সূরা বাকারাহ;(১২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(১২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:3:20 3-10-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৯-৩০
সূরা বাকারাহ'র ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

"পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দেন এবং তা সপ্ত আকাশে বিন্যস্ত করেন। তিনি সব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।" (২:২৯)
মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করার পর, আমাদের আরাম আয়েশের জন্য সব উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করে তা, মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। কেননা মানুষই হচ্ছে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কাজেই জমিন ও আসমানের সকল জীবজন্তু, গাছপালা এবং সব জড় বস্তুকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ জন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-"এ ভূপৃষ্ঠের সব কিছুই মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।" এছাড়া সুরা জাসিয়ার ১৩ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে-"মহান আল্লাহ আসমান ও জমিনের সমস্ত কিছু তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন।"
মহান আল্লাহর একত্ববাদের একটি অন্যতম দলিল হচ্ছে, আকাশের অত্যন্ত জটিল ও সু-সমন্বিত গঠন প্রকৃতি। বিজ্ঞানীরা আকাশের এ জটিল সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। এ ভূপৃষ্ঠে নানা রকম উদ্ভিদ,গাছপালা,জীব-জন্তু, হাজার রকমের ফল-ফলাদি ও বহু ঐশ্বর্যের সমাহার দেখা যায়,অথচ এটি হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রহ। পবিত্র কোরআন জমিন বা ভূপৃষ্ঠের ক্ষেত্রে একবচন (আল আরদ্) শব্দটি ব্যবহার করেছে। কিন্তু আসমানের ক্ষেত্রে কোরআনের বহু আয়াতে বহুবচনের প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন বলা হয়েছে-"মহান আল্লাহ বিশেষ প্রজ্ঞা ও শক্তির মাধ্যমে সপ্ত আসমান সৃষ্টি করে তা মানুষের অধীন করে দিয়েছেন।" পবিত্র কোরআনের মতে, মানুষ যে আকাশ দেখে তা "সামায়াদ্দুনিয়া" বা দুনিয়ার আকাশ। এর উপরে আরো ছয়টি আকাশ আছে যা মানুষের দৃষ্টির নাগালের বাইরে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে-
এক. মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ বিশ্বজগত মূলত: মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে।
দুই. মহান আল্লাহ এ সৃষ্টি-জগতকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন, কাজেই আমাদের উচিত একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করা।
তিন. এ বিশ্বপ্রকৃতির কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করা হয়নি বরং প্রতিটি বস্তুকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যদিও এর অনেক কিছুর উপকারিতা সম্পর্কে মানুষ এখনও অজ্ঞ।
চার. এ পৃথিবী মানুষের জন্য। মানুষকে পৃথিবীর জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। এ পৃথিবী লক্ষ্যস্থল নয় বরং এটি অতিক্রম করার স্থান মাত্র।
এরপর এই সূরার ৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ
"যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করবো, তারা বললো আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যারা অশান্তি সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।" (২:৩০)
আগের আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য অফুরন্ত বস্তুগত ঐশ্বর্যের বর্ণনা তুলে ধরেছ্নে। আর এ আয়াতে মানুষ যে বিশেষ মর্যাদার কারণে এতসব নেয়াতম ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী হয়েছে তা বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রথম মানব সৃষ্টির পর ফেরেশতাদেরকে হযরত আদমের বিশেষ মর্যাদা ও গুণাবলী সম্পর্কে অবহিত করেন এবং এটা জানিয়ে দেন যে, মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি করা হয়েছে। এ কথা শুনে ফেরেশতারা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলল,যারা পৃথিবীতে রক্তপাত ঘটাবে এবং অশান্তি সৃষ্টি করবে,তাদেরকে কিভাবে আল্লাহর প্রতিনিধি বানানো হবে?
ফেরেশতাদের প্রস্তাব ছিল, মহান আল্লাহ যদি একান্তই পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি পাঠাতে চায় তাহলে এমন একজনকে নির্বাচন করা উচিৎ যে সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত এবং আল্লাহর একান্ত অনুগত হবে। আর এ জন্যই আদম বা মানুষের কথা শুনে ফেরেশতারা বিস্মিত হয়। কারণ মানুষের প্রবণতা এবং সহজাত গুণাবলী সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল। আর এ কারণেই ফেরেশতারা যারা সর্বক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকেন তাদের পরিবর্তে কেন মানুষকে এ মর্যাদা দেয়া হলো, তারা তা জানতে চান। ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তরে মহান আল্লাহ বলেন-"তোমরা কেবল দুর্বল দিকগুলো দেখেছো, মানুষের মর্যাদা ও বিশেষ গুণাবলী সম্পর্কে তোমরা অজ্ঞ। আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। তোমরা ফেরেশতারা সর্বক্ষণ আমার ইবাদত ও প্রশংসায় মশগুল থাকার কারণে যদি নিজেদেরকে আমার প্রতিনিধি হবার যোগ্য মনে কর, তবে জেনে রাখো মানুষের মধ্যেও এমন অনেক মহান ব্যক্তি রয়েছেন যারা তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং মর্যাদা লাভের যোগ্য।"
তবে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে,সব মানুষই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি নয়। আল্লাহর প্রতিনিধি হবার অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহ যিনি মানুষের মধ্যে নিজ রুহ ফুঁকে দিয়েছেন, তাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে আল্লাহর প্রতিনিধি হবার সব ধরনের যোগ্যতা ও সামর্থ্য রয়েছে। এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হলেন, নবী-রাসূল, ইমামগণ, শুহাদা এবং সৎ ব্যক্তিরা।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. সৃষ্টি-জগতে মানুষের মর্যাদা এত উপরে যে মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি বা মানুষকে তার প্রতিনিধি বানাবার বিষয়টি ফেরেশতাদের কাছে উত্থাপন করেছেন।
দুই. প্রতিনিধি নিয়োগের পুরো দায়িত্ব মহান আল্লাহর অন্য কারো নয়।
তিন. শাসক বা ঐশী প্রতিনিধিকে ন্যায় বিচারক হতে হবে। ফাসেক বা কলুষিত ব্যক্তি এ মর্যাদার উপযুক্ত নয়। আর এ জন্যই ফেরেশতারা বলেছিল, রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মানুষ কি করে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারে?
চার. ইবাদত কেবল মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। ফেরেশতারা আল্লাহর ইবাদত ও প্রশংসা জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে অগ্রগামী হওয়া সত্ত্বেও,পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারেনি।
পাঁচ. কিছু লোকের অনিষ্টতা ও বিভ্রান্তির কারণে, অন্যদের বিকাশ লাভের পথ রুদ্ধ করে দেয়া ঠিক নয়। মহান আল্লাহ এটা ভালো করেই জানতেন যে, এক শ্রেণীর মানুষ ভুল পথে চলবে, কিন্তু তারপরও তিনি মানুষকে তার প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেননি।
ছয়. কোন কিছু সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন করতে দোষ নেই। ফেরেশতারা আল্লাহর কাজের প্রতিবাদ জানাবার জন্য প্রশ্ন করেননি বরং নিজেদের ধারণা আরো স্পষ্ট করার জন্যই প্রশ্ন করেছিলেন।