সূরা আলে ইমরান;(২৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(২৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 22:34:43 3-10-1403

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১৪৩-১৪৮

সূরা আলে ইমরানের ১43 নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-


وَلَقَدْ كُنْتُمْ تَمَنَّوْنَ الْمَوْتَ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَلْقَوْهُ فَقَدْ رَأَيْتُمُوهُ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ (১৪৩)

"হে ওহুদ যুদ্ধের মুজাহিদবৃন্দ! তোমরা শত্রুদের সম্মুখীন হবার আগে আল্লাহর পথে শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিল। তাহলে এখন তোমরা মৃত্যুকে কেন অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে দেখছ?" (৩:১৪৩)

বদর যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হয়েছিল। এ যুদ্ধে একদল মুসলমান শহীদও হয়েছিল। তখন মুসলমানদের কেউ কেউ বলতেন,হায়! আমরাও যদি বদর যুদ্ধে শহীদ হতে পারতাম। কিন্তু তারাই ওহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের লক্ষণ দেখে মহানবী (সা.)কে ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই আয়াতে এসব মুসলমানের সমালোচনা করে বলা হয়েছে,যুদ্ধের ময়দানে যখন মৃত্যুকে কাছে দেখতে পেলে তখন কেন দর্শক বনে গেলে এবং কেন আল্লাহর রাসূল (সা.)কে সহায়তা করলে না?

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : আমরা যেন নিজেদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার ধোঁকায় না পড়ি। কারণ,কর্মক্ষেত্রে আমরা খোদায়ী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারব কিনা তা জানি না।

দ্বিতীয়ত : অনেক মানুষই ঈমানদার হবার দাবী করেন। কিন্তু খুব কম মানুষই ঈমানের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকেন বা বিপদের সময়ও ঈমানের ওপর অটল থাকেন।

সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ (১৪৪)

"মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল ব্যতীত অন্য কিছু নন। তাঁর আগেও অনেক রাসূল গত হয়েছেন। তাই যদি তাঁরও মৃত্যু হয়,তবে কি তোমরা পেছনে ফিরে যাবে? যারা পেছনে ফিরে যায় তারা আল্লাহর কোন ক্ষতিই করতে সক্ষম নয়। শীঘ্রই আল্লাহ কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।" (৩:১৪৪)

ওহুদ যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.)'র শাহাদাতের গুজব উঠেছিল। শত্রু সেনাদের আঘাতের ফলে রাসূল (সা.)এর কপাল থেকে রক্ত এমনভাবে গড়িয়ে পড়ছিল যে শত্রুদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে ওঠে 'মুহাম্মাদ' নিহত হয়েছে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়ায় কাফেররা উৎফুল্ল হয় এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কোন কোন মুসলমানের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং কেউ কেউ পালিয়ে যান। অবশ্য এ সময় অনেক মুসলমান তাদের উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে বলে ওঠেন মুহাম্মাদ যদি নাও থাকেন,তাঁর পথ ও তার খোদা তো জীবিত,কেন পালিয়ে যাচ্ছ? আল্লাহ এই আয়াতে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলছেন,তোমাদের আগেও অনেক নবী গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা মারা যাওয়ায় তাঁদের অনুসারীরা ধর্মের পথ থেকে ফিরে যায়নি । তাহলে তোমরা কেন মুহাম্মাদ ( সা.) এর মৃত্যুর ফলে এত তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে গেছ এবং পালানোর চিন্তা করছ? অথচ তোমাদের নবী এখনও জীবিত এবং তাঁর মৃত্যুর কথা শত্রুদের গুজবমাত্র। মহানবী (সা.)কে পাওয়ার নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা কি এটা যে এত সহজেই তার ধর্ম থেকে ফিরে যাবে?

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : অন্যান্য মানুষের মত নবীগণও প্রাকৃতিক বিধান তথা জীবন ও মৃত্যুর আওতাধীন। তাই নবীগণ চিরদিন বাঁচবেন এমন আশা করা উচিত নয়।

দ্বিতীয়ত : নবীগণের বয়স বা পার্থিব জীবন সীমিত। কিন্তু তাদের আদর্শ সীমিত নয়। আমরা আল্লাহর ইবাদত করব,কোন ব্যক্তির ইবাদত করব না। তাই ইসলাম ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কোন অবকাশ নেই।

তৃতীয়ত : মানুষ আল্লাহর ধর্ম থেকে দূরে সরে গেলে তাতে আল্লাহর ক্ষতি হয় না। কারণ,আল্লাহ মানুষের ইবাদত ও বন্দেগীর মুখাপেক্ষী হওয়া তো দূরের কথা,মানুষের কাছে কোনো ব্যাপারেই মুখাপেক্ষী নন।

চতুর্থত : আমাদের ঈমানকে এতটা দৃঢ় করা উচিত যে,মহানবী (সা.)'র মত ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতেও যেন ঈমান মোটেই নড়বড়ে না হয়।

সূরা আলে ইমরানের ১৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تَمُوتَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتَابًا مُؤَجَّلًا وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الْآَخِرَةِ نُؤْتِهِ مِنْهَا وَسَنَجْزِي الشَّاكِرِينَ (১৪৫)

