সূরা বাকারাহ;(৩৩তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৩৩তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 6:32:30 4-10-1403

সূরা বাকারাহ; আয়াত ১১৩-১১৭
 
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারাহ''র ১১৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন-

وَقَالَتِ الْيَهُودُ لَيْسَتِ النَّصَارَى عَلَى شَيْءٍ وَقَالَتِ النَّصَارَى لَيْسَتِ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ وَهُمْ يَتْلُونَ الْكِتَابَ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ مِثْلَ قَوْلِهِمْ فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ

"ইহুদীরা বলে খ্রিস্টানদের কোন ভিত্তি নেই অর্থাৎ তারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এবং খ্রিস্টানরা বলে ইহুদীরা সত্যের অনুসারী নয়,অথচ তারা (উভয় সম্প্রদায়ই) আল্লাহর গ্রন্থ পাঠ করে। একইভাবে মূর্তি পুজারী ও মুশরিকরা যারা (আল্লাহর গ্রন্থ সম্পর্কে) কিছুই জানে না তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তাদের মতভেদ রয়েছে, আল্লাহ পুনরুত্থান দিবসে তার মীমাংসা করবেন৷" (২:১১৩)
আগের পর্বে আমরা বলেছি, ইহুদী এবং খ্রিস্টানরা বেহেশতকে একমাত্র তাদের জন্য নির্ধারিত বলে মনে করে৷ এই আয়াতে তাদের এই চিন্তাধারাকে নাকচ করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, অন্যায় বিদ্বেষ বা হিংসার কারণেই ইহুদী ও খ্রিস্টানরা পরস্পরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে৷ অথচ এ দুই জাতির কাছেই ঐশী গ্রন্থ নাজেল হয়েছিল এবং তারা ছিল আল্লাহর নবীদেরই উম্মত বা অনুসারী৷ কিন্তু মজার বিষয় হলো-মুশরিক ও মূর্তিপূজারীরা ঐশী বা খোদায়ী গ্রন্থের অনুসারী না হওয়া সত্ত্বেও তারা ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মত একই দাবি করত। অর্থাৎ দাবি করত যে, একমাত্র তারাই বেহেশতে যাবে-অন্য কেউ নয়৷ আসলে হিংসা ও প্রধান্য বিস্তারের মনোভাব মানুষকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করে৷ ফলে তারা সত্যকে মেনে নিতে পারে না, শুধু নিজেদেরকেই সত্যের অনুসারী বলে মনে করে এবং অন্যরা যাই হোক না কেন তাদের মতে সত্যের অনুসারী নয়৷ এই আয়াতে স্পষ্ট করে এটাও বলা হয়েছে যে, মানুষ যখন অন্যায়ভাবে বিদ্বেষী হয়ে পড়ে, তখন জ্ঞানীই হোক আর মুর্খই হোক সবাই একই ধরনের চিন্তা-ভাবনা করে। আহলে কিতাব বা আসমানী কিতাবের অনুসারীরা তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও মূর্তিপূজারী ও মুশরিক-মূর্খদের মত একই কথা বলেছে এবং এরা কোন যুক্তি-প্রমাণ ছাড়াই অন্যদেরকে বাতিল বা মিথ্যার অনুসারী বলে মনে করে৷
এরপর ১১৪নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسَاجِدَ اللَّهِ أَنْ يُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ وَسَعَى فِي خَرَابِهَا أُولَئِكَ مَا كَانَ لَهُمْ أَنْ يَدْخُلُوهَا إِلَّا خَائِفِينَ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ
"যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে উজাড় করতে চেষ্টা করে, তার চাইতে বড় জালেম আর কে হতে পারে? এদের পক্ষে মসজিদে প্রবেশ করা সঙ্গত নয়, অবশ্য ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। তাদের জন্য ইহকালে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে।" (২:১১৪)
ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় দেখা গেছে, বহুবার আল্লাহর ঘর বা মসজিদ হয় ধ্বংস করা হয়েছে নতুবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ কারণ মসজিদ ও উপাসনালয় সব সময়ই ঐশী ধর্ম পরিচালনার কেন্দ্র এবং ঐশী ধর্মের অনুসারীদের সংগঠিত হওয়ার ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই অত্যাচারী শাসক ও বিভ্রান্ত ব্যক্তিরা সব সময়ই মসজিদের আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক কাঠামো বা ভিত্তি ধবংসের চেষ্টা করেছে। যেমন,মক্কার মুশরিকরা অনেক বছর ধরে মুসলমানদের জন্য কাবা ঘর বা বায়তুল হারামে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল৷ বর্তমানেও ইসলামের শত্রুরা বায়তুল মোকাদ্দাসে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদকে ধবংসের চেষ্টা করছে। ভারতে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ধ্বংস করেছে। অবশ্য মসজিদ ধবংসের অর্থ শুধু মসজিদের বাহ্যিক ভিত্তি ধ্বংস করা নয়। যেমনটি মসজিদের উন্নয়নের অর্থ শুধু মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়। প্রকৃতপক্ষে যেসব কাজ মসজিদের প্রভাব বা মসজিদের প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে দেয় এবং যেসব কাজের ফলে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় ও মসজিদ থেকে দূরে থাকে সেসব কাজ করাও মসজিদের ধ্বংস সাধনের শামিল। অনৈতিক ছবি,ভিডিও বা সিনেমা প্রদর্শন হচ্ছে ইসলামী বা মুসলিম দেশের যুব সমাজকে মসজিদ ও ধর্মীয় সভা থেকে দূরে রাখার লক্ষ্য সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র।
এর পরের আয়াত অর্থাৎ ১১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

"পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই জন্য, অতএব তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও সে দিকেই আল্লাহ বিরাজমান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যাপী, মহাজ্ঞানী ৷(২:১১৫)
আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা যখন বায়তুল মোকাদ্দাসের পরিবর্তে মক্কাকে তাদের কেবলা হিসেবে নির্ধারণ করে, তখন ইহুদীরা কিছু প্রশ্ন তোলে। এসব সম্পর্কে আমরা এর আগেও আলোচনা করেছি। যেমন তারা এ প্রশ্ন তোলে যে, যদি আগের কেবলাই সঠিক ছিল, তাহলে কেন তা পরিবর্তন করা হলো? আর যদি আগের কেবলা সঠিক না হয়, তাহলে আগের ইবাদত কি সঠিক হবে? এই সন্দেহ বা প্রশ্নের উত্তরে এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কোন নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকা নেই ৷ পূর্ব ও পশ্চিম সব দিকেই আল্লাহ আছেন। অর্থাৎ যেদিকেই মুখ ফেরানো হোক না কেন আল্লাহ সেদিকেই আছেন। যদি কাবাঘর অথবা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তা এই অর্থে যে, নামাজ ও অন্যান্য সামষ্টিক ইবাদতের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে। যেসব উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করে এবং সব সময় মুসলমানদেরকে এইসব উদ্দেশ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ৷ যতদিন পর্যন্ত ইহুদীরা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা হিসেবে গ্রহণ করার কারণে মুসলমানদের মুসলমানদেরকে কটাক্ষ করেনি ততদিন মুসলমানরা ওই দিকে ফিরে নামাজ আদায় করত। কিন্তু যখন এই কেবলাকে মুসলমানদের দুর্বল করার ও তাদেরকে হেয় করার মাধ্যমে পরিণত করা হয় তখন আল্লাহ তালা হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর স্মৃতির নিদর্শন কাবা ঘরকে মুসলমানদের কেবলা হিসাবে নির্ধারণ করেন ৷
এরপর ১১৬ ও ১১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَهُ قَانِتُونَ () بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ

"তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি তো এসব কিছু থেকে পবিত্র, বরং নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তার আজ্ঞাধীন। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে এ কথাই বলেন, 'হয়ে যাও' তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।" (২:১১৬-১১৭)
ঐশী গ্রন্থের অনুসারী ইহুদী ও খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মের সত্যতা প্রদর্শনের জন্য যেসব ভুল ধারণা প্রচার করত, সেসবের মধ্যে অন্যতম হল তাদের নবীরা নাকি ছিলেন আল্লাহর সন্তান। ইহুদীরা বলতো, উজাইর ছিল আল্লাহর সন্তান। খ্রিস্টানরা বলতো, ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র। মজার বিষয় হলো, মক্কার মুশরিকরাও ফেরেশতাদেরকে 'আল্লাহর কন্যা' বলে মনে করত। আর তাদের মতে 'আল্লাহর কন্যারা' নাকি আল্লাহর কাজ সম্পন্ন করত। এই আয়াতে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচলিত এসব ভুল ও অযৌক্তিক ধারণাকে নাকচ করা হয়েছে এবং আল্লাহকে সন্তান-সন্ততি থেকে মুক্ত ও পবিত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, আল্লাহ সমস্ত আকাশ ও জমিনের এবং সেসবের ওপর তাঁরই আধিপত্য রয়েছে। তাই আল্লাহর এমন কি কম রয়েছে যে, এই অভাব বা চাহিদা পুরণের জন্যে তাকে সন্তান গ্রহণ করতে হবে? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ বা প্রভুর সাথে মানুষের তুলনা এবং আল্লাহকে মানুষের মত করে চিন্তা করা হচ্ছে-এমন এক ভ্রান্ত চিন্তা যে, এর ফলে মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আল্লাহর সত্ত্বার বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে। অথচ আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, কোন কিছুই আল্লাহর মত কিংবা তাঁর সমতুল্য নয়।
এ পর্বের আলোচিত আয়াত ক'টির শিক্ষণীয় দিকগুলো একে একে তুলে ধরা হলো-
এক. মসজিদ হলো-কুফর ও শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঘাঁটি। আর এ জন্যেই ইসলামের শত্রুরা মসজিদের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি ধ্বংসের চেষ্টা করে। তাই আমাদেরকে এমনভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে মসজিদ হয় মুসল্লিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ এবং যাতে শত্রুরা মসজিদে প্রভাব ফেলতে ভয় পায়।
দুই. বাবা-মা, অভিভাবক, মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন সাহেব এটা মনে রাখতে হবে যে, এমন কোন আচরণ করা উচিত হবে না যাতে কিশোর বা যুবকরা মসজিদে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বরং সব সময়ই শিশু-কিশোরদেরকে মসজিদে যেতে উৎসাহিত করা তাদের দায়িত্ব।
তিন. আল্লাহ কোন বিশেষ দিকে বা স্থান জুড়ে বিরাজ করেন না। আমরা যেদিকেই মুখ ফেরাবো সেদিকেই তাকে পাব। অর্থাৎ তিনি আছেন সব দিকেই, কিন্তু কেবলার তাৎপর্য হলো ইবাদতের বৃহৎ সমাবেশ হবে একমূখী ও সমন্বিত। আর তাও হবে তৌহিদের প্রথম কেন্দ্র কাবা অভিমূখী।
চার. আল্লাহ মানুষ নন। তাই তার সন্তান ও স্ত্রীর প্রয়োজন নেই৷ তিনি সকল নারী, পুরুষ ও তাদের সন্তানদের সৃষ্টিকর্তা। কারণ তিনিই সমগ্র সত্ত্বা ও অস্তিত্বের স্রষ্টা ও সব কিছুর ওপরই কর্তৃত্বের অধিকারী৷ আমরা আল্লাহ সম্পর্কে যেসব অলীক কল্পনা করি সেসব তারই সৃষ্টি ও সেসব আমাদের স্রষ্টা নয় ৷