সূরা আলে ইমরান;(১৬তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(১৬তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 23:14:13 3-10-1403

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ৮৩-৮৯

সূরা আলে ইমরানের ৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ


"তবে কি তারা আল্লাহর ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্ম খুঁজে বেড়াচ্ছে? অথচ আকাশ ও জমিনে যা কিছু আছে,সমস্তই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁরই কাছে আত্মসমর্পন করেছে এবং সব কিছুই তাঁরই দিকে ফিরে যাবে।" (৩:৮৩)

আল্লাহ যেসব জীবন্ত অস্বিত্ব সৃষ্টি করেছেন সেসব দু'ধরনের। একদল তাদের পথ নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীন,যেমন মানুষ। অন্য একদলের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি নেই,তবে তারা বিবেকের অনুসারী এবং তাদের কোন কু-প্রবৃত্তি নেই,যেমন ফেরেশতা। এ আয়াতে বলা হয়েছে,সব ধরনের সৃষ্টি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহর বিধান মেনে চলে। সৃষ্টির অস্তিস্ব লাভ ও সৃষ্টির সূচনা বা পটভূমি সবই আল্লাহর হাতে। সবকিছুর সৃষ্টি আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে থাকে। সৃষ্টির সময় যদি সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছার অনুসারী হয় তাহলে পরবর্তীকালে কেন বিধি-বিধানের জন্য মানব রচিত মতাদর্শগুলোর শরণাপন্ন হতে হবে? এবং কেন খোদায়ী বিধি-বিধানকে ভুলে যেতে হবে? স্রষ্টা ছাড়া অন্য কেউ কি সৃষ্টির জন্য বিধান প্রণয়নের অধিকার রাখে? স্রষ্টার আইন বাদ দিয়ে অন্য কারো আইনের সন্ধানে যাওয়া সৃষ্টির জন্য কি শোভনীয় ?

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : সৃষ্টি যত বড়ই হোক না কেন তাকে স্রষ্টার অনুগত হতে হবে। যদি আমরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন না করি,তবে সৃষ্টির রং হারিয়ে আমরা হয়ে পড়বো পরগাছা বা আবর্জনা।
দ্বিতীয়ত : সৃষ্টির ও আমাদের শেষ বা সমাপ্তিও আল্লাহর হাতে। তাই কেন আমরা স্বেচ্ছায় আল্লাহমুখী হব না ?
তৃতীয়ত : আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনই হলো,ইসলামের মূল কথা।আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে মুমিনের নিজের কোন ইচ্ছে নেই।

সূরা আলে ইমরানের ৮৪ ও ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


قُلْ آَمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَالنَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ (৮৪) وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ (৮৫)

"বল! আমরা আল্লাহতে এবং যা আমাদের প্রতি নাজেল হয়েছে,যা ইব্রাহীম,ইসমাইল,ইসহাক,ইয়াকুব ও তাদের বংশধরদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা মুসা,ঈসা ও নবীগণকে তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে দেয়া হয়েছে তাদের সবার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না। আমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পনকারী।" (৩:৮৪)
"ইসলাম ছাড়া কেউ অন্য কোন ধর্ম অনুসরণ করলে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।" (৩:৮৫)

এ আয়াতে পূর্ববর্তী নবী ও ঐশী গ্রন্থগুলোর প্রতি বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করতে ইসলামের নবী ও অন্যান্য মুমিনদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পন করতে বলা হয়েছে। কারণ,পূর্ববর্তী সমস্ত নবী এক আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছেন। আল্লাহ মানব সৃষ্টির পরই মানুষের মধ্য থেকে নবী মনোনীত করেছেন যাতে তাঁরা মানুষকে মুক্তি ও সৌভাগ্যের পথ দেখাতে পারে। এটা স্পষ্ট ও স্বাভাবিক যে,নতুন কোন নবী আসার পরও পূর্ববর্তী নবীর শিক্ষার ওপর অটল থাকা নির্বুদ্ধিতা ও গোঁড়ামী মাত্র। এই গোঁড়ামী মানুষের উন্নতির পথে বাধা। কারণ,নবীরা একই স্কুলের শিক্ষকদের মত,যারা মানব জাতিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে শিক্ষা দিয়ে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে মানুষকে পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা দান করেছেন। তাই,তাঁর আবির্ভাবের পর পূর্ববর্তী নবীর অনুসারীদের উচিত তাঁকে অনুসরণ করা এবং কেউ অন্য কোন ধর্মের অনুসরণ করলে তা গ্রহণ করা হবে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : সকল নবীর লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন। তবে তাদের দাওয়াতের পদ্ধতি স্থান ও সময়ের প্রেক্ষাপটও ছিল ভিন্ন ধরনের।
দ্বিতীয়ত : পূর্ণাঙ্গ ও সহজ ধর্ম থাকার পরও কোন ধর্মের অনুসরণ করা ক্ষতিকর।
তৃতীয়ত : ইসলাম মেনে চলার অর্থ অতীতের ধর্ম ও নবীদের সত্যতা অস্বীকার করা নয়। বরং তাদের প্রতি ঈমান রাখা মুসলমানদের বিশ্বাসের অন্যতম অংশ।

