আমরা জানি বর্তমান উন্নত বিশ্বে কিছু তৈরী করা হলে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ক্রেতাকে যন্ত্রের সাথে একটি নির্দেশিকা পুস্তিকাও সরবরাহ করে থাকে। ঐ পুস্তিকায় যন্ত্রের খুটিনাটি দিক, বৈশিষ্ট্য, ব্যবহারের নিয়মাবলী, যন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন দিক বলে দেয়া হয়; যাতে ক্রেতা ঐ যন্ত্র ব্যবহার করতে পারে এবং এমন কোন কাজ না করে যাতে দ্রুত ঐ যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। আমি, আপনি, আমরা সব মানুষ এক ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্র, যাদেরকে এক মহা ক্ষমতাবান সত্ত্বা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমাদের দেহ, আত্মা ও মনের মধ্যে নানা দুর্বলতা ও অজানা সব জটিলতার কারণে আমরা নিজেদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানিনা এবং সৌভাগ্য ও কল্যাণের পথ আমাদের জানা নেই। তাছাড়া আমরা কি টেলিভিশন কিংবা রেফ্রিজারেটরের চেয়ে নগণ্য কিছু? যে কারণে এ সব যন্ত্রের নির্মাতারা এসবের সাথে নির্দেশিকা পুস্তিকা দেবেন অথচ আমাদের স্রষ্টা আমাদের জন্য কোন বই বা পুস্তিকা লিখে দেবেন না?
আমাদের দৈহিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনাকারী এবং আমাদের যোগ্যতা, প্রতিভা ও ক্ষমতার বর্ণনাদানকারী কোন নির্দেশিকা বইয়ের কি কোন প্রয়োজন নেই? মানুষ কোন পথে চলবে এবং কোন পথে কি ভাবে তার শক্তি ও যোগ্যতা কাজে লাগাবে, সেসবের বর্ণনা ও দিক নির্দেশনার কি কোন প্রয়োজন নেই? যেসব বিষয় মানুষের দেহ, মন ও আত্মার জন্য ক্ষতিকর এবং তাকে অকল্যাণের দিকে পরিচালিত করে সেসবের বর্ণনার কি কোন দরকার নেই? যে মহান স্রষ্টা তার অসীম জ্ঞান, ভালোবাসা ও দয়া দিয়ে আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেবেন-এটা কি হতে পারে? না, এমনটি হতে পারে না। তাই আল্লাহপাক মানবজাতির পথ-নির্দেশনার জন্য সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে মানুষ কিভাবে সুখী হতে পারে এবং কি কারণে সে দুর্দশাগ্রস্ত হবে ও ধ্বংসের মুখে পড়বে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুস্থ সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক, মানুষের নৈতিকতা, অধিকার, দেহ ও আত্মার খোরাক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব, সমাজের সঠিক ও ভুল রীতি-নীতি, অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ব্যক্তি ও সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি এবং অকল্যাণের সাথে জড়িত বহু বিষয় এই আসমানী গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন অতীত জাতির কাহিনী, যুদ্ধ-সংঘাত, বিভিন্ন নারী-পুরুষের জীবন পদ্ধতি তুলে ধরা হলেও এটি কোন গল্পের বই নয় বরং এটি আমাদের বর্তমান জীবনের জন্য এক মহা শিক্ষণীয় বই।
তাইতো এই গ্রন্থের নাম কোরআন অর্থাৎ পাঠযোগ্য বই। এ বইটিকে তেলাওয়াত করতে হবে। অবশ্য শুধু মুখে মুখে তেলাওয়াত করলেই চলবেনা। কারণ এ ধরনের পড়াতো ছোটদের পড়া। বরং গভীর চিন্তা-ভাবনার সাথে পাঠ করতে হবে। অবশ্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক নিজেই এ ধরনের তেলাওয়াত করতে বলেছেন।
আমরা জানি পবিত্র কোরআনে ১১৪ টি সূরা রয়েছে এবং প্রত্যেক সূরায় রয়েছে বেশ কয়েকটি আয়াত। পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরাটিকে ফাতেহাতুল কিতাব বলা হয় যা কিনা সাধারণত: সূরা হামদ নামে পরিচিত। এই সূরাটি দিয়ে কোরআন শুরু হয়েছে বলে একে ফাতেহাতুল কিতাব বা সূরা ফাতেহা বলা হয়। সাত আয়াত বিশিষ্ট এ সূরার গুরুত্ব সম্পর্কে শুধু এতটুকুই বলতে হয় যে প্রতিদিন নামাজে দশ বার এই সূরা পড়া ফরজ এবং এছাড়া নামাজ শুদ্ধ হবে না। ঐশী কিতাবের সূচনাকারী এই সূরাটি এমন এক আয়াত দিয়ে শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে কোন কাজ করলে ঐ কাজের পরিণতি শুভ হয়। এবারে এ আয়াতটির উপর আলোকপাত করব। সূরা ফাতেহার প্রথম আয়াতটি হলো-
" বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" অর্থাৎ পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লার নামে।
অতীতকাল থেকে মানুষের চিরাচরিত রীতি ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোন মহৎ ও বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে শুরু করা, যাতে ঐ কাজটি সফল হয় এবং এর বরকত বাড়ে। যেমন মূর্তিপূজকেরা তাদের পূজনীয় কোন মূর্তির নাম আওড়ায় কাজের সফলতার জন্য। আজকাল রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির নামে বা তার উপস্থিতিতে বিভিন্ন কাজের উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু সব কিছুর উপরে এবং সর্বশক্তিমান হলেন, মহান আল্লাহ্। তাঁরই ইচ্ছায় অসি-ত্বের শুরু এবং বিশ্বজাহানের সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। শুধু বিশ্ব প্রকৃতি নয় বরং শরীয়ত অর্থাৎ কোরআন সহ সকল আসমানী গ্রন্থ তাঁরই নামে শুরু হয়েছে। এছাড়াও ইসলামে ছোট-বড় সব কাজ, খাওয়া-পরা, লেখা-জোখা, ভ্রমণ, ঘুমানো, ইত্যাদি যে কোন কিছু শুরুর আগে আমাদেরকে বিসমিল্লাহ্ বলতে বলা হয়েছে। কোন পশু যদি আল্লার নাম উচ্চারণ করা ছাড়া জবাই করা হয় তাহলে তার গোশ্ত খেতে নিষেধ করা হয়েছে। বিসমিল্লাহ্ শুধু ইসলাম ধর্মের নির্ধারিত কিছু নয়। কারণ পবিত্র কোরআনেই দেখা যায় হজরত নূহ(আ:)এর কিশ্তীর যাত্রা শুরু হয়েছিল বিসমিল্লাহ্ দিয়ে। হজরত সোলায়মান(আ:)ও সারা রাজ্যের রানী বিলকিসকে যে চিঠি লিখেছিলেন তা শুরু করেন বিসমিল্লাহ বলে। আমাদের বিশ্বাস-বিসমিল্লাহ একটি পূর্ণাঙ্গ আয়াত এবং সূরা ফাতেহার অংশ। কারণ রাসূলে খোদা(সা:)এর আহলে বাইত বা নবী বংশের সদস্যরা নামাজে কাউকে বিসমিল্লাহ্ পড়তে দেখলে কিংবা নি:শব্দে বিসমিল্লাহ্ বলতে দেখলে রাগ করতেন। তাঁরা নিজেরা সব নামাজে এই আয়াতটি জোরে শব্দ কোরে পড়তেন।
বিসমিল্লাহ্ থেকে আমাদের কয়েকটি প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো-প্রথমত: বিসমিল্লাহ্ ও খোদার নাম উচ্চারণ থেকে আল্লাহর প্রতি ভরসা ও তাঁর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি বোঝা যায়। আল্লাহর নাম প্রত্যেক কাজে বরকতের উৎস। দ্বিতীয়ত: বিসমিল্লাহ্ আয়াতটি প্রত্যেক কাজকে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত করে এবং মানুষের কাজকে শিরক বা অংশীবাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তৃতীয়ত: বিসমিল্লাহ্ মানে-হে আল্লাহ্ আমি তোমাকে ভুলিনি, তুমিও আমাকে ভুলো না। যে ব্যক্তি বিসমিল্লাহ্ বলে সে নিজেকে আল্লাহর অসীম শক্তি ও অপার করুণার সাথে সংযুক্ত করে।
( ২য় পর্ব )
সুপ্রিয় পাঠক, গত পর্বে আমরা সূরা ফাতেহার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম এবং এই সুরার প্রথম আয়াত "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। এবারে আমরা এই সূরার দ্বিতীয় থেকে ৫ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। সূরা ফাতেহার দ্বিতীয় আয়াত হলো ‘‘আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন''। অর্থাৎ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি জগতসমুহের প্রতিপালক।
