সূরা বাকারাহ;(৬২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৬২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 22:41:10 3-10-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৪৯-২৫২

সূরা বাকারাহ'র ২৪৯তম আয়াতে আল্লাহপাক বলা হয়েছে-

فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوتُ بِالْجُنُودِ قَالَ إِنَّ اللَّهَ مُبْتَلِيكُمْ بِنَهَرٍ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلَيْسَ مِنِّي وَمَنْ لَمْ يَطْعَمْهُ فَإِنَّهُ مِنِّي إِلَّا مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةً بِيَدِهِ فَشَرِبُوا مِنْهُ إِلَّا قَلِيلًا مِنْهُمْ فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ قَالُوا لَا طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو اللَّهِ كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ

"এরপর তালুত যখন সেনাদলসহ বের হলো তখন সে বলেছিল নিশ্চয়ই আল্লাহ একটি নদী দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করবেন। এরপর যারা ঐ নদী থেকে পানি পান করবে তারা আমার দলভূক্ত নয়। আর যারা তার স্বাদ গ্রহণ করবে না,তারা আমার দলভূক্ত । কিন্তু যে লোক হাতের আঁজলা ভরে সামান্য খেয়ে নেবে তার দোষ অবশ্য তেমন গুরুতর হবে না। ( কিন্তু নদীর কাছে পৌঁছার পর) অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া সবাই নদী থেকে পানি পান করলো। তালুত ও তার বিশ্বাসী সঙ্গীরা যখন নদী অতিক্রম করলো,তখন তারা বলেছিল যে জালুত ও তার সেনাদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি ও সাধ্য আজ আমাদের নেই। কিন্তু যারা জানতো যে,নিশ্চয়ই একদিন আল্লাহর সাথে মিলিত হতে হবে,তারা বলেছিল আল্লাহর আদেশে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলের ওপর জয়ী হয়েছে এবং আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।" (২:২৪৯)

আগের পর্বে আমরা বলেছি যখন আল্লাহ তালুতকে বনি ইসরাইলীদের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করলেন তখন তারা তা মেনে নিতে রাজী হয়নি । তারা যুদ্ধ থেকে পালানোর জন্য অজুহাত তুলতে লাগলো। পরবর্তী পর্যায়ে একদল তালুতের সেনাপতিত্ব মেনে নিয়ে তার সাথে শহরের বাইরে রওনা হয়। কিন্তু তালুত তাদের আনুগত্যের মাত্রা যাচাই করার জন্য একটি নদীকে পরীক্ষার মাধ্যম করে বলেন,আমার প্রকৃত সহযোগী তারাই যারা তৃষ্ণা সত্ত্বেও প্রাণভরে ঐ নদীর পানি পান করবে না। শুধু হাতের তালু দিয়ে পানি নিয়ে গলা ভেজাবে মাত্র। এই আয়াতে বলা হয়েছে,বেশি সংখ্যক লোকই ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। পানি দেখে তারা তাদের তৃষ্ণা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। আর তৃতীয় পর্যায়ে তারা শত্রুদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেয় এবং জালুতের সেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করে। শুধুমাত্র প্রকৃত ঈমানদাররা যারা কিনা আল্লাহর প্রেমের মাধ্যমে তাদের মনোবলকে সুদৃঢ় রেখেছিল তারা প্রচণ্ডভাবে রুখে দাঁড়ায় এবং শত্রুসেনাদের বিশাল সংখ্যা দেখেও মোটেও ভীত হয়নি ।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : খাবার বস্তু ও পানীয় অনেক সময় পরীক্ষার বিষয় হয়ে ওঠে। এই ইসলামী নেতৃত্বের প্রতি কে অনুগত আর কে অনুগত নয় তা পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহর প্রতিশ্রুতিগুলো ও পরকালের প্রতি ঈমান সমস্যা ও বাধা-বিপত্তির মোকাবেলায় মানুষের ক্ষমতা ও শক্তিকে বৃদ্ধি করে।

তৃতীয়ত : যুদ্ধ বা আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ও দৃঢ়তা অব্যাহত রাখা জরুরী। তালুত ও জালুতের ঘটনায় দেখা গেছে,অত্যাচারী তাগুতি সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্লোগান দেয়ার জন্য বহু লোক থাকা সত্ত্বেও খুব কম সংখ্যক লোকই শত্রুর বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়ে ছিল।

এরপরের আয়াত অর্থাৎ ২৫০তম আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَمَّا بَرَزُوا لِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ قَالُوا رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

"তারা (ঈমানদাররা) যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে জালুত ও তার সেনাবাহিনীর মুখোমুখী হলো,তখন তারা বলল : হে আমাদের প্রতিপালক ! আমাদেরকে ধৈর্য ও দৃঢ়তা দান কর এবং অবিশ্বাসী দলের উপর আমাদেরকে বিজয়ী কর।" (২:২৫০)

 

উপরে বলা হয়েছে,ইহুদীরা জালুতের সেনাদেরকে দেখে ভয় পেয়ে যায় এবং শুধুমাত্র প্রকৃত ঈমানদাররাই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়। তবে প্রকৃত ঈমানদাররাও এটা জানতো যে,আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এত শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ওপর বিজয় লাভ সম্ভব নয়। তাই তারা আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করে এবং যুদ্ধের তীব্রতা ও শত্রুর মোকাবেলায় দৃঢ়তা ও ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দেয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে।

