সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৩-২৪ (৯ম পর্ব)
সূরা বাকারাহ'র ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا
بِسُورَةٍ مِنْ مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ
كُنْتُمْ صَادِقِينَ (23
"আমি আমার বান্দার (মোহাম্মাদের) প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন
সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মত কোন সূরা আনো। আর যদি সত্যবাদী হও তাহলে এ কাজের
জন্য আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সব সাক্ষীকে আহ্বান কর।" (২:২৩)
প্রত্যেক নবীকে তার নবুয়্যত প্রমাণ করার জন্য মুজিযা আনতে হয়। মুজিযা
অর্থাৎ এমন অলৌকিক কাজ তাকে দেখাতে হয় যা অন্যদের পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়।
ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মুজিযা হলো পবিত্র কোরআন। মানব জাতি
ভাষা কিংবা অর্থের দিক থেকে কোরআনের মত গ্রন্থ সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
আল্লাহপাক ইসলাম বিরোধীদের প্রতি বহুবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে
বলেছেন-"তোমরা যদি কোরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে মনে না করো এবং একে মানব রচিত
গ্রন্থ বলে মনে করো তাহলে কোরআনের মতো একটি গ্রন্থ নিয়ে আসো।"
মজার ব্যাপার হলো- কোরআন দুশমনদেরকে বার বার তার চ্যালেঞ্জের শর্ত সহজ করে
দিয়েছে। একবার বলেছে-কোরআনের মত কোন গ্রন্থ নিয়ে আসো। আরেক জায়গায়
বলেছে-কোরআনের মত দশটি সূরা নিয়ে আসো। আর এ আয়াতে বলা হয়েছে-কোরআনের মত
অন্তত একটি সূরা নিয়ে আসো। এ ছাড়া কোরআন এ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ইসলাম
বিদ্বেষীদের উদ্দেশ্যে বলেছে, এ রকম একটি সূরা লেখার জন্য বিশ্বে তোমাদের
যত সাহায্যকারী ও সমমনা ব্যক্তি আছে প্রয়োজনে তাদের সবার সাহায্য নাও।
কিন্তু জেনে রাখো যে এ কাজ করার সাধ্য তোমাদের নেই।
আল্লাহর সব নবীরই মুজিযা ছিল। কিন্তু মহানবী (সা.)এর মুজিযা অর্থাৎ কোরআনের
কতগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট রয়েছে। যেমন, কোরআন নিজেই অবিশ্বাসীদের প্রতি
চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় এবং তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। কিন্তু অন্যান্য
নবীদের মুজেজা স্বয়ং নবীদেরকে প্রদর্শন করতে হতো এবং জনগণকে বলতে হতো যে
এটা আমার মুজেজা। কোরআনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এটি চিরন্তন। অন্যান্য
নবীদের মুজিযা একটি বিশেষ সময়ে সংঘটিত হয়েছে এবং শুধু ওই যুগের মানুষই তা
দেখেছে ও শুনেছে। কিন্তু কোরআন শুধু রাসূলে খোদা (সা.)এর যুগের জন্য মুজিযা
নয় বরং সর্ব যুগের জন্য এটি মুজিযা। কালের পরিক্রমায় এ ঐশী গ্রন্থ কখনো
পুরনো হবে না বরং দিন দিন এর বিষয়বস্তু আরো স্পষ্ট ও বিকশিত হবে। পবিত্র
কোরআনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এর বিশ্বজনীনতা। কোরআন কোন কালের গণ্ডীতে
সীমাবদ্ধ নয়, কোন বিশেষ ভূখণ্ড বা স্থানের জন্যও নির্ধারিত নয়। কোরআন
যাদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছে, তারা শুধু আরবভাষী হিজাজের অধিবাসী নয় বরং
পৃথিবীর সকল জাতি, বর্ণ, গোত্র সবাইকে উদ্দেশ্য করে কোরআন কথা বলেছে। তাই এ
আসমানী কিতাবের একটি জায়গাতেও "হে আরব জাতি" কথাটি আসেনি। বরং পৃথিবীর সব
মানুষকে উদ্দেশ্য করে কোরআন বলেছে "হে মানব জাতি"। মুজিযা হিসাবে কোরআন
মজিদের ৪র্থ বৈশিষ্ট্য হলো এর আধ্যাত্মিকতা। অন্যান্য নবীদের মুজিযা ছিল