আল্লাহর নাম ও তাঁকে স্মরণ করার পর আমাদের প্রথম বাক্য হলো আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। জগতের সকল বৃদ্ধি, প্রতিপালন সবই তাঁর হাতে। আসমান-জমিনের সকল জীব-জন্তু, গাছ-পালা ও জড়বস্তু তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। হ্যাঁ, আল্লাহই মৌঁমাছিকে শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে খাবার সংগ্রহ করতে হবে এবং কিভাবে মধুর চাক তৈরী করতে হবে। তিনি পিঁপড়াকে শীতের খাদ্য জমা করার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিই একটি ধান থেকে অসংখ্য ধানের শীষের জন্ম দেন এবং আপেলের ক্ষুদ্র বীজ থেকে আপেল গাছ তৈরী করেন। তিনিই এই বিস্তীর্ণ আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং আসমানের প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এই আল্লাহ আমাদেরকে দূর্গন্ধময় পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং মাতৃগর্ভে ধীরে ধীরে পরিপুষ্ট করে তুলেছেন। জন্মের পর আমাদের জন্য বেড়ে ওঠার উপকরণ দান করেছেন। আমাদের দেহকে এমন ভাবে তৈরী করেছেন যাতে অসুখ-বিসুখের মোকাবেলা করতে পারে কিংবা হাড় ভেঙ্গে গেলে জোড়া লাগাতে পারে এবং দেহে রক্তের প্রয়োজন হলে পুণরায় রক্ত উৎপাদন করতে পারে। আল্লাহর হাতে যে শুধু আমাদের দৈহিক বৃদ্ধি ও লালন-পালনই নির্ভর করছে তাই নয়, আমাদের আত্মিক ও মানসিক গঠন, বিকাশ ও পথপ্রদর্শন তাঁরই হাতে। তিনি আমাদেরকে বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন এবং আমাদেরকে গড়ে তোলার জন্য প্রেরণ করেছেন আসমানী গ্রন্থ ও নবী-রাসূল। যাই হোক সূরা ফাতেহার এই আয়াত থেকে আমরা যে শিক্ষা লাভ করি তা হলো শুধু জন্ম ও সৃষ্টির ক্ষেত্রেই আমরা আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল নই বরং আমাদের প্রতিপালনও তাঁর হাতে। সৃষ্টির সাথে তাঁর সম্পর্ক চিরস্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য। তাই আমাদেরও উচিত তাঁর নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। আরেকটি বিষয় হলো শুধু দুনিয়াতেই নয়, কেয়ামতের দিনও বেহেশতবাসীদের কথা হবে-"আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন"। অর্থাৎ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।
এবারে ৩য় আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। "আর রাহমানির রাহিম" অর্থাৎ যিনি পরম করুণাময় অসীম দয়ালু। আমরা যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখি, তিনি হলেন-দয়ালু, ক্ষমাপরবশ ও পরম দয়াময়। আমাদের জন্য তিনি যে অশেষ নিয়ামত সৃষ্টি করেছেন সে সবের মধ্যে প্রতিনিয়ত তাঁর দয়া ও ভালোবাসা দেখতে পাই। সুন্দর ও সুগন্ধি ফুল, সুস্বাদু ফল-মূল, মজার মজার খাবার, রং-বেরঙের পোশাক এ সব কিছু আমাদের জন্য আল্লাহর দান। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসাকে তিনি মায়েদের মন ও প্রাণে সঁপে দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের প্রতি যে কোন মায়ের চেয়ে দয়ালু। আল্লাহর যে শাস্তি ও ক্রোধ তা কেবল গুনাহগার বান্দাদেরকে সাজা দেয়ার জন্য। কোন রকম বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসাবশত: নয়। তাই আমরা যদি তওবা করি এবং অতীতের অপরাধ পুষিয়ে নেই তাহলে তিনি আমাদের গুনাহ ও পাপকাজ ক্ষমা করে দেন এবং আমাদের দোষ ত্রুটি ঢেকে রাখেন। সূরা ফাতেহার তৃতীয় আয়াত থেকে আমাদের জন্য কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো: আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টিকে দয়া ও ভালোবাসা দিয়ে প্রতিপালন করেন। কারণ রাব্বিল আলামীনের আগে এবং পরে তিনি আররাহমানির রাহিম হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিপালনকে দুই দয়ার মাঝে স্থান দিয়েছেন। প্রতিপালন ও শিক্ষাদান দয়া ও ক্ষমা দিয়ে শুরু হয়েছে এবং দয়া ও ক্ষমা দিয়েই সম্পন্ন হয়। তাই সমাজের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শকরা যদি সফল হতে চান, তাহলে তাদেরকেও প্রেম, দয়া ও ভালবাসা নিয়ে কাজ করতে হবে।
