সূরা বাকারাহ;(৪র্থ পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৪র্থ পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:58:30 3-10-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ৮-১০
সূরা বাকারাহ'র অষ্টম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- "
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آَمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ

"আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে,আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়।"" (২:৮)

সূরা বাকারাহ'র প্রথম থেকে এ পর্যন্ত ৪টি আয়াতে মুমিনদের এবং দু'টি আয়াতে কাফেরদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াত এবং পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে তৃতীয় একটি দলের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম দলের সদস্যদের মধ্যে যে ঈমানী নূর রয়েছে তা এ দলের সদস্যদের মধ্যে নেই। আবার দ্বিতীয় দলের সদস্যদের মতো ঔদ্ধত্য ও উগ্র মানসিকতা এদের মধ্যে নেই। তৃতীয় এ দলের সদস্যদের অন্তরে আসলে ঈমান নেই কিন্তু মুখে এরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু প্রকাশ করে না। এরা হচ্ছে ভীতু মুনাফিক যারা কিনা অন্তরের অবিশ্বাস ও কুফরী গোপন করে রাখে এবং বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে।
বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুশরিকরা ওই যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে পরাজয় বরণ করার পর, মক্কা ও মদীনার কিছু লোক মন থেকে ইসলামে বিশ্বাস না করলেও জান-মাল রক্ষা কিংবা মুসলমানদের মধ্যে কোন উঁচু পদে আসীন হওয়ার অভিপ্রায়ে বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে। তারা বাহ্যিকভাবে আচার-আচরণে নিজেদেরকে অন্যদের সাথে মিশিয়ে ফেলে। এটা স্পষ্ট যে, এ ধরনের লোকেরা ভীতু, কারণ কাফেরদের মত প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস তাদের মধ্যে নেই। যেকোন সামাজিক পরিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যে বহুরূপী ও দ্বিমুখী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই যারা মুখে ঈমানের কথা বলে, তারা অন্তরেও যে একই ধরনের বিশ্বাস পোষণ করে সে কথা ভাবা ঠিক নয়। এমন বহু লোক আছে যারা বাহ্যিকভাবে ধর্ম পরায়ণ মুসলমান,অথচ সবার অলক্ষ্যে তারা ইসলামের ওপর আঘাত হানে।
সূরা বাকারাহ'র ৮ নম্বর আয়াতের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো-ঈমান অন্তরের ব্যাপার, মৌখিক কিছু নয়। তাই কোন ব্যক্তিকে চেনার জন্য শুধু তার মৌখিক ব্যক্তব্যকে যথেষ্ঠ মনে করা উচিৎ নয়।
সূরা বাকারাহ'র ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ
"তারা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদেরকে প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে প্রতারিত করে না, তা তারা বুঝতে পারে না।" (২:৯)
মুনাফিকদের ধারণা তারা অত্যন্ত চালাক এবং তাদের চালাকি কেউ ধরতে পারে না। তারা নিজেদেরকে ঈমানদার হিসাবে প্রকাশ করে মনে করে মুসলমানদের মতো বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করতে পারবে এবং আল্লাহকে ধোঁকা দিতে পারবে। তারা পয়গম্বর ও ঈমানদারদেরকে ধোঁকা দিয়ে মোক্ষম সময়ে ইসলামের ওপর আঘাত হানতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তাদের অন্তরের বিশ্বাস অবিশ্বাস এবং দ্বিমুখী চরিত্র সম্পর্কে জানেন। উপযুক্ত সময়ে তিনি তাদের মুখোশ উন্মোচিত করেন এবং মুমিনদের কাছে এদের কদর্য চেহারা প্রকাশ করে দেন। কোন অসুস্থ লোক যদি চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্র মেনে না চলে চিকিৎসককে মিথ্যা কথা বলে তাহলে সে নিজেকেই ধোঁকা দিল। সে মনে করতে পারে যে মিথ্যা বলে চিকিৎসককে ধোঁকা দিতে পেরেছে। কিন্তু কার্যত সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কোরআনে বর্ণিত মুনাফিকরাও এরকম। এই বহুরূপী লোকেরা মনে করে তারা আল্লাহকে ধোঁকা দিয়েছে। আসলে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রতারিত করে থাকে।
