সূরা বাকারাহ; (৬ষ্ঠ পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ; (৬ষ্ঠ পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:49:13 3-10-1403

সূরা বাকারাহ; আয়াত ১৪-১৬ (৬ষ্ঠ পর্ব)
সূরা বাকারাহ'র ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آَمَنُوا قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ

"মুনাফিকরা যখন ঈমানদারদের সংস্পর্শে আসে তখন তারা বলে-আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন তারা নিভৃতি তাদের দলপতিদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা বলে-আমরা তো তোমাদের সাথেই রয়েছি। আমরা শুধু ঈমানদারদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি।"" (২:১৪)

নিফাক বা কপটতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মুনাফিকদের ব্যক্তিত্বে দৃঢ়তা বা গাম্ভীর্যতা নেই। তারা যে পরিবেশে যায় সেই পরিবেশের রং ধারণ করে। তারা যখন মুমিনদের মাঝে যায়, তখন মুসলমান হওয়ার ভাব দেখায়। আবার যখন ইসলামের দুশমনদের সাথে মিলিত হয়, তখন তাদের সাথেও কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায়, মুমিনদের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং তাদের সুনজরে পড়ার জন্য মুমিনদেরকে নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-তামাশা করে। এই আয়াতও আমাদেরকে সতর্ক করে দেয় যাতে লোকজনের বাহ্যিক আচরণে আমরা ধোঁকা না খাই। ঈমানের দাবী করলেই তাকে মুমিন ভাবা ঠিক নয় এবং দেখতে হবে ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি কাদের সাথে ওঠা বসা করে এবং তার বন্ধুই বা কারা। কেউ মুমিন হবে আবার ইসলামের নেতাদের শত্রু ও ধর্মের দুশমনদের বন্ধু হবে-এটা মেনে নেয়া যায় না। ঈমান,ইসলামের শত্রুদের সাথে আপোষ এবং বন্ধুত্বের পরিপন্থী। ঈমানের আবশ্যিক দিক হলো- আল্লাহর দুশমনদেরকে নিজেও শত্রু মনে করা।
এই আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, ইবলিসের বংশধররাই শুধু শয়তান নয় বরং যেসব মানুষ অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে তারাও শয়তান এবং তাদেরকে এড়িয়ে চলতে হবে।
এরপর পনেরতম আয়াতে বলা হয়েছে-
اللَّهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ

"আল্লাহও তাদেরকে উপহাস করেন এবং তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের অহংকার ও অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়ায়।"" (২:১৫)

ইমাম মূসা রেজা (আ.) বলেছেন-"আল্লাহপাক ধোঁকাদানকারী বা উপহাসকারী নন। কিন্তু দুশমনদের ধোঁকা ও উপহাসের শাস্তি তিনি দেন।" বিভ্রান্তি ও হৃদয়ের অন্ধত্বের শিকার হওয়ার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? আল্লাহর নিয়ম হলো তিনি অত্যাচারী পাপীদের সময় দেন। এ সময়টিকে যদি মানুষ তওবা ও অনুশোচনার জন্য ব্যবহার করে তাহলে তা হবে তার জন্য রহমত। তা না হলে তারা আরো পাপের মধ্যে ডুবে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে। মুনাফিকদের জন্য আল্লাহর শাস্তি হলো তাদেরকে নিজেদের অবস্থায় ছেড়ে দেয়া। এর ফলে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাদের নেই কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং নেই কোন শান্তি।
এই আয়াতের শিক্ষা হলো- মানুষের গুনাহ্‌ যেরকম, আল্লাহর শাস্তিও সেরকম। তাই উপহাসের শাস্তিও উপহাস।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহপাক মুমিনদের সাহায্যকারী। মুনাফিকরা যদি মুমিনদের উপহাস করে তাহলে আল্লাহও তাদেরকে উপহাস করবেন এবং শাস্তি দেবেন।
এরপর ষোলতম আয়াতে বলা হয়েছে-
أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ

"এরাই সৎ পথের বিনিময়ে ভ্রান্ত পথ কিনে নিয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং তারা সৎ পথও পায়নি।" (২:১৬)

আমরা যে দুনিয়ায় বাস করছি, তা একটি বাজারের মত। আমাদের সবাইকে ব্যবসায়ী হিসাবে নিজেদের সম্পদ বিক্রি করতে হয়। যৌবন, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, জ্ঞান,শক্তি, জীবন এবং আল্লাহর দেয়া সব যোগ্যতাকে সম্পদ হিসাবে বিক্রি করতে হয়। এ বাজারে একদল মুনাফা অর্জন করে,অন্যদল দেউলিয়া হয়ে পড়ে। যারা দেউলিয়া হয়ে পড়ে, তারা লাভ তো দূরের কথা মূলধন পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। এ যেন অনেকটা বরফ বিক্রেতার মত। বরফ বিক্রেতা যদি তার জিনিস বিক্রি না করে তা হলে মুনাফা তো হবেই না বরং তার মূলধন পানি হয়ে যাবে এবং সে তার সর্বস্ব হারাবে।
আল্লাহপাক কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মানুষের ভালো ও মন্দ কাজকে ব্যবসার সাথে তুলনা করেছেন। যেমন সূরা সাফের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে ঈমান ও জেহাদকে লাভজনক ব্যবসা আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে- "হে ঈমানদারগণ! আমি কি এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব যা তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? আর তা হলো-তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম কর।"

সূরা বাকারাহ'র ১৬তম আয়াতে মুনাফিকদেরকে এমন বিক্রেতা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে যারা হেদায়েত বিক্রি করে ভ্রান্তি কিনে নিয়েছে। সম্ভবত: এ আয়াত থেকে বোঝানো হচ্ছে যে- মুনাফিকরা কপটতা বা নিফাকের কারণে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে হেদায়েত পাওয়ার খোদা প্রদত্ত যে শক্তি রয়েছে তা হারিয়ে ফেলে।
এই আয়াতের মূল বক্তব্য হলো-কেবল বস্তুগত লাভ-লোকসানের কথা ভাবা ঠিক নয় বরং দেখতে হবে আমাদের মন-প্রাণ ও আত্মাকে কোথায় বিক্রি করছি এবং এর বিনিময়ে কী অর্জন করছি? এই বেচা-কেনা থেকে সৌভাগ্যবান হচ্ছি নাকি বিভ্রান্তির স্বীকার হচ্ছি?
মনে রাখতে হবে, হেদায়াত এবং বিভ্রান্তি আমাদের নিজেদেরই কর্মফল। আল্লাহর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া কিছু নয় কিংবা তাঁর ইচ্ছা, মর্জি বা তকদির নয় বরং তাতে আমাদের কর্মের প্রভাব রয়েছে।
এছাড়া নিফাক বা ভণ্ডামীর শেষ পরিণতি হলো বিভ্রান্তি ও ধ্বংস। অপরপক্ষে ঈমান বা বিশ্বাস মানুষকে কল্যাণ ও সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যায়।