সূরা বাকারাহ (২য় পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ (২য় পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:2:16 3-10-1403

সূরা বাকারাহ (২য় পর্ব)
আয়াত ৩-৪
সূরা বাকারাহ'র তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে-
" الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ (3)
"যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, যথাযথভাবে নামাজ পড়ে ও তাদেরকে যে জীবিকা দান করেছি তা হতে ব্যয় করে।" (২:৩)"
সূরা বাকারাহ'র দ্বিতীয় আয়াতে কোরআনের পথনির্দেশনা ও হেদায়েতকে মুত্তাকী ও পরহেজগারদের জন্য বলে মন্তব্য করা হয়েছে। পরের আয়াতগুলোয় ওই পরহেজগারদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে- "মুত্তাকী ও পরহেজগার তারাই যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে এবং তাদেরকে যে জীবিকা দেয়া হয়েছে তা থেকে দান করে।" পবিত্র কোরআন বিশ্বজগতকে দু'টি ভাগে বিভক্ত করেছে। একটি অদৃশ্য জগত যা আমরা চর্মচক্ষুতে দেখতে পাই না, আর অপরটি হচ্ছে দৃশ্যমান জগত। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জগত অনুভব করি; এই বস্তুগত জগত কেবলমাত্র চোখে দেখা যায়, কানে শোনা যায় এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় এমন কিছুর অস্তিত্বই স্বীকার করে। অথচ আমাদের সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ের পক্ষে সমস্ত সৃষ্টিজগত অনুভব করা সম্ভব নয়। যেমন আমরা নীচের দিকে বস্তুর পতন থেকে বুঝি যে পৃথিবীর আকর্ষণ শক্তি রয়েছে। অর্থাৎ আকর্ষণ শক্তিকে আমরা এর প্রভাব থেকে বুঝি। এমন অনেক লোক আছে যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করার জন্য তাঁকে চোখে দেখতে চায়। যেমন বনি ইসরাইল গোত্র হজরত মূসা(আ.) কে বলেছিল-"আল্লাহকে স্পষ্টভাবে না দেখা পর্যন্ত আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো না।" অথচ আল্লাহপাক কোন বস্তুগত কিছু নন যে তাঁকে দেখা যাবে। তবে আমরা সৃষ্টিজগতে বিরাজমান অসংখ্য নিদর্শন থেকে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হই এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনি। সত্য অনুসন্ধানী ও তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তিরা শুধু এই বস্তুগত জগতের মধ্যেই তাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখেননি। তারা অদৃশ্য জগত অর্থাৎ আল্লাহপাক, ফেরেশতাকুল, আখেরাত যা পঞ্চ-ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না তার প্রতিও বিশ্বাস রাখেন। অবশ্য ঈমান জ্ঞানের উর্দ্ধে। ঈমান হলো এমন পর্যায় যেখানে মানুষের অন্তর ও আত্মা কোন কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে, তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে,তাকে ভালবাসে। এটা স্পষ্ট যে এ ধরনের ঈমান ও বিশ্বাস থেকে সৎ কাজ উৎসারিত হবে। মূলত: ইসলামের দৃষ্টিতে আমল বা বাস্তব কর্ম ছাড়া শুধু ঈমান দিয়ে মানুষের বিকাশ ও অগ্রগতি অর্জিত হবে না। এই আয়াতে বলা হয়েছে- মুত্তাকী ও পরহেজগার ব্যক্তিরা অদৃশ্যে বিশ্বাস রাখেন। তারা নামায পড়েন এবং দান-খয়রাত করেন। নামাযের মাধ্যমে তারা আল্লাহকে স্মরণ করেন, নিজেদের মন ও আত্মার প্রয়োজন পূরণ করেন এবং লাভ করেন অনাবিল প্রশান্তি। অপরপক্ষে নিজেদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদের একটি অংশ অভাবগ্রস্তদের হাতে তুলে দিয়ে সমাজের চাহিদা পূরণ করেন, যাতে সমাজেও শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে। অবশ্য কেবল নামায পড়া যথেষ্ট নয় বরং নামায কায়েম করতে হবে। অর্থাৎ নিজেও নামায পড়তে হবে অপরকেও নামাযের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে। আযানের পরপরই উত্তম সময়ে নামায পড়তে হবে এবং নামায আদায় করতে হবে মসজিদে জামায়াতবদ্ধ হয়ে। এভাবে সমাজে নামায প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দানের ক্ষেত্রেও শুধু আর্থিক দানই ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-"যা কিছু তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে তা থেকে দান কর।" ধন-সম্পদ, শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান, বুদ্ধি এবং আল্লাহর দেয়া সব কিছু এ অন্তর্ভূক্ত।

সূরা বাকারাহ'র ৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক এবার তুলে ধরা যাক-
