সূরা বাকারাহ;(১১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(১১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:26:43 3-10-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৭-২৮
সূরা বাকারাহ'র ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
الَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ  
"যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যা অক্ষুণ্ন রাখতে আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত ।" (২:২৭)
আগের আয়াতে ফাসেক লোকদের বিভ্রান্তির কথা বলা হয়েছিল, আর এ আয়াতে ফাসেকদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথমত: তারা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং নিজেদের কামনা বাসনা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। এ আয়াতে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার বলতে মানুষের অন্তরে ঐশী প্রেরণার কথা বোঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে এই সহজাত ঐশী প্রবণতাসহ সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ ও সত্য-মিথ্যা বিচার করতে পারে এবং নবীদের আহ্বানে সাড়া দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত: মহান আল্লাহ যে সব অঙ্গীকার রক্ষা করতে বলেছেন ফাসেক ব্যক্তি তা ভঙ্গ করে। নবী-রাসুলদের সাথে এমনকি সমাজ ও পরিবারের সদস্যদের সাথে অবলীলায় অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফাসেক ব্যক্তিরা। ফলে এরা মন্দ কাজ ও অনাচারের বিস্তৃতি ঘটায়। তারা মনে করে তাদের পাপের প্রতিফল কেবল তারাই ভোগ করবে, অথচ তারা জানে না পাপের সামাজিক প্রভাব ব্যক্তিক প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশী। পাপ ও অনাচার সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে-
এক. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি অপছন্দনীয় কাজ। মুমিন ব্যক্তি কখনও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না, এমনকি কাফেরদের সাথেও সে তার অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে। আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কথা সে চিন্তাও করে না।
দুই. বিচারবুদ্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তির রায়কে উপেক্ষা করলে মানুষ সাধারণতঃ পাপে লিপ্ত হয় এবং সমাজ পাপ-পঙ্কিলতায় ভরে ওঠে। ইসলামের বিধি-বিধান ও সহজাত ঐশী প্রবণতাকে উপক্ষা করলে, মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিন. সূরা বাকারাহ'র ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- "আমার প্রতিশ্রুতি, সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।" এ আয়াত অনুযায়ী ঐশী নেতৃত্ব ও ইমামত হচ্ছে আল্লাহর অঙ্গীকার। এ আয়াতে বলা হয়েছে- ফাসেক লোকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ ধরনের অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। ইসলাম,মানুষের মধ্যে অনৈক্য বা বিভেদ চায় না। এ জন্যেই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং বিশেষ করে পিতামাতার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলাম পরিবার বা সমাজ থেকে দূরে থাকার বিরোধী। ইসলাম চায় মুসলমানরা একতাবদ্ধ থাকুক। এজন্য জুমার নামাজ এবং জামাতে নামাজ পড়ার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অসুস্থদের দেখতে যাওয়া, দুঃস্থদের সাহায্য করা এবং প্রতিবেশীদের বিপদে আপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া, ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই পছন্দনীয় কাজ। ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। নবী করিম (দঃ) বলেছেন, 'তোমরা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবে। এতে করে দারিদ্র দূর হবে, জীবিকা বৃদ্ধি পাবে এবং জীবন হবে বরকতময়।' অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, 'রক্তের সম্পর্ক রক্ষার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবে, যদিও তারা তোমাকে উপেক্ষা করে এবং অসৎ জীবন যাপন করে।' এ সম্পর্কে আরো কয়েকটি হাদীস হচ্ছে- 'রক্তের সম্পর্ক রক্ষার জন্য এক বছর ধরে হাঁটার প্রয়োজন হলে কিংবা সালাম দেয়া অথবা পানি পান করাবার মত সামান্য সময়টুকু থাকলেও তা পালন কর। যে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে মৃত্যু এবং পরকালের হিসাব তার জন্য সহজ হবে এবং বেহেশতে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হবে।'
সূরা বাকারাহ'র ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-
كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
"তোমরা কি করে আল্লাহকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদেরকে প্রাণ দিয়েছেন, আবার তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন এবং পুনরায় জীবন্ত করবেন, পরিণতিতে তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরতে হবে।" (২:২৮)
আল্লাহকে চেনার সর্বোত্তম উপায় হলো বিশ্বজগত এবং মানব সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা। জীবন ও মৃত্যু নিয়ে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে মানুষ এ সত্য উপলদ্ধি করতে পারে যে, আমি যদি নিজেই আমার স্রষ্টা হতাম তাহলে অবশ্যই চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী হতাম। কিন্তু একসময় আমরা ছিলাম না, পরে অস্তিত্ব লাভ করেছি এবং পূনরায় আমাদেরকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কাজেই এই প্রাণ বা জীবনই হচ্ছে আমাদের জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ বা নেয়ামত। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত অগ্রসর হবার পরও এখন পর্যন্ত এই প্রাণের স্বরূপ উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের জন্ম ও মৃত্যু পুরোপুরি আল্লাহর হাতে। আমরা নিজের ইচ্ছায় আসিনি, কাজেই নিজ ইচ্ছায় যেতেও পারব না। স্রষ্টা আমাদের অস্তিত্ব দিয়েছেন এবং তিনিই আমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আমল বা কাজই হচ্ছে আমাদের একমাত্র সম্বল। সুতরাং যে স্রষ্টার হাতে আমাদের শুরু এবং শেষ, তার অস্তিত্বকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করবো? অথবা মৃত্যুর পর মানুষের পুনরুত্থানকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করবো? কেননা পুনরুত্থান বা মৃত্যুর পর পূনরায় জীবিত করা প্রথমবার সৃষ্টির করার চেয়ে অনেক সহজ কাজ। যে স্রষ্টা আমাদেরকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে, অস্তিত্ব বা প্রাণ দিয়েছেন, তিনি কি মৃত্যুর পর মানুষকে পূনরায় জীবিত করতে পারবেন না?
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
এক. মানুষকে হেদায়েতের জন্য কুরআনের একটি বিশেষ পন্থা হচ্ছে, মানুষের বুদ্ধি বিবেক এবং সহজাত প্রবৃত্তির কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া। যাতে চিন্তার মাধ্যমে মানুষ সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারে।
দুই. মানুষের জীবন আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে, আর মৃত্যু পুনরুত্থান দিবসের ইঙ্গিত বহন করে।
তিন. নিজেকে জানা, খোদাকে চেনারই ভূমিকা মাত্র। আত্মপরিচয় লাভের মাধ্যমে মানুষ স্রষ্টাকেও চিনতে পারে। কেননা সে বুঝতে পারে তার নিজস্ব বলতে কিছুই নেই, সব কিছু মহান আল্লাহর।
চার. মৃত্যুই মানব জীবনের সমাপ্তি নয়, বরং এর মাধ্যমে নতুন জীবনের সূচনা হয়।