সূরা বাকারাহ;(৩৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৩৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 6:46:27 4-10-1403

সূরা বাকারাহ; আয়াত ১৩৪-১৩৮

সূরা বাকারাহ'র ১৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-

 
تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ

"সেই উম্মত (দল) চলে গেছে, তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের, তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের, তারা যা করত সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে না।" (২:১৩৪)

বনী ইসরাইল বা ইহুদীরা তাদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করতো৷ তাদের ধারণা ছিল, তারা নিজেরা যতই ভুল-ভ্রান্তি বা পাপ করুক না কেন, তাদের পূর্বপুরুষদের ভালো কাজের কারণে তারাও ক্ষমা লাভ করবে। তাই তারা নিজেদের সংশোধনের পরিবর্তে তাদের পূর্বপুরুষদের কাজ-কর্ম স্মরণ করতো এবং সর্বত্র বলে বেড়াত। কিন্তু এই আয়াতে তাদেরকে ও মুসলমানসহ অন্যান্যদেরকে এই বলে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষ নিজে নিজের কাজের জন্য দায়ী থাকবে এবং কিয়ামত বা পুনরুত্থানের সময় পিতা, সন্তান ও আত্মীয়ের সম্পর্ক কারো কোনই কাজে আসবে না। তাই পূর্বপুরুষের ভালো কাজের জন্য যেন তারা আনন্দিত না হয়৷ আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, মানুষের মর্যাদা তার মহত্ব বা অধ্যবসায়ের মধ্যে নিহিত, পূর্ববর্তীদের নষ্ট হয়ে যাওয়া হাঁড়ের মধ্যে নয়।

এরপর ১৩৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَالُوا كُونُوا هُودًا أَوْ نَصَارَى تَهْتَدُوا قُلْ بَلْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

"তারা বলে, তোমরা ইহুদী অথবা খ্রিস্টান হয়ে যাও,তবেই সুপথ পাবে। আপনি বলুন, (কখনই নয়) বরং আমরা ইব্রাহীমের ধর্মে আছি যা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সে মুশরিক বা অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। (২:১৩৫)

ইহুদীরা নিজেদেরকে সঠিক পথের অনুসারী বলে দাবী করে ও খ্রিস্টানদেরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে। অন্যদিকে খ্রিস্টানরা নিজেদেরকে সত্যের অনুসারী ও ইহুদীদেরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে। এভাবে তারা পরস্পরকে নিজেদের ধর্মের দিকে আহবান করত৷ কোরআন এই কর্তৃত্বকামী প্রচেষ্টার জবাবে বলেছে, মুক্তি লাভের পথ কোন দলের আনুগত্য করে পাওয়া যাবে না বরং মুক্তি পেতে হলে সত্য পথের অনুসারি হতে হবে৷ এক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) একটি আদর্শ কারণ কখনও শির্ক ও আত্মপূজায় লিপ্ত হননি।

এই আয়াত আমাদেরকে এটা শিক্ষা দেয় যে, ইহুদী হওয়া বা খ্রিস্টান হওয়া বড় কথা নয় । তৌহিদ বা একত্ববাদের অনুসরণ করাই হল গুরুত্বপূর্ণ।

এরপর ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُولُوا آَمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ

"তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর ওপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তদের বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা, অন্যান্য নবীকে পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমরা তাঁরই আনুগত্যকারী।" (২:১৩৬)

পূর্ববর্তী আয়াতে ধর্ম নিয়ে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়েছিল৷ তারই রেশ ধরে এ আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের বলা হয়েছে যে, আল্লাহর পয়গম্বর বা ঐশী পথনির্দেশকদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই৷ কারণ তাঁদের সবাই এক খোদার পক্ষ থেকে এসেছেন৷ তাঁদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাও এক আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে৷ তাই একত্ববাদের অনুসারীদের উচিত সমস্ত ঐশী পথ প্রদর্শকদের মেনে নেয়া এবং তাঁদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা বিশ্বাস করা৷ শুধু নিজেদের পয়গম্বরকে মানব ও অন্যদের পয়গম্বরকে ও তাদের গ্রন্থগুলোকে অস্বীকার করব-এটা ন্যায় বিচার হতে পারে না৷ আল্লাহর নবীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মত, যারা একটা নির্দিষ্ট সময়ে মানুষকে শিক্ষাদানের দায়িত্ব পেয়েছেন এবং চিন্তার ক্ষেত্রে মানুষের অগ্রগতির সাথে সঙ্গতি রেখে আল্লাহ গ্রন্থসমূহ ও অধিকতর পূর্ণাঙ্গ আইন-বিধান নাজিল করেছেন, যাতে করে মানুষকে সুপথ প্রদর্শন করা যায়৷