 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

প্রথমত : চেষ্টা ও সাধনা ছাড়া শুধু দোয়া কার্যকরী হয় না। তালুতের বিশ্বস্ত সঙ্গীরা যুদ্ধের ময়দানে এসে তারপর বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করেছিল।

দ্বিতীয়ত : ঈমানদার বা বিশ্বাসীদের লক্ষ্য হলো,মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়,এক জাতির ওপর অন্য জাতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয়। তাই তালুতের সঙ্গীরা অবিশ্বাসীদের ওপর বিজয় প্রার্থনা করে।

 

এ সূরার ২৫১ ও ২৫২ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

فَهَزَمُوهُمْ بِإِذْنِ اللَّهِ وَقَتَلَ دَاوُودُ جَالُوتَ وَآَتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَهُ مِمَّا يَشَاءُ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ (২৫১) تِلْكَ آَيَاتُ اللَّهِ نَتْلُوهَا عَلَيْكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ

"এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় তালুত ও তার সঙ্গীরা শত্রুদেরকে পরাজিত করেছিল এবং দাউদ জালূতকে হত্যা করলো। পরে আল্লাহ দাউদকে রাজত্ব ও প্রজ্ঞা দান করেছিলেন এবং তাকে যা চাইলেন তাই শেখালেন। আল্লাহ যদি মানব জাতির এক দলকে অন্যদল দিয়ে দমন না করতেন,তবে নিশ্চয়ই পৃথিবী অশান্তিপূর্ণ হত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি অনুগ্রহশীল। (২:২৫১)

"(হে পয়গম্বর!) এ সবই হলো আল্লাহর নিদর্শন,যা আমি সঠিকভাবে আপনাকে পড়ে শোনাচ্ছি এবং নিশ্চয়ই আপনি রাসূলদের অন্তর্ভূক্ত।" (২:২৫২)

 

মোমেনদের প্রচেষ্টা ও আল্লাহর সাহায্যের ফলে অবশেষে অতি অল্প সংখ্যক বিশ্বাসী সুসজ্জিত বিশাল বাহিনীর ওপর জয়লাভ করে। দাউদ নামের বিশ্বাসী ও সাহসী এক যুবক শত্রুদলের সেনাপতি জালুতকে হত্যা করে। এরপর আল্লাহ দাউদের সাহসিকতা ও ঈমানের পুরস্কার হিসেবে তাঁকে নবী পদে উন্নীত করেন এবং তাঁকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেন। আল্লাহ দাউদের পুত্র সোলায়মানকেও নবুয়্যত দান করে দাউদকে সম্মানিত করেছিলেন। পাঁচটি আয়াতে উল্লেখিত এই ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো,ঈমানদারদের মনোবল শক্তিশালী করা। সেই সাথে এসব আয়াত এক শ্রেণীর মুসলমানের জন্যেও সাবধানবাণী হিসেবে বিবেচিত,যারা নিজ শহর মক্কা ও তাদের ঘরবাড়ী ত্যাগ করেছিল। তারা সংখ্যায় ছিল অল্প এবং তারা ধন-সম্পদের অধিকারী ছিল না,কিন্তু তালুতের যুগের ইহুদীদের মত তারাও মক্কার মুশরিকদের কাছে বলতো আমাদের নবী হবার জন্য মোহাম্মদ কোন দিক থেকে বেশী যোগ্য?

এবারে এই আয়াতের মূল শিক্ষণীয় দিকগুলো একে একে উল্লেখ করছি।

প্রথমত : কেউ যখন যোগ্যতা ও প্রতিভার প্রকাশ ঘটায় শুধুমাত্র তখনই সে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করে। দাউদ আল্লাহর পথে সাধনার মাধ্যমেই নবুওতের মর্যাদা লাভ করেছিলেন।

দ্বিতীয়ত : যদি ধর্মের শত্রুর বিরূদ্ধে জিহাদ ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য না হতো তাহলে পৃথিবী অবিচার ও অশান্তিতে ভরে উঠতো,তাই আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবার ব্যাপারে দুঃখ থাকা উচিত নয়।

তৃতীয়ত : এই ঘটনা থেকে আমরা এটাও শিখতে পারি যে,বিজয় লাভের জন্য কতগুলো শর্ত হলো,শক্তিশালী ও যোগ্য নেতা থাকা,আল্লাহর ওপর নির্ভর করা বা ভরসা রাখা,ধৈর্য ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হওয়া এবং যুদ্ধের উদ্দেশ্যটা পরিস্কার থাকা যেমন-কোন জাতির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নয় বরং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করা।

এই দুই আয়াত থেকে আমরা যা যা শিখলাম তার সার-সংক্ষেপ হলো-

প্রথমতঃ সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে কুসংস্কার ও অজ্ঞতাপ্রসূত প্রথাগুলো নির্মূল করা নবীগণের অন্যতম দায়িত্ব।

দ্বিতীয়তঃ পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব স্বামীর। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বামী স্ত্রীকে উত্যক্ত করা ও কষ্ট দেয়ার কোন অধিকার রাখেনা।

তৃতীয়তঃ প্রয়োজনের তাগিদে ইসলাম তালাককে স্বীকৃতি দেয়,কিন্তু স্ত্রীকে অস্পষ্ট অবস্থার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখাকে কোন অবস্থাতেই মেনে নেয় না। অবশ্য ইসলাম এমন তালাককে গ্রহণ করে যা পরিবারের জন্য কল্যাণকর। স্বামী বা স্ত্রীর খামখেয়ালীপনা প্রসূত তালাককে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না। এ ধরনের তালাকের জন্য কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।