এবারে সূরা ফাতেহার ৪র্থ আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। "মালিকি ইয়াওমিদ্দিন" অর্থাৎ বিচার দিনের মালিক। আরবী দ্বীন শব্দটির অর্থ ধর্ম ও মতবাদ। এ শব্দটি পুরস্কার ও প্রতিদান অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এখানে ইয়াওমিদ্দিন এর অর্থ হলো পুনরুত্থান দিবস। যে দিন সব কাজের হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান, শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে। অবশ্য এখানে একটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার, আর সেটি হলো আল্লাহপাক দুনিয়ারও প্রভু আবার আখেরাতেরও প্রভু। কিন্তু কেয়ামতের দিন তার মালিকানা ও প্রভুত্বের রুপ ভিন্ন সে দিন কেউ কোন কিছুর মালিক নয়। অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কিছুই নিজের বলে থাকবে না। বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনও কোন কাজে আসবে না। এমনকি নিজ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপরও মানুষের কোন অধিকার থাকবে না। না মুখ ও জিভ কোন অজুহাত দেখাতে পারবে, না মস্তিস্ক চিন্তার সুযোগ পাবে। একমাত্র আল্লাহই হবেন সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান ও নিয়ন্ত্রণকারী।
এই আয়াতটি থেকে আমাদের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো: পূর্বের আয়াতে আল্লাহর অশেষ দয়ার প্রতি আশাবাদী হবার পাশাপাশি কেয়ামতের দিনের বিচার ও হিসাব-নিকাশের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে। বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস থাকায় আমাদের ভয় ও শঙ্কার কিছু নেই। কারণ দুনিয়ার সব ভালো কাজের পুরস্কার ও প্রতিদান ঐ দিন দেয়া হবে। এ আয়াতের আরেকটি শিক্ষণীয় দিক হলো আল্লাহপাক আমাদের ভালো-মন্দ সব কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত এবং সে সব মন্দ কাজের শাস্তি ও ভালো কাজের পুরস্কার দানে সক্ষম।
সূরা ফাতেহার পঞ্চম আয়াতটি হলো। "ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাইন"। অর্থাৎ আমরা শুধু তোমারই উপাসনা করি এবং একমাত্র তোমার কাছ থেকে সাহায্য চাই।
পূর্বের আয়াতগুলোয় আমরা আল্লাহর কিছু গুণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমরা জেনেছি যে তিনি "রহমান", "রাহীম", "রাব্বুল আলামিন" এবং বিচার দিনের মালিক। এ ছাড়াও এ অন্তহীন বিশ্বজগত এবং আমাদের প্রতি তাঁর প্রশংসা জ্ঞাপন করে বলেছি "আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন"।
তাই আমাদের কর্তব্য হলো তাঁর দরবারে গিয়ে নিজের অক্ষমতা ও দূর্বলতা তুলে ধরে বলা যে-আমরা একমাত্র তোমারই বান্দা এবং একমাত্র তোমার নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো কাছে বা নির্দেশের সামনে মাথা নত করবো না। আমরা দুনিয়ার ধন দৌলতের পূজারী নই এবং শোষক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরও গোলাম নই। ব্যক্তিগত ও সামাজিক ধর্ম ইসলামের সর্বশেষ উপাসনা নামাজ জামাতে আদায় করা হয়। তাই মুসলমানরা একই কাতারে একই সাথে, এক বাক্যে বলে "ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন''। অর্থাৎ হে পরওয়ারদেগার! শুধু আমি নই, আমরা সবাই তোমার বান্দা এবং তোমার কাছ থেকেই সাহায্য কামনা করি। হে আল্লাহ! এমনকি আমাদের এবাদতও তোমার সাহায্যে করছি। তুমি আমাদের সাহায্য না করলে অন্যদের গোলাম ও দাসে পরিণত হবো।