"আল্লাহর আদেশ ছাড়া কারো মৃত্যু হয় না। এটা এমন এক পরিণতি যা সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ আছে। যে কেউ ইহলোকের প্রতিদান কামনা করে আমি তাকে তা থেকে দান করি এবং যে কেউ পরকালের প্রতিদান কামনা করে আমি তাকে তা থেকেই দিয়ে থাকি। আমি কৃতজ্ঞদেরকে অচিরেই পুরস্কৃত করব।" (৩:১৪৫)

যুদ্ধ বা জিহাদের ময়দান থেকে মানুষের পালিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মৃত্যুর ভয়। তাই এ আয়াতে বলা হচ্ছে- মানুষের মৃত্যু তো একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাধীন। হয়তো অনেক বৃদ্ধ মানুষও জিহাদের ময়দান থেকে বিজয়ী হয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পারে,আবার অনেক যুবকও ভীত হয়ে পালিয়ে যাবার পর রণাঙ্গনের বাইরে কোন দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারে। এরপর কোরআন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মনের ইচ্ছার কথা উল্লেখ করে বলছে- অনেকে গনীমত বা যুদ্ধে পাওয়া সম্পদের অংশীদার হবার জন্যেই যুদ্ধে অংশ নেয় এবং তা পেয়েও যায়। আবার অনেকে পরকালের পুরস্কার পাবার আশায় বা শাহাদাতের মর্যাদা লাভের জন্যেই জিহাদে অংশ নেয় এবং এদের উদ্দেশ্যও পূরণ হয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব নয়। যুদ্ধে গেলেই মানুষ মারা যায় না। আর যারা ঘরে বসে থাকে,তারাও সবাই বেঁচে থাকে না।

দ্বিতীয়ত: মৃত্যু আমাদের ইচ্ছার অধীন নয়। তবে আমাদের তৎপরতা আমাদেরই ইচ্ছার অধীন। নশ্বর বা ধ্বংসশীল জগতকে আমাদের কাজকর্মের লক্ষ্য না করে পরকালকেই আমাদের কাজের লক্ষ্য করা উচিত। পরকালের জগত অসীম। মৃত্যু তার সূচনা মাত্র। সমাপ্তি নয়।

সূরা আলে ইমরানের ১৪৬,১৪৭ ও ১৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ (১৪৬) وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَنْ قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ (১৪৭) فَآَتَاهُمُ اللَّهُ ثَوَابَ الدُّنْيَا وَحُسْنَ ثَوَابِ الْآَخِرَةِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ((১৪৮

"কত নবী যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে ছিল তাঁদেরই একনিষ্ঠ বহু অনুসারী। কিন্তু আল্লাহর পথে চলার জন্য যেসব বিপদ ও সংকট এসেছে তাতে তারা কখনও হতাশ হয়নি,বিচলিত হয়নি এবং শত্রুদের কাছেও আত্মসমর্পণ করেনি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।" (৩:১৪৬)

"তারাতো এ কথা ছাড়া আর অন্য কিছুই বলেনিঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপ ক্ষমা করুন। কাজে কর্মে আমাদের বাড়াবাড়ি মাফ করে দিন। আমাদের পদক্ষেপগুলো সুদৃঢ় করে দিন এবং বিজয়ী করুন।" (৩:১৪৭)

"এরপর আল্লাহ তাদেরকে এ দুনিয়ায় পুরস্কৃত করেছেন এবং পরকালেও তাদেরকে উত্তম পুরস্কার দিয়েছেন। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।" (৩:১৪৮)

আগের কয়েকটি আয়াতে ওহুদ যুদ্ধের বিপর্যয়ে হতাশ হওয়ায় এবং পালিয়ে যাওয়ায় কোন কোন মুসলমানকে তিরস্কার করা হয়েছে। এই আয়াতে পূর্ববর্তী নবীদের ইতিহাস উল্লেখ করে বলা হয়েছে- তোমাদের আগেও অনেক নবী আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের অনেক মুমিন সঙ্গী যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত হয়েছিলেন। কিন্তু বিপর্যয় সত্ত্বেও তারা ধর্ম থেকে দূরে সরে যাননি এবং কোন দুর্বলতা প্রদর্শন করেননি। তাহলে তোমরা কেন তাদের অনুসারী হবে না? কেন ইসলামের নবী (সা.)কে যুদ্ধের ময়দানে বিপুলসংখ্যক শত্রুর সামনে একা রেখে পালিয়ে যাচ্ছ? এরপর কোরআন জিহাদের বীর পুরুষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে বলছে- তারা এতসব কঠোর চেষ্টা সাধনা সত্ত্বেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনাকে কখনও ভুলে যাননি বরং তারা আল্লাহর কাছে নিজেদের কৃতকর্মের দোষ-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে শত্রুদের ওপর বিজয় প্রার্থনা করেছেন। আর আল্লাহও তাদের বিজয়ী করেছেন। দুনিয়ায় তারা যুদ্ধলব্ধ সম্পদও পেয়েছেন,অন্যদিকে তারা পরকালেও পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

প্রথমত : যারা অতীতে সত্যের সংগ্রামে অবিচল ছিলেন সেইসব মহাপুরুষের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে হতাশা ও দুর্বলতা দূর করতে হবে।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহর প্রতি ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাসই যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়তা এবং প্রতিরোধের শক্তি যোগায়।

তৃতীয়ত : আল্লাহর নবীরা আরাম-আয়েশে নয় বরং জিহাদ ও সংগ্রামের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন।

চতুর্থত: দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা প্রদর্শন ও অটল-অবিচল থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। সাফল্য ও পরাজয় এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়।