সূরা আলে ইমরান;(২৫তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(২৫তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 23:53:0 3-10-1403

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১৩২-১৩৬

সূরা আলে ইমরানের ১৩২ ও ১৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-


وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (১৩২) وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ ((১৩৩

"হে বিশ্বাসীগণ,তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর,যাতে আল্লাহর করুণা পেতে পার।" (৩:১৩২)

"তোমরা নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং বেহেশতের দিকে ধাবিত হও,যে বেহেশতের বিস্তৃতি আসমান ও জমিনজুড়ে এবং যা ধর্মভীরুদের জন্যে নির্মিত হয়েছে।" (৩:১৩৩)

ওহুদ যুদ্ধ এবং সুদ সম্পর্কিত আয়াতের পর এই দুই আয়াতে মুসলমানদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের আহ্বান জানানো হয়েছে। আল্লাহ বলছেন,যদি আমার সাহায্য ও রহমত চাও তাহলে ওহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের অজুহাতে কিংবা অন্য কোন কারণেই রাসূলের নির্দেশ অমান্য করতে পারবে না। এরপর আল্লাহ ও বেহেশতের দিকে ধাবমান হতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আর সৎ কাজ ও মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে অগ্রগামী হবার মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব বলে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। শত্রুদের কাছ থেকে গনিমতের সম্পদ তাড়াহুড়ো করে সংগ্রহের চেষ্টাই ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের জন্যে পরাজয় ডেকে এনেছিল। অন্যদিকে ধন-সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতার চিন্তাই সুদের ক্ষেত্র তৈরী করে। কিন্তু কোরআন মুমিনদেরকে আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা লাভের জন্য প্রতিযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছে যার মাধ্যমে পরকালে বেহেশতে যাবার পথ সুগম হবে। আকাশ ও জমীনজুড়ে বিস্তৃত আল্লাহর বেহশতে আকাশ ও জমিনের সুখময় সব কিছুই রয়েছে। আর এখানে প্রবেশ অধিকার লাভের শর্ত হল খোদাভীতি এবং সংযম।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
প্রথমত : যারা দরিদ্র ও বঞ্চিতদের প্রতি দয়া করে এবং ঋণ দিয়ে সুদ নেয় না,আল্লাহ তাদের করুণা ও দয়া করবেন।
দ্বিতীয়ত : মুমিনদেরকে সব সময় সক্রিয় ও গতিশীল হতে হবে। জড়তার পরিবর্তে সব সময় উন্নতি ও অগ্রগতির চেষ্টা করতে হবে এবং সৎ কাজের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকার চেষ্টা চালাতে হবে।

সূরা আলে ইমরানের ১৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-


الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (১৩৪)

"তারাই সংযমী,যারা স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল অবস্থায় দান করে,যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন।" (৩:১৩৪)

পূর্ববর্তী আয়াতে মুমিনদেরকে আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানানোর পর এই আয়াতে ক্ষমা লাভের উপায়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করা,ক্রোধ ও প্রতিশোধ থেকে দূরে থাকা মুমিন ও খোদাভীরুদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মহান আল্লাহ এসব কিছুর আগে অর্থ ও সম্পদ থেকে দান করা এবং গরীব ও বঞ্চিতদের সেবা করাকে আল্লাহর ক্ষমা লাভের মাধ্যম বলে উল্লেখ করেছেন। অনেক সাধারণ মানুষ মনে করেন যে,শুধু ধনীরাই দান করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বাস্তবতা হল সম্পদ অর্জন মানুষের মধ্যে লোভ ও কৃপণতার ইচ্ছাই বাড়িয়ে দেয়,দান ও উপকারের চেতনা বাড়ায় না। তাই,যারা স্বচ্ছল বা সম্পদশালী অবস্থায় গরীবদের দান করে,তারা দরিদ্র অবস্থায় ও সাধ্য অনুযায়ী বঞ্চিত মানুষকে দান করে। তাই এ আয়াতে বলা হয়েছে মুমিনরা স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল উভয় অবস্থায়ই দানশীল এবং পরোপকারী।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : দানের জন্য দরকার উদার মন,সম্পদ নয়। অনেক ধনী ব্যক্তিই কৃপণ,আবার অনেক দরিদ্র মানুষও দানশীল।
দ্বিতীয়ত : খোদাভীরু মানুষেরা ঘরকুনো নয় বরং তারা সমাজে সক্রিয় এবং অর্থ সম্পদ দান ও চারিত্রিক গুণাবলীর মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক তথা যোগাযোগ রক্ষা করেন।
তৃতীয়ত : যারা আল্লাহর প্রিয় হতে চান,তাদেরকে অবশ্যই দানশীল হতে হবে এবং অন্তরকে মানুষের ব্যাপারে ক্রোধ ও প্রতিশোধের ইচ্ছে থেকে মুক্ত রাখতে হবে।