সূরা আলে ইমরানের ৮৬ ও ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (৮৬) أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ (৮৭)

"কিভাবে আল্লাহ সেই সম্প্রদায়কে পথ দেখাবেন যারা বিশ্বাসী হবার পর অবিশ্বাসী হয়েছে? তারা ইসলামের নবীর সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়েছিল এবং তাদের কাছে স্পষ্ট যুক্তি বা প্রকাশ্য নিদর্শন এসেছিল। আল্লাহ অত্যাচারীদের পথ প্রদর্শন করেন না।" (৩:৮৬)
"এই সব ধর্মত্যাগীদের প্রতিফল হলো,তাদের ওপর আল্লাহ,তাঁর ফেরেশতাদের এবং সমস্ত মানুষের অভিশাপ।" (৩:৮৭)

মুমিনদের জন্য অন্যতম বিপদ হলো ঈমান হারিয়ে ফেলা অর্থাৎ বে-ঈমান হয়ে যাওয়া। ইতিহাসে দেখা যায়,বহু ব্যক্তি খোদা ও নবীর ওপর ঈমান এনেছিল। কিন্তু তাদের কেউ কেউ সত্য বোঝার পর এবং ইসলাম ধর্মের সত্যতা সম্পর্কে জানার পরও সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে কাফের হয়েছে। যারা সত্যকে না বোঝার কারণে ঈমান আনেনি এবং যারা সত্য ধর্মকে বুঝেও গোঁড়ামী হিংসা বা কোন স্বার্থের কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি,তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যারা সত্যকে বুঝেও ঈমান আনেনি তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছে এবং মুমিনদের জন্য নির্ধারিত আল্লাহর বিশেষ রহমত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আল্লাহ ছাড়াও জগত ব্যবস্থাপনার কর্মকর্তা তথা ফেরেশতাকুল ও সত্যপন্থী মানুষ নবীদের পথ নির্দেশনার অবমাননাকারী মুর্তাদদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : শুধু কিছুদিনের জন্য ঈমান আনা যথেষ্ট নয়। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঈমান অক্ষুণ্ন রাখা জরুরি । কারণ,অবিশ্বাসের বিপদ এবং শয়তানের কু-মন্ত্রণা যে কোন সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
দ্বিতীয়ত : সঠিক পথ খোঁজা কিংবা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার বিষয়টি আমাদের ইচ্ছাধীন। আল্লাহ কারো অধিকারের ওপর জুলুম করেন না। বরং আমরা নিজেরাই সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজেদের ওপর জুলুম করি।
তৃতীয়ত: ধর্মত্যাগীদের বিকৃত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং ধর্মত্যাগীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা।

সূরা আলে ইমরানের ৮৮ ও ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ (৮৮) إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৮৯)


"তাদের ওপর অভিশাপ স্থায়ী হবে। তাদের শাস্তিও কমানো হবেনা এবং অবকাশও দেয়া হবে না।" (৩:৮৮)
"তবে এরপর যারা তওবা করে ও নিজেদের সংশোধন করে তাদের ব্যাপারে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।" (৩:৮৯)

সত্যকে জানা ও বোঝার পরও যারা ঈমান ত্যাগ করবে,তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। তারা পৃথিবীতেই সত্য সন্ধানীদের অভিশাপ পাবে এবং পরকালেও তারা আল্লাহর কঠোর শাস্তি আস্বাদ করবে। পরকালে এই পাপীষ্ঠদের শাস্তির তীব্রতা কখনও কমানো হবে না এবং তারা চিরকাল শাস্তি ভোগ করবে। অবশ্য তওবার পথ কখনো বন্ধ নয়। এইসব পাপীও যদি কখনো মৃত্যুর আগে অনুতপ্ত হয় এবং তাদের কাজ ও চিন্তাধারাকে সংশোধন করে,তাহলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন। তওবার পর তারাও আল্লাহর অনুগ্রহ পাবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : ক্ষমা প্রার্থনা বা তওবা শুধু মৌখিক নয়। প্রকৃত তওবা হলো,ভুল চিন্তাধারা ও ভুল কাজ সংশোধন করা।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহ পাপীর তওবা গ্রহণ করে তাকে শুধু ক্ষমাই করেন না,একইসাথে তিনি তওবাকারীদের পছন্দও করে থাকেন।