সূরা বাকারাহ'র ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
تَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
"তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও,অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না?" (২:৪৪)
গত পর্বে আমরা বলেছি আল্লাহপাক ইহুদী পণ্ডিতদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন তোমরা কেন সত্য গোপন কর এবং মানুষকে তা জানতে দাও না? এ আয়াতেও তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, "ইসলামের নবীর আগমনের পূর্বে তোমরা যারা জনগণকে ওই নবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিতে,এখন তোমরা কেন তার প্রতি ঈমান আনলে না? অথচ তোমরা তওরাত সম্পর্কে অনেক জান।" যদিও এ আয়াতে বনি ইসরাইল ও তাদের পণ্ডিতদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, কিন্তু আয়াতটির অর্থ অনেক ব্যাপক। সব ধর্ম ও মতবাদের প্রচারকরদের ক্ষেত্রে এই আয়াত প্রযোজ্য। এ সম্পর্কে রাসূলে খোদার বিশিষ্ট বংশধর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, মানুষকে মুখ দিয়ে নয় নিজের কর্ম দিয়ে সৎ কাজের দিকে আহ্বান জানাও। আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) এ সম্পর্কে বলেন, "আল্লাহর কসম, আমি নিজে করি না এমন কোন কাজ করতে তোমাদেরকে উৎসাহ দেই না, আর আমি এমন কাজে তোমাদেরকে বাধা দেই যা থেকে আমি নিজে বিরত থাকি।" পবিত্র কোরআনের সূরা জুমার ৫ নম্বর আয়াতে আমলবিহীন জ্ঞানী ব্যক্তিকে গাধার সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে কেবল বইয়ের বোঝা বহন করে আর অন্যরা ঐসব বই থেকে উপকৃত হয় অথচ নিজে ভার বহন ছাড়া তা থেকে লাভবান হয় না।
এই সূরার ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ
"তোমরা ধৈর্য্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও। আর নিশ্চয়ই এ কাজ বিনয়ী ও খোদাভীরু ছাড়া অন্যদের জন্য কঠিন।" (২:৪৫)
মানুষের ভেতরের কামনা-বাসনা ও বাইরের সমস্যার মোকাবেলায় মানব জীবনের সর্বোত্তম সাথী হলো দৃঢ়তা ও অবিচল থাকা। এই অবিচলতা তার মধ্যে জোগায় অফুরন্ত শক্তি। আর এই শক্তির বলে সে বিনীতভাবে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পন ও তাঁরই এবাদত করতে পারে। এই আয়াতে যে ধৈর্য্যের কথা বলা হয়েছে কিছু হাদীসে তাকে " রোজা " বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে রোজা কেবল ধৈর্য্য এবং সংযমের একটি রূপ। এ ছাড়াও ধৈর্য্যের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাই রাসূলে খোদা (সাঃ) বলেছেন,"ধৈর্য্য বা সবর তিন ধরনের। একটি হলো বিপদ-আপদের সময় ধৈর্য্য, আরেকটি হলো পাপ কাজের ব্যাপারে ধৈর্য্য অবলম্বন এবং তৃতীয় হলো, আল্লাহর নির্দেশ ও এবাদত পালনের ক্ষেত্রে ধৈর্য্য।" নবী বংশের সদস্য ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, "যখন দুনিয়ার কোন দুঃখে তুমি আক্রান্ত হবে তখন অজু করে মসজিদে চলে যাবে। সেখানে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে। কারণ আল্লাহপাক নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছেন।" যাদের অন্তর পবিত্র তারা নামাজকে সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করে, কিন্তু যারা অহঙ্কারী তারা নামাজকে ভারী বোঝা বলে মনে করে। তারা নামাজের দিকে মনোযোগী হওয়ার পরিবর্তে নামাজ থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
