সূরা বাকারাহ;(৬৫তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৬৫তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:44:6 3-10-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৬০-২৬৩

গত পর্বে আমরা উজাইর নবীর ঘটনা থেকে এটা জানতে পেরেছি যে,কিভাবে আল্লাহ তাঁর মৃত্যুর একশ বছর পর পুণরায় তাকে এ দুনিয়ায় জীবিত করেছিলেন। এ ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ কিয়ামত বা বিচার দিবসে মৃত মানুষদেরকে কিভাবে জীবিত করবেন সেটাই তাঁকে দেখিয়েছিলেন। আজ আমরা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-র জীবনের একটি ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব। হযরত ইবরাহীম (আঃ) একদিন নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় এক মৃত জন্তুকে দেখলেন যার শরীরের কিছু অংশ পানিতে এবং কিছু অংশ ডঙ্গায় পড়ে আছে,আর অন্যান্য জন্তু ঐ মৃত জন্তুটির গোস্ত খাচ্ছে। ইবরাহীম (আঃ) এ ঘটনাটি দেখে ভাবলেন,যদি মানুষের শরীরের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে,তাহলে মানুষের দেহ অন্যান্য জন্তুর দেহে বিলিন হয়ে যাবে,সে ক্ষেত্রে কিয়ামতের দিন এই ব্যক্তি কিভাবে তার আগের শরীর নিয়ে জীবিত হবে? ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন আল্লাহর রাসুল। পুনরুত্থানের প্রতি বিশ্বাস রাখা সত্ত্বেও তিনি এধরনের মৃত ব্যক্তির জীবিত হওয়ার ধরণ বা প্রক্রিয়া দেখিয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে অনুরোধ করেন। সুরা বাকারার ২৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহর সাথে তাঁর সংলাপের বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে।

 

সুরা বাকারাহ'র ২৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِي الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي قَالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلَى كُلِّ جَبَلٍ مِنْهُنَّ جُزْءًا ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتِينَكَ سَعْيًا وَاعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

 

"যখন ইবরাহীম বলল,হে আমার প্রতিপালক আপনি কিভাবে মৃতদের জীবিত করবেন তা আমাকে দেখিয়ে দিন। এর উত্তরে শুনল,তুমি কি বিশ্বাস কর না ? উত্তরে তিনি বললেন নিশ্চয়ই (বিশ্বাস করি),কিন্তু আমি আমার মনকে প্রশান্ত করার জন্য তা দেখতে চাই। এরপর আল্লাহ বললেন,চারটি পাখি নাও এবং তাদের গোশত কেটে টুকরো টুকরো করে মিশিয়ে ফেল এরপর প্রত্যেক পাহাড়ের ওপর ওদের এক এক খণ্ড রেখে তাদের নাম ধরে ডাক,তারা তোমার কাছে দৌড়ে আসবে। জেনে রাখ যে,আল্লাহ অতুলনীয় শক্তির অধিকারী ও বিজ্ঞানময়।" (২:২৬০)

 

হযরত ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চারটি পাখি জবাই করে সেগুলোর গোশতের টুকরো ভালোভাবে মিশিয়ে ফেল্লেন। এরপর তিনি সেগুলোর টুকরো দশটি পাহাড়ের চূড়ায় রেখে পাখিগুলোর নাম ধরে ডাকলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় পাখিগুলোর বিচ্ছিন্ন গোশত বিভিন্ন স্থান থেকে এসে এক জায়গায় জড়ো হলো এবং আগের মতই জীবিত হয়ে হযরত ইবরাহীমের কাছে আসল। এভাবে হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রশ্নের জবাব পেলেন।

 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

প্রথমত : মানুষের পুনরুত্থান হবে স্বশরীরে,প্রকৃতির নিয়মে আল্লাহর কতৃত্ব সর্বময়। তাই কারো শরীরের বিভিন্ন অংশকে জড়ো করা এবং আগের মতই মানুষের শরীর গঠন করে পুনরূত্থান বা বিচার দিবসে হাজির করা আল্লাহর জন্য কঠিন কোন কাজ নয়।

দ্বিতীয়ত : যুক্তি ও প্রমান বিবেককে কোন কিছু মেনে নিতে বাধ্য করে ,কিন্তু মানুষের মন শুধু যুক্তির মাধ্যমে প্রশান্ত হয় না। তাই আমাদে কে পূর্ণ ও আন্তরিক ভাবে বিশ্বাসী হওয়ার জন্য আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহগুলো এবং তাঁর শক্তির দিকটি ভাবতে হবে,তা বুঝার চেষ্টা করতে হবে।

এরপর ২৬১তম আয়াতে বলা হয়েছে-

 

مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِئَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

 

"যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে,তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত,যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ'করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল,সর্বজ্ঞ।" (২:২৬১)

 

এই আয়াত থেকে পরবর্তী ১৪টি আয়াতে দান-খয়রাত ও সুদ বর্জনের ওপর আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ বিভিন্ন উপায়ে বা পেশার মাধ্যমে টাকা উপার্জন করে। অনেক সময় বন্যা,ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমাজের অনেক মানুষ তাদের আয়-উপার্জন হারিয়ে ফেলে । এদের রক্ষা করা বা তাদেরকে সহায়তা করার উপায় কি? এই সব মানুষ কি চিরকাল দরিদ্র বা আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে থাকবে? আর তারা যদি সমাজের ধনী ও সচ্ছলদের কাছে সাহায্য কামনা করে তাহলে তাদেরকে কি সুদভিত্তিক টাকা দিয়ে সারাটা জীবন ঋণের নিচে আটকে দেয়া ঠিক হবে? নাকি তাদেরকে সুদ মুক্ত ঋণ দিয়ে মানবিক সাহায্য দেয়া উচিত? এই সুদ হচ্ছে একটি সামাজিক সমস্যা যা অর্থনৈতিক রোগগুলোর অন্যতম। কারণ,অর্থশালী লোক সুদের মাধ্যমে আরো অর্থশালী এবং দরিদ্ররা সুদ নেয়ার ফলে আরো দরিদ্র হয়। আর এভাবে সমাজে ধনী ও গরীবের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইসলাম সুদকে হারাম করেছে এবং মুসলমানদের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলার জন্য তাদেরকে আল্লাহর পথে দান করতে উৎসাহ দিয়েছে। যারা সুদ নেয়ার জন্য ঋণ দেয়,তারা তাদের সম্পদ বাড়ানোর জন্যই ঋণ দেয়। তাই আল্লাহ এ আয়াতে বলেছেন,আল্লাহর পথে দান খয়রাত করলে তাতে মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পায়,এমনকি তা সাতশ' গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আর এভাবে একদিকে দানশীল ধনী ব্যক্তির সম্পদ বাড়ছে,একই সাথে দানকৃত সম্পদ সমাজের প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখছে।

 

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

প্রথমত : আল্লাহর পথে অর্থাৎ গরীবদের সাহায্যের জন্য দান-খয়রাত পবিত্র নিয়তে ও হালল সম্পদ থেকে করতে হবে।এরকম দান-খয়রাতে কারো সম্পদের ক্ষতিতো হয়ই না,বরং এর ফলে আল্লাহর রহমতে দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহর দয়ার কোন সীমা নেই। যে কেউ তার প্রচেষ্টা ও যোগ্যতা অনুযায়ী আল্লাহর রহমত লাভ করে।

এরপর ২৬২ ও ২৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُونَ مَا أَنْفَقُوا مَنًّا وَلَا أَذًى لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (২৬২) قَوْلٌ مَعْرُوفٌ وَمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِنْ صَدَقَةٍ يَتْبَعُهَا أَذًى وَاللَّهُ غَنِيٌّ حَلِيمٌ

"যারা আল্লাহর পথে নিজের ধনসম্পদ ব্যয় করে এবং যা ব্যয় করে,তার কথা বলে বেড়ায় না এবং (ঐ দানের বদলে কাউকে) কষ্ট দেয় না,তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার আছে এবং তাদের জন্য কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।" (২:২৬২)

"যে দানের ফলে মানুষকে কষ্ট দেয়া হয়,সেই দানের চেয়ে মিষ্টি কথা বলা এবং ক্ষমা শ্রেয়। আল্লাহ তা'লা সম্পদশালী,সহিঞ্চু।" (২:২৬৩)

আগের আয়াতে মানুষকে আল্লাহর পথে দান-খয়রাতের জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে। এই আয়াতে দান-খয়রাতের সঠিক পদ্ধতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে,যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গরীবদের কিছু দান করতে চায়,তবে প্রতিদানের আশা করা উচিত হবে না এবং দান করার পর তাদেরকে খোঁচানো বা মন্দ আচরণের মাধ্যমে কষ্ট দেয়া যাবে না। কারণ,মানুষ যা গরীবকে দান করে তা-তার নিজের সম্পদ নয়। তাই আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ দান করে তার প্রতিদান আশা করা ঠিক নয়। বরং বঞ্চিত ব্যক্তি ধনীর দান গ্রহণ করে ধনীকে পরকালে সওয়াব অর্জনের সুযোগ করে দেয়ায় এর প্রতিদান আশা করতে পারে। আসলে দান-খয়রাত করে মানুষের বাহবা বা প্রতিদান চাওয়া হলে তা আল্লাহর পথে দান বলেই বিবেচিত হয় না। কখনও দান করে পরে তা নিয়ে অনুতপ্ত হওয়া উচিত নয়। কারণ,আল্লাহ দান-খয়রাতকারীর শুভ পরিণামের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। এমনকি অর্থ সম্পদ দান না করেও যারা গরীব দুঃখীদের প্রতি ভালো কথা ও সহৃদয় ব্যবহার করে,আল্লাহ তাদের এ কাজকে দান করে বঞ্চিতদের কষ্ট দেয়ার চেয়ে উত্তম বলে উল্লেখ করেছেন।

 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

প্রথমত : আমরা কোন কাজ যদি আল্লাহর জন্য শুরু করি তাহলে ঐ কাজের জন্য যেন অহংকার করে কিংবা তার পার্থিব প্রতিদান আশা করে তা যেন নষ্ট করে না দেই সেদিক লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ,এসব বিষয় ঐ ভালো কাজকে মূল্যহীন করে ফেলে।

দ্বিতীয়ত : মুমিন ব্যক্তির সম্মান রক্ষা করা তার শারীরিক ও বৈষয়িক চাহিদা মেটানোর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাই কোন মুমিন বা বিশ্বাসী ব্যক্তির সম্মান যাতে ক্ষুন্ন না হয়,সে দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত।