সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১৩৭-১৪২
সূরা আলে ইমরানের ১৩৭ ও ১৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ سُنَنٌ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُروا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ (১৩৭) هَذَا بَيَانٌ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِلْمُتَّقِينَ (১৩৮)
"হে মুসলমানরা,তোমাদের আগেও মানবজাতিকে বহু বিধান দেয়া হয়েছিল। অতএব,পৃথিবীতে বিচরণ কর,লক্ষ্য কর মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের পরিণাম কী হয়েছে?" (৩:১৩৭)
"এটা মানব জাতির জন্য স্পষ্ট ব্যাখ্যা আর কেবল পরহেজগারদের জন্য পথপ্রদর্শক ও উপদেশ।"(৩:১৩৮)
মানুষকে পথনির্দেশনা ও শিক্ষা দেয়ার জন্য অতীতের ইতিহাস তুলে ধরা কোরআনের অন্যতম রীতি। বিশ্ব শুধু বর্তমান সময়ের মধ্যেই সীমিত নয়। আমাদের আগেও পৃথিবীতে অনেক মানুষ এসেছে এবং তারা বিদায়ও নিয়েছে। তাদের ইতিহাস ও পরিণতি আজকের যুগের মানুষের জন্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষা। কারণ,পৃথিবী খোদার রীতি ও স্থায়ী বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়। মানব জাতির ইতিহাস জানা ছাড়া খোদার এইসব বিধান জানা সম্ভব নয়। তাই কোরআন আমাদেরকে দেশ ভ্রমণের উপদেশ দিচ্ছে যাতে আমরা অতীতের সৎ ও পাপী মানুষের পরিণতি উপলব্ধি করি এবং সঠিক পথ বেছে নিয়ে অন্যদের তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি না করি।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলাম অতীত সভ্যতার নিদর্শন ও ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তবে শুধু ভ্রমণ নয়,ভ্রমণের পাশাপাশি চিন্তা ভাবনারও আহবান জানিয়েছে।
দ্বিতীয়ত : উত্থান ও পতনের তথা সম্মান ও অবমাননার চালিকাশক্তি সব যুগে একই ছিল। ঐসব চালিকাশক্তি বা কারণ জানা বর্তমান সময়ের জন্যেও জরুরী।
তৃতীয়ত : যদিও কোরআন সবার হেদায়াত বা পথ প্রদর্শনের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শুধু পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিরাই এ থেকে শিক্ষা নেয়।
সূরা আলে ইমরানের ১৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (১৩৯)
"তোমরা নিরাশ বা মন ভাঙ্গা হয়ো না,দুঃখিত হয়ো না,তোমরাই বিজয়ী হবে,যদি তোমরা মুমিন হও।" (৩:১৩৯)
ওহুদ যুদ্ধে পরাজিত হবার পর মুসলমানরা হীনবল ও হতাশ হয়ে পড়ে। এই আয়াতে আল্লাহ মুসলমানদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন,পরাজিত হলে কখনোই হতাশ হওয়া উচিত নয়,বিশেষ করে যখন তোমরা তোমাদের অধিনায়কের আদেশ অমান্য করায় যুদ্ধে পরাজিত হয়েছ বরং তোমাদের ঈমানকে শক্তিশালী করা উচিত। কারণ,ঈমানের ওপরই চূড়ান্ত বিজয় নির্ভর করছে।
আগের আয়াতে অতীতের ইতিহাসে খোদায়ী নীতির কথা উল্লেখ করার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে কোন জাতির সম্মান বিজয় ও মর্যাদার একমাত্র চালিকাশক্তি হলো,আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান এবং আল্লাহ ও তাঁর নবীগণের নির্দেশ অমান্য করার মধ্যেই রয়েছে জাতিগুলোর লাঞ্ছনা ও পরাজয়। মুসলমানরা ওহুদ যুদ্ধের সময় আল্লাহর এ নীতি প্রত্যক্ষ করেছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আল্লাহর প্রতি ঈমান শুধু কেয়ামতের দিনই সম্মানের কারণ হবে না,ইহকালেও অন্যান্য জাতির ওপর বিজয় ও শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যম এই ঈমান।
দ্বিতীয়ত : পরাজয়ের ফলে হতাশ ও পিছু হটা উচিত নয়। পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করতে হবে।
সূরা আলে ইমরানের ১৪০ ও ১৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ (১৪০) وَلِيُمَحِّصَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ (১৪১)