সূরা ফাতেহার ৫ম আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার তুলে ধরছি।
এ আয়াতের প্রথম শিক্ষণীয় দিক হলো-আমরা সৃষ্টি জগতে যে একটি ব্যবস্থা বিরাজ করছে তা স্বীকার করি। তবে মনে করি এ হলো আল্লাহর প্রজ্ঞার নিদর্শন এবং এসব তারই ইচ্ছার অধীন। তাই আমরা আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পন করি; প্রকৃতির হাতে বন্দী নই। আর এমনকি বস্তুগত বিষয়েও তার সাহায্য প্রার্থনা করি। এ আয়াত থেকে আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রত্যেক নামাজে যদি আমরা গভীর উপলদ্ধির সাথে বলি যে, আমরা কেবল তোমারই বান্দা; তাহলে আমাদের মধ্য থেকে গর্ব, অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্য দূর হয়ে যাবে।
( ৩য় পর্ব )
গত দুই পর্বে আমরা সূরা হামদের এক থেকে ৫ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। তাতে আল্লাহপাক নিজেকে পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু, প্রতিপালক ও সব কিছুর মালিক বলে পরিচয় দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের ভালো ও মন্দ কাজের উপযুক্ত প্রতিদান দেবেন। আর আমরাও ঘোষণা দিয়েছি যে আমরা একমাত্র তাঁর কাছে মাথা নত করি, কেবল তাঁর উপর নির্ভর করি এবং তাঁরই উপর ভরসা করি।
এবারে আমরা এ সূরার ৬ষ্ঠ ও ৭ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। সূরা হামদের ছয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-অর্থাৎ "হে আল্লাহ্! আমাদেরকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত কর।" মানুষের জীবন যাপনের জন্য বিভিন্ন পথ রয়েছে। ব্যক্তি তার নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পথ বেছে নিতে পারে। সমাজ ও জনগণের চলার পথ, পূর্বপুরুষদের অনুসৃত পথ, জনগণের জন্য অত্যাচারী শাসক ও তাগুতী শক্তির পক্ষ থেকে নির্ধারিত পথ। একটি পথ হলো দুনিয়ার যাবতীয় রং, রুপ ও সৌন্দর্য উপভোগ করা। আবার অন্য একটি পথ হলো সমাজ জীবন থেকে বেরিয়ে একাকিত্ব ও নি:সঙ্গতা বেছে নেয়া। এত সব পথের মধ্যে সঠিক পথ বেছে নেয়ার জন্য মানুষের কি পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন নেই? আল্লাহ পাক মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য নবী রাসূল ও আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন। তাই মানুষ যদি পবিত্র কোরআন, রাসূলে খোদা (সা:) ও আহলে বাইতের অনুসরণ করে তাহলে সঠিক পথের সন্ধান পাবে। তাইতো আমরা প্রত্যেক নামাজে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যাতে তিনি আমাদেরকে সরল, সঠিক পথে পরিচালিত করেন যে পথে কোন ক্ষতি ও বিভ্রান্তি নেই, তিনি যাতে ঐ পথে আমাদেরকে পরিচালিত করেন। সরল পথ হলো মধ্যম পথ। সরল পথ মানে সব কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন এবং যেকোন ধরনের বাড়াবাড়ি বর্জন। অনেকে মূলনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির শীকার হয় এবং অনেকে কর্মক্ষেত্রে ও নৈতিক ক্ষেত্রে ভুল পথে চলে যায়। অনেকে আবার সব কাজের জন্য আল্লাহকে দায়ী করে; যেন পরিণতির ব্যাপারে মানুষের কোন হাত নেই। কেউ আবার সব কাজে নিজের ক্ষমতাকে চূড়ান্ত মনে করে যেন সৃষ্টি জগতের কাজ-কর্মে আল্লাহর কোন হাত নেই। অনেক কাফের আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নবী-রাসূলদেরকে সাধারণ মানুষ এমনকি পাগল বলেও আখ্যায়িত করেছিল। অনেক বিশ্বাসী ব্যক্তি আবার হজরত ঈসা(আ:)এর মত নবীকে