সূরা বাকারাহ;(৩৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৩৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:33:2 4-10-1403


সূরা বাকারাহ; আয়াত ১১৮-১২৩
সূরা বাকারাহ'র ১১৮ ও ১১৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-

وَقَالَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ لَوْلَا يُكَلِّمُنَا اللَّهُ أَوْ تَأْتِينَا آَيَةٌ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِثْلَ قَوْلِهِمْ تَشَابَهَتْ قُلُوبُهُمْ قَدْ بَيَّنَّا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ () إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَا تُسْأَلُ عَنْ أَصْحَابِ الْجَحِيمِ


"যারা কিছু জানে না, তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কেন কথা বলেন না? অথবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন কেন আসে না? এমনিভাবে তাদের পূর্বে যারা ছিল তারাও তাদেরই মত কথা বলেছে। তাদের অন্তর একই রকম। নিশ্চয় আমি প্রকৃত বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।
নিশ্চয় আমি আপনাকে সত্যধর্মসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। দোযখবাসীদের সম্পর্কে আপনাকে কোন জিজ্ঞাসা করা হবে না।" (২:১১৮-১১৯)
অজ্ঞ ও বিদ্বেষী লোকেরা নবীজি'র কাছে যেসব আপত্তি বা প্রশ্ন উত্থাপন করত, তার মধ্যে অন্যতম আপত্তি ছিল-আল্লাহ ও তাদের মধ্যে একজন নবীকে মাধ্যম নির্বাচিত করার কি দরকার ছিল? আল্লাহ কেন সরাসরি তাদের সঙ্গে কথা বলেন না? এবং তাদের কাছে কেন আল্লাহ তার বাণী বা আয়াত নাজেল করেন না? এরকম হলেই তো আমরা আল্লাহর বাণী মেনে নিতাম।
তাদের এইসব অযৌক্তিক আবদারের জবাবে ইসলামের নবী ও মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলছেন, এ ধরনের আপত্তি নতুন কিছু নয়। এদের আগেও অনেকে এ ধরনের অযৌক্তিক আবদার করেছে। কারণ এই সমস্ত একগুঁয়ে লোকদের অন্তর অন্যান্য সত্য বিরোধীদের মতই। এ ধরনের লোকেরা আল্লাহর নবীকে মেনে নেয়া বা সত্যকে উপলদ্ধি করার যোগ্য নয়। এমনকি যদি তাদের ওপরও আল্লাহর আয়াত নাজেল হতো, তবুও তারা এসব আয়াত মেনে নিত না। কারণ তারা অজুহাতের সন্ধানেই ব্যস্ত ও সত্য মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর বাণী প্রচার করাই নবীদের দায়িত্ব এবং তারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জনগণকে পরামর্শ দেন, তারা প্রচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং ফলাফলের জামিনদার নয়। তাই তারা জনগণকে সত্য গ্রহণের জন্য বাধ্য করেন না। ফলে কেউ যদি বিভ্রান্ত হয় এবং দোজখে যায় তাহলে তা তার নিজেরই পছন্দের ফল। নবীরা এ জন্যে দায়ী নয়।
এর পরের আয়াত অর্থাৎ ১২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ قُلْ إِنَّ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَ الَّذِي جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ


"ইহুদী ও খ্রিস্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্ম অনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। জ্ঞান প্রাপ্তির পর যদি আপনি তাদের আকাঙ্ক্ষার অনুসরণ করেন,তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার কোন সাহায্যকারী বা অভিভাবক থাকবে না।" (২:১২০)

কেবলা পরিবর্তনের পর মুসলমানদের ওপর ইহুদীদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। অনেক মুসলমান বায়তুল মোকাদ্দাসকেই কেবলা রাখতে চেয়েছিল যাতে মদীনার ইহুদীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে জীবন-যাপন করা যায়। কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারেনি যে, ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনের ঘটনাকে মুসলমানদের বিরোধিতা করার জন্য অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছে। ইহুদীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে তো প্রস্তুত ছিলই না বরং তারা চাইতো মুসলমানরা যেন ইসলাম ধর্ম ছেড়ে দিয়ে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে। এই আয়াতে একটি সামগ্রিক মূলনীতি তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হলো, সত্যের পথ থেকে মুসলমানরা যতই পিছু হটবে, শত্রুরা ততই মিথ্যা ও কুফরীর দিকে তাদেরকে ধাবিত করবে। তাই কোরআন মুসলমানদেরকে ধর্মের শত্রুদের সাথে আপোষ করতে নিষেধ করেছে৷
এরপর ১২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمَنْ يَكْفُرْ بِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

"যাদেরকে কিতাব দান করা হয়েছে, যারা তা সঠিকভাবে পাঠ করে, তারাই এতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, আর যারা তা অস্বীকার করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷" (২:১২১)
ঐশি গ্রন্থের অনুসারীদের অধিকাংশেরই ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়নি,কিন্তু তাদের মধ্যে যারা সত্য সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঐশী গ্রন্থ অধ্যয়ন করবে তারা আল্লাহর নবী ও কোরআনের ওপর ঈমান আনার তওফিক লাভ করবে। এই আয়াতে স্পষ্টভাবে এটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কোরআনের শব্দাবলী সম্মানের সাথে তেলাওয়াত করাই যথেষ্ট নয়, পথনির্দেশ লাভ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হতে হলে কোরআনের আয়াতের অর্থ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে হবে।
এরপর সূরা বাকারাহ'র ১২২ ও ১২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ () وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ


"হে বনী-ইসরাঈল! আমার অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদের দিয়েছি। আমি তোমাদেরকে বিশ্বাবাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। তোমরা ভয় কর সে দিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কার ও সুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না।" (২:১২২-১২৩)
পাঠক, আপনাদের হয়তো মনে আছে যে, সূরা বাকারাহ'র ৪৭ ও ৪৮ নম্বর আয়াতেও একই ধরনের বক্তব্য এসেছে। তাই এ দুই আয়াতের ব্যাখ্যা জানার জন্য অনুগ্রহ করে ৪৭ ও ৪৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা পড়ে নিন।
এ পর্বে আলোচিত আয়াতগুলোর মূল শিক্ষা হচ্ছে-
"সত্যকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে-তা অন্যদের কাছ থেকে হলেও। আমরা যেন এমন ধারণা না করি যে, যা কিছুই 'আমি' 'আমার দল' বা 'গোষ্ঠী' বলবে, শুধু তাই সত্য এবং অন্যরা যা-ই বলুক না কেন তা মিথ্যা বা পরিত্যাজ্য। আল্লাহর নবীরা মানুষকে উপদেশ, পরামর্শ, ভয় প্রদর্শন ও সুসংবাদ দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। মানুষকে জোর করে ঈমানদার করা তাদের দায়িত্ব নয়। তাই যারা বিভ্রান্ত তাদের তৎপরতার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ তারা নিজেরাই বিভ্রান্তির পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদেরকে ধর্মের দিকে আহবান করতে যেয়ে ধর্মের মূলনীতি বিসর্জন দেয়া যাবে না। ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এমনকি বিরোধীদের প্রতিও ন্যায় বিচার করতে হবে।