"হে মুসলমানগণ! যদি যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের আঘাত লেগে থাকে,তবে অনুরূপ আঘাত ওদেরও লেগেছে। আমি মানুষের মধ্যে পর্যায়ক্রমে জয় ও পরাজয়ের এই দিনগুলোর আবর্তন ঘটাই যাতে বুঝতে পারি কারা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে এবং তোমাদের মধ্য থেকে যেন সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায়। আর আল্লাহ অত্যাচারীদের ভালবাসেন না।" (৩:১৪০)
"যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ এভাবে তাদেরকে পবিত্র করেন এবং অবিশ্বাসীদের ক্রমেই ধ্বংস করেন।" (৩:১৪১)
এই দুই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর আরো একটি বিধান বা রীতির কথা উল্লেখ করে বলছেন,মানুষের অবস্থা সব সময় ভালো বা খারাপ থাকে না। বরং মানুষের অবস্থা পরিবর্তনশীল। সাফল্যের পর আসে তিক্ততা,জয়ের পর পরাজয়। উত্থান ও পতনের বিধান দেয়ার কারণ হলো,এর মাধ্যমেই মানব চরিত্রের উজ্জ্বল দিকগুলো ফুটে ওঠে এবং কারা প্রকৃত মুমিন ও কারা মোনাফেক তা বোঝা যায়। অপবিত্রদের মধ্য থেকে পবিত্ররা এভাবে আলাদা বা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেন। এ থেকে অন্যরা বুঝতে পারে যে পবিত্র অবস্থায় বেঁচে থাকা ও মৃত্যুবরণ করা সম্ভব। মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে আরো বলছেন,তোমরা এখন ওহুদ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছ কিন্তু এর আগে বদর যুদ্ধে তোমরাই বিজয়ী হয়েছিলে। ওহুদ যুদ্ধে তোমাদের মধ্যে যেমন অনেকেই আঘাত পেয়েছে,তেমনি তোমাদের অনেক শত্রুও আহত হয়েছে। তাই প্রথমত : এ যুদ্ধ শুধু তোমাদের জন্যেই তিক্ত নয়। আর দ্বিতীয়ত হলো : তিক্ত ও আনন্দময় ঘটনা স্থায়ী কিছু নয়। ধৈর্যশীল হলে শেষ পর্যন্ত তোমরাই জয়ী হবে এবং কাফেরদের পতন ও ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : যুদ্ধের মত বিভিন্ন দুর্যোগ ও বিপদের মাধ্যমে মানুষকে পরীক্ষা করা আল্লাহর অন্যতম স্থায়ী নীতি।
দ্বিতীয়ত : কাফেরদের বিজয়ের অর্থ এই নয় যে আল্লাহ তাদের ভালবাসেন। খোদায়ী পরীক্ষার জন্যেই কখনো কখনো কাফেরদের বিজয় ঘটে।
তৃতীয়ত : যুদ্ধ পবিত্র ও ঈমানদার মানুষকে চেনার এক ভাল মানদণ্ড । মুমিনরা যুদ্ধের ময়দানে কখনো পরাজিত হন না। কারণ,তাদের জন্য শাহাদতও এক ধরনের বিজয়।
সূরা আলে ইমরানের ১৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ (১৪২)
"তোমরা কি মনে করেছ ঈমান আনার দাবি করলেই তোমাদেরকে বেহেশতে যেতে দেয়া হবে? অথচ আল্লাহ এখনও এটা দেখেননি যে,তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদে যোগ দিয়েছে এবং কারা ধৈর্যশীল?"(৩:১৪২)
এই আয়াতে আরো একবার এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে,ঈমানের জন্য জিহাদ বা যুদ্ধের ময়দানে যাওয়া এবং মুসলমানদের ভূখণ্ড রক্ষা করা জরুরী। অর্থাৎ এটা ঈমানের অন্যতম শর্ত। শুধু ঈমান এনেছি বললে এবং এমনকি নামাজ রোজা আদায় করলেও বেহেশতে যাওয়া যাবে বলে মনে করা ঠিক নয়। কারণ,জিহাদের ময়দানেই বোঝা সম্ভব কারা প্রকৃত ঈমানদার তথা ঈমানের ওপর অটল। কারণ,অনেকে মুখে ঈমানের কথা বললেও ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি বা স্থায়িত্ব লাভ করেনি।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : অহংকার অনুপযোগী আকাঙ্ক্ষা বা দূরাকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে থাকা উচিত। কারণ,দূরাকাঙ্ক্ষা ও অহংকার মানুষের কাজে কর্মে পতন বা অবনতি ডেকে আনে।
দ্বিতীয়ত : বেহেশতের জন্য মূল্য দেয়া উচিত। বেহেশতের মূল্য কাজের মাধ্যমে দিতে হবে,দাবির মাধ্যমে নয়।
তৃতীয়ত : শুধু রণাঙ্গনই জিহাদ ও ধৈর্যের ক্ষেত্র নয়। মুমিনরা সব সময় কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে তথা শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত রয়েছে এবং আল্লাহর বিধান পালনের ক্ষেত্রেও তারা ধৈর্যশীল।