দৈহিক ও বস্তুগত। সেসব অলৌকিক ঘটনা দেখে মানুষ অভিভুত হয়ে যেত। কিন্তু
কোরআন সাধারণ বর্ণমালা দিয়ে রচিত হলেও মানুষের অন্তরের মধ্যে এত গভীর
প্রভাব ফেলে যে খুব সহজেই তা মানুষের জ্ঞানকে বিষ্ময়ে অভিভূত করে এবং তার
মন ও আত্মাকে বিমোহিত করে ফেলে।
এই আয়াতে কয়েকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,পয়গম্বরগণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
বৈশিষ্ট্য হলো তারা আল্লাহর পূর্ণ অনুগত এবং একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করেন।
তাই কোরআনের বহু জায়গায় নবীদেরকে "আমার বান্দা বলে অভিহিত করা হয়েছে।
যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে "কোরআনকে আমি আমার বান্দার ওপর নাযিল করেছি।"
কোরআন হলো যুক্তির গ্রন্থ। এ গ্রন্থ কোন সন্দেহ বা সংশয়ের অবকাশ রাখে না।
তাই বলা হয়েছে "যদি তোমরা সন্দেহ কর তাহলে" কোরআনের অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে
আসো। এছাড়া কোরআন হলো আল্লাহর চিরন্তন ও সার্বজনীন মুজিযা। এটি প্রত্যেক
যুগেই মানুষের প্রতি তার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
এরপর এই সূরার ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي
وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ (24
"আর যদি তা না পার-অবশ্য তা তোমরা কখনও পারবে না, তাহলে সেই আগুন থেকে
রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা কর, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর। যা প্রস্তুত করা
হয়েছে কাফেরদের জন্য।" (২-২৪)
এর আগের আয়াতে কোরআন অবিশ্বাসী-কাফেরদেরকে কোরআনের সূরার অনুরূপ একটি সূরা
লেখার আহ্বান জানিয়েছে। আর এ আয়াতে বলছে- এ কাজ কখনোই তাদের পক্ষে সম্ভব
হবে না। যারা রাসূলের কথা ও বাচনভঙ্গীর সাথে পরিচিত এবং তার যুগে বসবাস
করেছে তারা যেমন কোরআনের মত একটি সূরা তৈরী করতে পারবে না, তেমনি ভবিষ্যতেও
এ কাজ কারো দ্বারা সম্ভব হবে না। এরপর কোরআন অবিশ্বাসীদেরকে জাহান্নামের
আগুনের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছে, জাহান্নামের আগুনের জ্বালানি
হিসাবে পাপাচারী ও খোদাদ্রোহীদের দেহ পাথরের পাশাপাশি জ্বলবে। এ আয়াতে
'পাথর' বলতে পীট কয়লা বোঝানো হচ্ছে যা দোজখের আগুন সৃষ্টি করে, কিংবা
পাথরের মূর্তি বোঝানো হচ্ছে, যেসব মূর্তিকে রাসূলে খোদার দুশমনরা উপাসনা
করতো, আল্লাহ তাদের অপরাধের প্রমাণ হিসাবে পাথরের ওই মূর্তিগুলোকে কেয়ামতের
সময় হাজির করবেন। যাতে মূর্তি পূজকেরা তাদের কৃতকর্মের কথা অস্বীকার করতে
না পারে।
এই আয়াতে আমাদের জন্য লক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে,-
প্রথমত: নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে দৃঢ়তার
সাথে কথা বলতে হবে এবং ইসলামের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে। এ আয়াতে
বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে-'তোমরা কোরআনের মত কোন সূরা
আনতে পারোনি এবং কখনও তা পারবেও না।
দ্বিতীয়ত: মানুষ অবিশ্বাসের ফলে পাথর ও জড় পদার্থের কাতারে গিয়ে ঠাঁই করে
নেয়। এ আয়াতে বলা হয়েছে-'দোযখের আগুনের জ্বালানি হলো মানুষ ও পাথর।'
তৃতীয়ত: যে অন্তর পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে এবং কোরআনের বাণী গ্রহণ করে না, কেয়ামতের দিন সেই অন্তরের পুনরুত্থান হবে পাথরের সাথে।
চতুর্থত: কোরআন কেবল রাসূলের যুগের জন্যেই মুজিযা নয় এবং এ আসমানী গ্রন্থ
সব যুগের জন্য মুজিযা। তাই বলা হয়েছে-"ভবিষ্যতেও কেউ কোরআনের মত কিছু রচনা
করতে সক্ষম হবে না।