খোদার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের চিন্তা ও আচরণের অর্থ হলো রাসূল এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যূত হওয়া। পবিত্র কোরআন আমাদেরকে আর্থ-সামাজিক কাজ-কর্ম ও এবাদতের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। যেমন সূরা আঁরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ "তোমরা খাও এবং পান করো। তবে অপব্যয় করোনা।" সূরা আসরা বা বনী ইসরাইলের ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে অর্থাৎ "নামাজে স্বর উঁচুও করো না আবার অতিশয় ক্ষীণও করো না। বরং এ দুইয়ের মধ্য পন্থা অবলম্বন কর। একই ভাবে সূরা ফুরকানের ৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "মুমিন ব্যক্তিরা যখন দান করে তখন তারা অপব্যয় করে না আবার কার্পণ্যও করে না। বরং তারা এ দুইয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের উপর অত্যন্ত জোর দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, "পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করো।" আবার সেখানে এও বলা হয়েছে যে, "তারা যদি তোমাকে মিথ্যা পথে পরিচালিত করতে চায় তবে তাদের আনুগত্য করবে না।" যারা কেবল সমাজ থেকে বেরিয়ে একাকি এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হয় কিংবা শুধু মানব সেবাকে এবাদত বলে, তাদের ধারনার জবাবে পবিত্র কোরআন নামাজ ও জাকাতকে পাশাপাশি বর্ণনা দিয়ে বলেছে, " তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত আদায় কর।" এর একটি স্রষ্টার সাথে সম্পর্কিত এবং অন্যটি মানুষের সাথে সম্পর্কিত এবাদত। প্রকৃত মুমিন হলো তারা- যাদের আকর্ষণও রয়েছে এবং বিকর্ষণও রয়েছে।সূরা ফাতেহার শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, "মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা:) এবং তাঁর অনুসারীরা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।
সূরা ফাতেহার ৬ নম্বর আয়াত থেকে যে বিষয়গুলো শিক্ষণীয় রয়েছে , তাহলো-সিরাতে মুস্তাকিম বা সরল পথই হলো কল্যাণের পথ। কারণ আল্লাহর সরল পথ অপরিবর্তনিয় কিন্তু মানব রচিত পথগুলো প্রতিদিন পরিবর্তীত হয়। অন্যদিকে দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী পথ হলো সরল পথ এবং এই পথ একাধিক নয়। সরল সোজা পথে কোন বাঁক নেই এবং সবচেয়ে কম সময়ে এ পথ তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। আর সুরা "হামদ" এর ৬ নম্বর আয়াতের শেষ শিক্ষা হলো-সরল সঠিক পথ নির্বাচন এবং এ পথে টিকে থাকার জন্য আল্লার কাছে সাহায্য চাওয়া। কারণ আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে পারি। এ যাবত জীবন চলার পথে কোন বিভ্রান্তির মধ্যে না পড়লেও এটা কখনোই ভাবা ঠিক নয় যে পরবর্তী জীবনেও সঠিক চলতে পারবো। আমাদের মধ্যে এমন কত লোকই না আছে যারা সারা জীবন মুমিন ছিলেন কিন্তু যখন অর্থ-সম্পদ বা কোন পদ লাভ করেছেন তখন খোদাকে ভুলে গেছে। সরল সঠিক পথ চেনা কঠিন কাজ। তাই পরবর্তী আয়াতে এ পথের বাস্তব আদর্শ এবং যারা ঐ পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরে। সূরা ফাতেহার ৭ম আয়াত হলো- হে আল্লাহ! আমাদেরকে ঐ ব্যক্তিদের পথে পরিচালিত কর, যাদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছো। তাদের পথে নয় যারা ক্রোধের শিকার এবং পথভ্রষ্ট।