সূরা বাকারাহ'র ৯ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার তুলে ধরা যাক।
প্রথমত: মুনাফিকরা ধোঁকাবাজ। বাহ্যিক চেহারা ও আচরণ দেখে মানুষকে চেনা যায় না। তাই মুসলমানদেরকে সতর্ক থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত: অন্যদের সাথেও প্রতারণা করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। কারণ প্রতারণার কুফলে খোদ প্রতারকই আক্রান্ত হয়।
তৃতীয়ত: মুনাফিক ব্যক্তি নিজেকে খুব চালাক বলে মনে করে, অথচ সে নির্বোধ। সে জানে না যে তার প্রতিপক্ষ আল্লাহ সবার মনের গোপন খবর রাখেন।
এর পরের আয়াতে বলা হয়েছে-
فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ
"তাদের অন্তরে রোগ আছে। এরপর আল্লাহ তাদের রোগ বৃদ্ধি করেছেন ও তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাচারী।" (২:১০)
অন্তরের অসুস্থতার যদি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে ক্রমেই তা বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় তার মনুষ্যত্ব ধ্বংস করে দেয়। 'নিফাক' বা কপটতা আত্মার অন্যতম বিপজ্জনক ব্যাধি যা আমাদের সবার মন ও আত্মার জন্য হুমকির সৃষ্টি করে। সুস্থ ব্যক্তি বহুরূপী নয়। তার দেহ ও আত্মার মধ্যে রয়েছে পূর্ণ সমন্বয়। মনে যা আছে তাই সে বলে এবং তার চিন্তার সাথে আচরণের মিল থাকে। কপটতার রোগ অন্তরে অন্যান্য রোগ ছড়িয়ে দেয়। ব্যক্তির মধ্যে হিংসা, লোভ, কৃপণতা এসব কিছু সহজেই দেখা যায় কপটতা থেকে। এই কপটতা ক্যান্সারের মত দিন দিন মুনাফিক ব্যক্তির মনে-প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআন মিথ্যাচারকে 'কপটতা' রোগের মূল উৎস বলে অভিহিত করে। মিথ্যা থেকেই এ কপটতা শুরু হয় এবং মিথ্যার মাধ্যমেই তা অব্যাহত থাকে। আর মিথ্যা বলা থেকে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন মৃত দেহ যখন পানিতে পড়ে থাকে তখন সেটা থেকে ভীষণ দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। বৃষ্টির পানিতে ওই লাশের দুর্গন্ধ মোটেও কমে না বরং পঁচে গলে ওই লাশ থেকে আরো বিকট গন্ধ বের হতে থাকে। নিফাককে ঠিক লাশের সাথে তুলনা করা যায়। এই নিফাক বা কপটতা যদি কোন ব্যক্তির মনে শিকড় গেড়ে বসে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে যত হুকুম নাযিল হোক না কেন কোন লাভ হবে না। বরং মুনাফিক ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করার পরিবর্তে বাহ্যিকভাবে ভালো ও সৎ ব্যক্তির মত আচরণ করে। ফলে তার কপটতা বাড়তে থাকে এবং এটি তার মনের মধ্যে স্থায়ী আসন গেড়ে নেয়। নিফাক শব্দটির অর্থ বেশ ব্যাপক, মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে যে কোন ধরনের অসংগতিও এই শব্দের আওতায় পড়ে। একজন মুমিন ব্যক্তির মধ্যেও এ ধরনের অসামঞ্জস্য থাকতে পারে। ইবাদতের মধ্যেও নিফাক কপটতা থাকতে পারে। যদি কোন লোক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে ইবাদত করে সেটাও এক ধরনের নিফাক। রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যত নামাজ রোজাই করুক না কেন তিনটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে সেই হবে মুনাফিক। আমানতের খিয়ানত করা, মিথ্যা কথা বলা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
প্রথমত: নিফাক হচ্ছে এক ধরনের মানসিক রোগ। সে পুরোপুরি সুস্থও নয় আবার মৃতও নয়। মুমিনও নয় আবার কাফেরও নয়।
দ্বিতীয়ত: নিফাক ক্যান্সারের মতো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদি এর চিকিৎসা না হয় তাহলে মানুষের পুরো অস্তিত্ব হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত: মিথ্যাই হচ্ছে নিফাকের উৎস। মুনাফিকদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মিথ্যা বলা।