এরপর ৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
"বিনীত তারাই যারা বিশ্বাস করে যে তাদের প্রতিপালকের সাথে অবশ্যই তাদের সাক্ষাৎ ঘটবে এবং তাঁরই দিকে তারা প্রত্যাবর্তন করবে।" (২:৪৬)
পরকাল ও আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার বিশ্বাস মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তোলে বিনয়, খোদাভীরুতা ও দায়িত্ব অনুভূতি। এই বিশ্বাস তার জীবনকে পরিণত করে একটি আদালতে যেখানে তাকে সব কাজের জবাবদিহিতা করতে হবে। আল্লাহর সাথে মানুষের সাক্ষাতের যে কথাটি এ আয়াতে বলা হয়েছে, তার অর্থ দৈহিক সাক্ষাত নয়। কারণ আল্লাহ পাকের কোন আকৃতি নেই যে মানুষ পরকালে তাকে চোখে দেখতে পাবে। বরং আল্লাহর সাথে মানুষের সাক্ষাতের অর্থ হলো, তার পুরস্কার ও শাস্তি দানের মধ্য দিয়ে তার শক্তি অবলোকন করা। ওই সময় মানুষ হৃদয় ও অন্তরে আল্লাহপাকের দর্শন লাভ করবে, যেন আল্লাহকে সে সরাসরি অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে পাচ্ছে এবং দর্শন সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা সংশয় নেই।
হযরত আলী (আঃ)-এর একজন সহচর একবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আল্লাহকে দেখেছেন? হযরত আলী জবাবে বললেন, যে আল্লাহকে আমি দেখি না কিভাবে আমি তার এবাদত করবো? এর পর ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, চর্ম চক্ষুতে তাকে দেখা যায় না ঠিকই, তবে ঈমানের নূরে আলোকিত অন্তর তাকে উপলদ্ধি করতে পারে।
এরপর এই সূরার ৪৭নং আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ
"হে বনী ইসরাইল, আমার সেই নেয়ামতের কথা স্মরণ করো, যা আমি তোমাদেরকে দান করেছি। আর আমিই তো তোমাদেরকে বিশ্বে সবার ওপর উচ্চমর্যাদা দান করেছি।" (২:৪৭)
ইহুদী জাতির প্রতি আল্লাহর অন্যতম দয়া ছিল তারা ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে মিশরের শাসন ক্ষমতা লাভ করে এবং অসংখ্য বস্তুগত সুখ-সম্পদ আল্লাহ তাদেরকে দান করেন। এ আয়াতে তৎকালীন যুগে অন্যান্য জাতির তুলনায় বনী ইসরাইল জাতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে তারা যাতে আল্লাহর মহা নেয়ামতের শোকর আদায় করে। অন্যান্য জাতির ওপর শ্রেষ্ঠত্বের এ মর্যাদা হযরত মূসা (আঃ) এর নেতৃত্বের ফলে অর্জিত হয়। তাই নবী ইসরাইল জাতিকে আল্লাহ তা'লা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
সূরা বাকারাহ'র ৪৪,৪৫,৪৬,৪৭ নম্বর আয়াতের প্রধান কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে।
এক. মুখে নয় বরং কর্মের মাধ্যমে সৎকাজের প্রতি অন্যদেরকে আহ্বান জানাতে হবে অর্থাৎ অন্যদের বলার আগে নিজেকে তা আমল করতে হবে।
দুই. সমস্যার ওপর জয়ী হবার জন্য দু'টি বিষয়ের প্রয়োজন। একটি অভ্যন্তরীণ শক্তি, আর তা হলো ধৈর্য্য ও অবিচলতা। অপর বিষয়টি বাহ্যিক শক্তি, আর তা হলো নামাজ ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক।
তিন. পরকালের প্রতি গভীর বিশ্বাসতো বটেই এমনকি এর অস্তিত্বের ব্যাপারে ধারণাও মানুষকে যেকোন অন্যায় থেকে বিরত রাখতে পারে।
চার. মানুষ আল্লাহর নবীদের নেতৃত্বের ফলে শুধু পরকালে বেহেশতই লাভ করে না বরং দুনিয়াতেও বস্তুগত সুখ-সম্পদ লাভ করে। তাদের নেতৃত্বে মানুষ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে