সূরা আলে ইমরান;(৭ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(৭ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:30:27 3-10-1403

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ৩৩-৩৭

সূরা আলে ইমরানের ৩৩ এবং ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى آَدَمَ وَنُوحًا وَآَلَ إِبْرَاهِيمَ وَآَلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ (৩৩) ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ((৩৪


"নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম ও নূহকে এবং ইব্রাহিম ও ইমরানের সন্তানদেরকে বিশ্বজগতের ওপর মনোনীত করেছেন।" (৩:৩৩)
"বংশানুক্রমে এরা একে অপরের সন্তান। আল্লাহ শ্রবণকারী,সর্বজ্ঞ।" (৩:৩৪)

আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনার উদ্দেশ্যে ও আল্লাহর মনোনীত ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অনেক মানুষকে মনোনীত করেছেন। এই মনোনয়ন জন্মগতভাবে অথবা পরবর্তীকালেও হয়ে থাকে। আল্লাহর নির্দেশিত দায়িত্ব পালন যাতে সহজে সম্পন্ন হয়,সে জন্য আল্লাহ জন্মগতভাবে কোন কোন মানুষকে এমন কিছু গুণাবলী দিয়েছেন যা অন্যদের মধ্যে নেই। মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য তাঁদের ঈমান,অধ্যবসায় এবং ব্যক্তিত্ব অন্যান্যদের চেয়ে উন্নতমানের। সৃষ্টিগতভাবে তাঁদেরকে উন্নত গুণাবলী বা বিশেষ সুবিধা দেয়ার কারণেই তারা সঠিক পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন এমন ধারণা করা ঠিক নয়। বরং তাঁরা নিজেরাই স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সত্যের পথ বেছে নিয়েছেন এবং সে লক্ষ্যে তাঁরা প্রচেষ্টা চালান। তাদের ঐ অবস্থা অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তুলনামূলকভাবে কঠিন ও বেশী।

 
এই আয়াতে নবীদের শ্রেষ্ঠত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে পবিত্র বংশে তাঁদের জন্ম গ্রহণের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে,শুধু হযরত ইব্রাহীম (আ.) নয়,তাঁর বংশধরদের মধ্যে হযরত মুসা,হযরত ঈসা ও হযরত মোহাম্মদ (সা.)ও পৃথিবীতে আল্লাহর মনোনীত মহাপুরুষ। মানুষকে সুপথ দেখানো ও ধর্ম-প্রচারও তাদের দায়িত্ব।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : সব মানুষই একই পর্যায়ের নয়। মহান আল্লাহ মানুষের পথ-নির্দেশনার জন্য কোন কোন মানুষকে আদর্শ হিসেবে মনোনীত করেছেন।
দ্বিতীয়ত : উত্তরাধিকার সন্তানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রেষ্ঠ গুণাবলী অর্জনের মাধ্যম।

সূরা আলে ইমরানের ৩৫ ও ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ( (৩৫فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنْثَى وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَإِنِّي أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ (৩৬)
 

"যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল,হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার গর্ভে যা আছে,তা একান্তভাবে সমর্পন করলাম যাতে সে তোমার মসজিদের খাদেম হতে পারে এবং দুনিয়ার নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হতে পারে। তাই আপনি আমার কাছ থেকে এটা কবুল করুন। আপনি সর্বজ্ঞ ও শ্রবণকারী।" (৩:৩৫)

"কিন্তু এরপর যখন ইমরান (আ.)'র স্ত্রী তাকে প্রসব করলেন,তখন তিনি বললেন,হে আমার প্রতিপালক! আমি তো কন্যা প্রসব করেছি। কিন্তু ইমরানের স্ত্রী যা প্রসব করেছে আল্লাহই সে ব্যাপারে অন্য সবার চেয়ে ভালো জানেন। সে যে পুত্রের আশা করতো,তা এই কন্যার সমান নয়। ইমরানের স্ত্রী বললেন,হে আল্লাহ আমি তাঁর নাম রাখলাম মারিয়াম। সে ও তাঁর বংশধরকে বিতাড়িত শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য তোমার আশ্রয়ে সমর্পন করলাম।" (৩:৩৬)