প্রথমত: এই বিশ্বজগত কেবল বস্তুজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এমন বহু বিষয় আছে যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। তবে আমাদের অন্তর ও বিচারবুদ্ধি সেসবের অস্তিত্ব স্বীকার করে। তাই সেসব অদৃশ্যের প্রতি আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করা উচিৎ।
দ্বিতীয়ত: ঈমান কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। মুমিন ও বিশ্বাসী ব্যক্তি কাজের লোক। অবশ্য ঐসব কাজ -যার নির্দেশ আল্লাহ তাকে দিয়েছেন।
তৃতীয়ত: আমাদের যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। তাই এর কিছু অংশ আল্লাহর জন্য দান করতে হবে। আর আল্লাহও দুনিয়া এবং আখেরাতে আমাদেরকে এর উত্তম প্রতিদান দেবেন।
এ আয়াতের আরেকটি শিক্ষণীয় দিক হলো-ইসলামকে সামাজিক ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা। ইসলাম সমাজ পরিচালনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। এ ধর্ম আল্লাহর সাথে সম্পর্কের কথাও বলে, আবার মানুষের সাথে সম্পর্কের কথাও বলে। একই সাথে সমাজের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেয়।
এরপর চতুর্থ আয়াতেও ঈমানদার মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলা হয়েছে-
وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآَخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ (4)
"যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের ওপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের ওপর যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর (পরকাল) আখেরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে।"" (২:৪)
এই আয়াতে বলা হয়েছে- মুত্তাকী ও পরহেজগার তারাই যারা তোমার ওপর এবং তোমার আগের পয়গম্বরদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি,পরকালের প্রতিও পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। আল্লাহকে চেনার একটি পথ হলো ওহী বা প্রত্যাদেশ বাণী। আর তাই তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তিরা ওহীতে বিশ্বাস করেন। এর আগের আয়াতে যেমনটি বলেছি, উপলদ্ধি ক্ষমতা শুধু মানুষের ইন্দ্রিয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বস্তুগত জগতের উর্দ্ধেও ভিন্ন জগত রয়েছে যার অস্তিত্বকে মানুষের আক্‌ল বা বিচারবুব্ধি প্রবলভাবে সমর্থন করে। তবে এই আক্‌লও নিখুঁতভাবে ওই জগত উপলদ্ধিতে সক্ষম নয়। এ জন্যে আল্লাহপাক ওহী পাঠিয়ে আমাদের ক্ষমতাকে পূর্ণ করেছেন। আমাদের আক্‌ল বা বিচারবুদ্ধি বলে-একজন স্রষ্টা আছেন। কিন্তু ওহী আমাদেরকে ওই স্রষ্টার গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা দেয়। আমাদের বিচারবুদ্ধি বলে,মানুষকে উপযুক্ত পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার জন্য মহাবিচারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর ওহী আমাদেরকে বলে, কেয়ামতের মাধ্যমেই হবে সেই মহাবিচার। অতএব দেখা যাচ্ছে, বিচারবুদ্ধি ও ওহী একে অন্যের পরিপূরক, আর ঈমানদার ব্যক্তিরা উভয় পন্থা ব্যবহার করেন। ওহী শুধু মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর ওপরই নাযিল হয়নি,বরং সব নবীর ওপরই নাযিল হয়েছে আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা ওহী। তাই পরহেজগার ও খোদাভীরু লোকদের অযৌক্তিক কোন বিদ্বেষ নেই। তারা পূর্ববর্তী নবীদের অস্বীকার করেন না, বরং নবীজীর পাশাপাশি তারা আল্লাহর সব পয়গম্বর এবং তাদের ওপর নাযিলকৃত ওহীতে বিশ্বাস করেন।
সূরা বাকারাহ'র ৪ নম্বর আয়াতে মুমিনদের আরেকটি বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। আর তা হলো আখেরাত। পরকালও একটি অদৃশ্য বিষয়। পরকাল সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হলে ওহীর ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। এর ভিত্তিতে মুমিন ব্যক্তিরা কেয়ামতে পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন এবং মৃত্যুকে মানুষের জীবনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি বলে মনে করেন না।
সূরা বাকারাহ'র এ আয়াতটি থেকে আমাদের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-
প্রথমত: সকল নবী রাসূলের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। তাই সব আসমানী গ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত: ঐশী গ্রন্থগুলোর উত্তরাধিকারী হলো মুসলিম উম্মাহ। তাই মুসলমানদের আসমানী কিতাব সংরক্ষণের চেষ্টা চালাতে হবে।(রেডিও তেহরান)