এরপর ১৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে।–

فَإِنْ آَمَنُوا بِمِثْلِ مَا آَمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

"তোমরা যাতে বিশ্বাস করেছ তারাও যদি একই রকম বিশ্বাস করে তবে তারা সুপথ পাবে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারাই হঠকারিতায় রয়েছে। সুতরাং এখন তাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।" (২:১৩৭)

এ আয়াতে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, যদি তথাকথিত ঐশিগ্রন্থের অনুসারীরা আত্মকেন্দ্রীকতা ও বংশীয় কলহ বিদ্বিষ ছেড়ে দিয়ে মুসলমানদের মতই সমস্ত নবী ও তাদের উপর অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি ঈমান আনত, তাহলে তারা সঠিক পথ খুঁজে পেত৷ কিন্তু যদি তারা নিজেদেরকে সত্যের মানদণ্ড বলে মনে করে ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ও তাদের পয়গম্বরদের বিভ্রান্ত বলে মনে করে, তবে তাহলো সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের লক্ষণ এবং সত্যানুসন্ধানীদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হবার লক্ষণ৷ এই আয়াতের শেষে মুসলমানদেরকে সাহস যুগিয়ে বলা হচ্ছে যে, ধর্মের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আল্লাহই মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট৷ কারণ তোমাদের সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে ও যে সব পরিকল্পনা করা হচ্ছে-সেসবই আল্লাহপাক অবগত আছেন ৷

এরপর ১৩৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে-

صِبْغَةَ اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ

"আমরা আল্লাহর রঙ গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রঙ এর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে? আমরা তাঁরই এবাদত করি।"(২:১৩৮)

আল্লাহ হচ্ছেন সমগ্র জগতের রঙদানকারী শিল্পী৷ তিনি মানুষ সৃষ্টির শুরুতে মানুষের আত্মাকে পবিত্র স্বভাব বা প্রকৃতি দিয়ে রঙীন করেছেন৷ কিন্তু মানুষ আল্লাহর দেয়া রঙের ওপর নিজেদের ইচ্ছে মত রঙ লাগাচ্ছে। যেমন প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে৷ আর এভাবে আল্লাহর দেয়া স্বভাবগত রঙকে নিজের অস্তিত্ব থেকে মুছে ফেলছে। ব্যক্তিগত দলীয় ও গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ হলো এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বা রঙ, যা মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই এসব গোত্রীয় ও বংশীয় সকল রঙ বা বৈশিষ্ট্য দূর করতে হবে যাতে আল্লাহর রঙ মানুষের মধ্যে ফুটে ওঠে। আল্লাহর রঙ ছাড়া সকল রঙই সময়ের পরিক্রমায় ম্লান ও ধীরে ধীরে বর্ণহীন হয়ে যায়৷ কিন্তু শুধু আল্লাহর রঙই সুদৃঢ় ও অম্লান হয়ে টিকে থাকে৷ সব রঙই বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তি ডেকে আনে৷ কিন্তু আল্লাহর রঙ হলো ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মানদণ্ড এবং তা এক আল্লাহর দাসত্বের ছায়াতলে অবস্থিত৷

আজকের আলোচিত আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ,
এক. পূর্ব পুরুষদের নিয়ে গর্ব না করে নিজেদের কাজের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে৷ প্রত্যেককেই তার কর্মের ফল ভোগ করতে হবে৷ অন্যরা যখন তাদের পারলৌকিক মুক্তির জন্য আপ্রাণ সচেষ্ট, তখন আমরা নিজেদের বংশ নিয়ে গর্ব মত্ত না থাকি।
দুই. আমাদেরকে সত্যপন্থী হতে হবে, দল পন্থী নয়৷ সত্যপন্থী হলে মানুষের চোখ ও কান সত্য উপলদ্ধির জন্য খোলা থাকে৷ কিন্তু যারা দলপন্থী তারা মানুষকে অন্যদের ভালো দিক ও পূর্ণতা এবং নিজেদের দূর্বলতা সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখে৷
তিন. অন্তরে বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি কাজেও আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হবে৷ একদিকে ঈমানের দাবী করা ও অন্যদিকে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা স্ব-বিরোধিতা মাত্র ৷