দুশমনদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করলো। এর চেয়ে বড় দয়া ও নেয়ামত আর কি হতে পারে ?
এর পরের আয়াতে বনী ইসরাইলীদের পাপে লিপ্ত হওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ وَاعَدْنَا مُوسَى أَرْبَعِينَ لَيْلَةً ثُمَّ اتَّخَذْتُمُ الْعِجْلَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَنْتُمْ ظَالِمُونَ
"(হে বনী ইসরাইল!) তোমরা স্মরণ কর যখন মূসার জন্য চল্লিশ রাত নির্ধারণ করেছিলাম। তার প্রস্থানের পর তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলে। আর এ কাজের মাধ্যমে তোমরা নিজের ওপরই জুলুম করেছিলে।" (২:৫১)
ফেরাউনের অত্যাচার থেকে বনী ইসরাইল জাতি উদ্ধার পাবার পর ৪০ দিনের জন্য হযরত মূসা (আ.)কে তুর পাহাড়ে যেতে হলো। সেখানে তিনি গেলেন তওরাতের বাণী গ্রহণের জন্য। কিন্তু এই অল্প সময়েই বনী ইসরাইল জাতির জন্য এক বড় পরীক্ষা আসল। সামেরী নামের এক অতি ধূর্ত ব্যক্তি মানুষের সোনা-দানা দিয়ে একটি গরুর বাছুরের প্রতিকৃতি তৈরী করল। মুর্তিটি থেকে গরুর ডাক ভেসে আসত এবং জনগণ অবাক হয়ে যেত। সামেরী তখন জনগণকে স্বর্ণের তৈরী অদ্ভুত ওই মুর্তির উপাসনার দিকে আহ্বান জানায়। বেশীরভাগ মানুষ সামেরীর দলে যোগ দিল এবং বাছুর পূজা শুরু করল। এ কাজের মাধ্যমে তারা নিজের ওপর যেমন জুলুম করলো তেমনি সুযোগ্য নেতা ও নবী হযরত মূসা (আ.)এর ওপর জুলুম করলো। অথচ হযরত মূসা (আ.) তাদেরকে ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষার জন্য কি কষ্টই না সহ্য করেছিলেন। অবশ্য তুর পাহাড় থেকে হযরত মূসা ফিরে আসার পর জনগণ তাদের অন্যায় বুঝতে পারলো। আল্লাহ তখন তাদের এই শিরকের অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।
সূরা বাকারাহ'র ৫২ নম্বর আয়াতে বিষয়টির বর্ণনা এ ভাবে দেয়া হয়েছে,
ثُمَّ عَفَوْنَا عَنْكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
"ওই বড় অপরাধের পরও আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।" (২:৫২)
বান্দাদের প্রতি আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহের একটি হলো অপরাধের জন্য সাথে সাথে তিনি শাস্তি দেন না বরং তিনি তাদেরকে অনুশোচনা ও তওবা করার সুযোগ দেন। এ ঘটনাতেও আল্লাহ বনী ইসরাইলের শিরকের মত বড় পাপ ক্ষমা করে দিলেন।
সূরা বাকারাহ'র ৪৮,৪৯,৫০,৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াতের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. দৈনন্দিন জীবনে পরকালের কথা মনে রাখতে হবে। ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা বা বন্ধুত্বের জন্য পাপ করা ঠিক নয়। কারণ ওই দিন কেউ কারো সাহায্য করতে পারবে না। কোন ধন-সম্পদ সুপারিশের কাজে আসবে না।
দুই. ফেরাউন সম্প্রদায়ের মত খোদাদ্রোহী শক্তির প্রথম লক্ষ্য হলো তরুণ সমাজ। বর্তমান পৃথিবীতেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো উশৃঙ্খলতা ও বিভিন্ন গর্হিত কাজে আসক্তি সৃষ্টি করে যুবসমাজকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পোশাক-আশাক সাজ-গোজ এ সব ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে তারা নারীকে তাদের কামনা বাসনার উপাদানে পরিণত করেছে।