সূরা আলে ইমরানের ১৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ  (১৩৫)

"যারা খোদাভীরু তারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে,কিংবা প্রকৃতপক্ষে নিজের ওপর জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে অপরাধ ক্ষমা করে থাকে? তারা যা করেছে তা জেনে শুনে করে না।" (৩:১৩৫)

অনেকে এমন ধারণা করেন যে,ঈমানদাররা বুঝি কখনোই কোন ভুল,পাপ অথবা অপরাধ করেন না। কিন্তু এ আয়াতে বলা হয়েছে,এমনকি খোদাভীরু ব্যক্তিরাও খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়তে পারেন। অর্থাৎ নিজেদের
ওপর জুলুম করতে পারেন। কিন্তু অন্যান্য অপরাধীদের তুলনায় তারা দু'দিক থেকে ভাল।
প্রথমত : তারা অপরাধ বা পাপের ওপর অটল থাকেন না এবং যখনই তারা অপরাধের কথা বুঝতে পারেন,তথনই তা থেকে বিরত হন।
দ্বিতীয়ত : তারা খুব দ্রুত ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। কারণ,তারা জানেন যে,আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং পাপীদের তওবা কবুল করেন। অর্থাৎ যারা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ও জেনেশুনে পাপ করে এবং যারা নিজেদের অজান্তে শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে পাপ করার পর তা বুঝতে পেরেই তওবা ও অনুশোচনার মাধ্যমে পাপ কাজ ত্যাগ করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে,তারা কখনও সমান নয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : পাপ থেকে দূরে থাকা তথা নিষ্পাপ থাকা খোদাভীরুতার শর্ত নয়। অপরাধ করার পর তওবা করা এবং পাপের ওপর অটল না থাকাই খোদাভীরুতার অন্যতম শর্ত।
দ্বিতীয়ত : পাপ যে ক্ষতিকর বা নোংরা বিষয়,সে সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা পাপের চেয়েও বেশী বিপদজনক। কারণ,পাপ যদি মানুষের কাছে অশ্লীল মনে না নয়,তাহলে তারা তওবার চিন্তা করবে না।
তৃতীয়ত : পাপ মানুষের আত্মার ওপর সবচেয়ে বড় জুলুম,যে আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন আল্লাহ।

সূরা আলে ইমরানের ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ مَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ (১৩৬)

"খোদাভীরুদের জন্যেই পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে ক্ষমা এবং বেহেশত,যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে,সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কত উত্তম!" (৩:১৩৬)

সূরা আলে ইমরানের ১৩৩ নম্বর আয়াতে মুমিনদেরকে তওবা করা বা ক্ষমা লাভের ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় অগ্রণী হতে এবং বেহেশতে যাবার যোগ্যতা অর্জনের উপদেশ দেয়া হয়েছে।
এরপর ১৩৪ ও ১৩৫ নম্বর আয়াতে ক্ষমা ও বেহেশত লাভের উপায় হিসেবে দান খয়রাত,পরোপকার,অপরাধের জন্য তওবা করা এবং অন্যদের অপরাধ ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে। এই আয়াতে আরো একবার বেহেশতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে,একমাত্র খোদাভীরু সংযমীরাই আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা পাবে এবং ক্ষমা লাভের মাধ্যমে পবিত্র হবার পর তারা বেহেশতে প্রবেশের সুযোগ পাবে। অফুরন্ত নেয়ামত ও প্রাচুর্যে ভরপুর বেহেশতের আয়তন যেমন অসীম,তেমনি এর মেয়াদও চিরস্থায়ী।
উল্লেখ্য,এই কয়েকটি আয়াতে মুত্তাকীন তথা খোদাভীরু বা সংযমী শব্দের সমার্থক হিসেবে মুহসেনীন বা সৎকর্মশীল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর এ থেকে বোঝা যায় খোদাভীতি এমন কোন মানসিক অবস্থা নয় যে,এর ফলে সমাজে একঘরে হয়ে থাকতে হবে বরং খোদাভীতির জন্য পরোপকার ও দান করা জরুরী।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : শুধু আশা আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনা করেই আল্লাহর রহমত পাওয়া যাবে না। সৎ উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা এজন্যে জরুরী।
দ্বিতীয়ত : মানুষ পাপ থেকে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত বেহেশতে যেতে পারবে না। কারণ,সৎকর্মশীল ও পবিত্র মানুষের সঙ্গী হবার জন্য পাপ থেকে পবিত্র হতে হবে।