ইমরান (আ.)'র বংশধর সম্পর্কে বক্তব্যের পর এই আয়াতে প্রথমে ইমরান (আ.)'র কন্যা ও পরে তাঁর সন্তান হযরত ইসা (আ.) সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ কারণেই এই সূরার নাম দেয়া হয়েছে আলে ইমরান বা ইমরানের বংশধর। তাফসীর ও ইতিহাস গ্রন্থের বর্ণনামতে,ইমরান (আ.) ও জাকারিয়া (আ.) ছিলেন বনী ইসরাইলের দু'জন নবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁদের স্ত্রীগণ ছিলেন পরস্পরের বোন। কিন্তু তাদের কারোরই কোন সন্তান ছিল না। এরপর ইমরান (আ.)'র স্ত্রী আল্লাহর কাছে মানত করেন যে,আল্লাহ যদি তাকে সন্তান দান করেন,তাহলে তিনি ঐ সন্তানকে বায়তুল মোকাদ্দাসের খাদেম হিসেবে আল্লাহর রাস্তায় দান করবেন। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন। কিন্তু তাঁর কন্যা সন্তান হওয়ায় তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। কারণ,বায়তুল মোকাদ্দাসে কন্যা সেবিকা থাকার কোন দৃষ্টান্ত ছিল না। তাই পবিত্র কোরআনের আয়াতে বলা হচ্ছে- আল্লাহ প্রজ্ঞা ও কল্যাণের ভিত্তিতে সন্তান দান করেন এবং কোন্ ধরনের সন্তান দান করবেন সে ব্যাপারে তিনিই বেশী জ্ঞানী । বিবি মারিয়াম যদিও কন্যা ছিলেন তবুও তাঁর মায়ের কাঙ্ক্ষিত পুত্র-সন্তানের চেয়ে তিনি উত্তম ছিলেন। মারিয়াম ভবিষ্যতে ইসা (আ.)'র মা হবার সৌভাগ্য লাভ করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : যারা দূরদর্শী,তারা সন্তানের জন্মের আগেই সন্তানের জীবন যাপনের সঠিক পথের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং সন্তানকে সমাজ ও ধর্মের সেবায় উৎসর্গ করেন।
দ্বিতীয়ত: মসজিদের সেবা এত বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে,অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে,মহৎ মানুষেরা তাদের সন্তানদেরকে এই পবিত্র কাজে নিযুক্ত করতেন।
তৃতীয়ত: সন্তানের জন্য পবিত্র ও সুন্দর নাম নির্বাচন করতে হবে। ইমরানের স্ত্রী তার সন্তানের নাম রেখেছিলেন মারিয়াম। মারিয়াম শব্দের অর্থ হল ‘ইবাদতকারী ও সেবাপরায়ণ'।
চতুর্থত: সন্তানের সুশিক্ষার জন্য শুধু নিজেদের চেষ্টার ওপর নির্ভর করলেই চলবে না; শয়তানের কূমন্ত্রণা ও বিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছেও প্রার্থনা করতে হবে।

সূরা আলে ইমরানের ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنْبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِنْدَهَا رِزْقًا قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ (৩৭)

"এরপর তাঁর প্রতিপালক তাঁকে ভালোভাবেই গড়ে তুললেন এবং তিনি তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যখনই হযরত জাকারিয়া (আ.) মারিয়মের নামাজ পড়ার কক্ষে তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন,তখনই তার কাছে খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেতেন। তিনি বলতেন হে মারিয়াম ! এসব তুমি কোথায় পেলে? সে বলতো এগুলো আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।" (৩:৩৭)

আগের আয়াতে বলা হয়েছে,মারিয়মের মা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার সন্তানকে বায়তুল মোকাদ্দাসের খাদেম করবেন। তাই তাঁর পুত্র সন্তান হবে বলে তিনি আশা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দেন তার কন্যা সন্তানকেই আল্লাহর ঘর বায়তুল মোকাদ্দাসের সেবিকা হিসেবে গ্রহণ করা হবে। মারিয়মের পিতা তাঁর জন্মের আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এবং তাঁর মা তাঁকে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাসে নিয়ে এসে ইহুদি আলেমদের বলেন: এই শিশুকে বায়তুল মোকাদ্দাসের জন্য উপহার দেয়া হল,তাই আপনাদের কেউ এর দেখাশোনার দায়িত্ব নিন। হযরত জাকারিয়া (আ.) এই শিশুর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মারিয়াম জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে বড় হল। কিন্তু সে আল্লাহর ইবাদতে এমনভাবে মশগুল হল যে,তাঁর খাবারের চিন্তা করারও সময় ছিল না। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার আসত। যখনই জাকারিয়া মারিয়মের ইবাদতের ঘরে যেতেন,তখনই সেখানে বিশেষ খাবার দেখতে পেতেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : যদি কেউ আল্লাহর জন্য কোন কাজ করে,তাহলে আল্লাহ সেই কাজের মধ্যে ক্রমেই বরকত বাড়াতে থাকেন এবং আল্লাহ ক্রমেই কাজের বিস্তার ও দেখা শোনা করেন।
দ্বিতীয়ত : নারীও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এতদূর উন্নতি লাভ করতে পারে যে,আল্লাহর নবী পর্যন্ত তাতে বিস্মিত হন।
তৃতীয়ত : আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে আমাদের ভালভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত। আমরা আল্লাহর ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব ভালভাবে পালন করলে আল্লাহও আমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা সহজ করে দেবেন।