জীবন চলার পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষ ৩টি দলে বিভক্ত। এক দল আল্লাহর পথ বেছে নেয় এবং আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালনা করে। এ দল সবসময় আল্লাহর রহমত, অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করে। প্রথম দলের বিপরীতে আরেকটি দল রয়েছে যারা সত্য চেনার পরও আল্লাহকে ছেড়ে গায়রুল্লাহকে বেছে নিয়েছে এবং নিজের কামনা-বাসনা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন ও সমাজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দেয়। এ দলের লোকদের মধ্যে তাদের কৃতকর্মের প্রভাব ধীরে ধীরে গেঁড়ে বসে এবং তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়। তারা আল্লাহর সান্নিধ্য এবং দয়া লাভের পরিবর্তে ধ্বংসের অতল গহ্বরে পতিত হয়, আর আল্লাহর গজবের মধ্যে পড়ে। এই আয়াতে এ দলকে "মাগদুবি আলাইহিম" বা ক্রোধ নিপতিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তৃতীয় আরেকটি দল রয়েছে যাদের কোন সুনির্দিষ্ট পথ নেই এবং কোন্ পথে চলবে তা ঠিক করতে পারেনি। তারা দিকভ্রান্ত এবং বিভ্রান্ত । এ আয়াতে তাদেরকে "দা'ল্লিন" বা পথভ্রষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তারা প্রতিদিন একেক পথ বেছে নেয় কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। আমরা প্রত্যেক নামাজে যে বলি- "হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর, তাদের পথ যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছো। নবী-রসূল, ওলী-আওলীয়া ও সৎ কর্মশীলদের পথে। তাদের পথে আমাদেরকে পরিচালিত করোনা যারা মানবতা থেকে দূরে সরে গেছে, তোমার ক্রোধের শিকার, দিক-ভ্রান্ত এবং একেক দিন একেক রুপ ধারণ করে। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, তাহলো-ক্রোধের শিকার ও পথভ্রষ্ট কারা? এর উত্তর হলো পবিত্র কোরআনে বহু দল ও ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট ও ক্রোধের শিকার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমরা এখানে একটি স্পষ্ট উদাহরণ পেশ করবো।
কোরআনে বনি ইসরাইলের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে এবং হযরত মূসা (আ:) কিভাবে তাদেরকে ফেরাউনের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন তারও বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বনী ইসরাইল বংশের লোকেরা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলায় আল্লাহ তাদেরকে ঐ যুগের সব মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-"আমি তোমাদেরকে বিশ্বে সবার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।" কিন্তু এই বনী ইসরাইল জাতিই তাদের আচরণের জন্য আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে- "তারা আল্লাহর গজবের শিকার হয়েছে"। কারণ ইহুদী পুরোহিতরা আসমানী গ্রন্থ তৌরাতের বিধান বিকৃত করেছিল। তাদের মধ্যে যারা ব্যবসায়ী ও ধনী তারা সুদ গ্রহণ ও হারাম ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছিল। এত সব বিকৃতি ও অন্যায় সত্ত্বেও বনী ইসরাইল জাতির ভালো লোকেরা নিরবতা অবলম্বন করে এবং কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তাই শেষ পর্যন্ত এ জাতি সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষ থেকে অপমান ও ধ্বংসের মধ্যে পতিত হয়।(রেডিও তেহরান)
আমাদের দৈহিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনাকারী এবং আমাদের যোগ্যতা, প্রতিভা ও ক্ষমতার বর্ণনাদানকারী কোন নির্দেশিকা বইয়ের কি কোন প্রয়োজন নেই? মানুষ কোন পথে চলবে এবং কোন পথে কি ভাবে তার শক্তি ও যোগ্যতা কাজে লাগাবে, সেসবের বর্ণনা ও দিক নির্দেশনার কি কোন প্রয়োজন নেই? যেসব বিষয় মানুষের দেহ, মন ও আত্মার জন্য ক্ষতিকর এবং তাকে অকল্যাণের দিকে পরিচালিত করে সেসবের বর্ণনার কি কোন দরকার নেই? যে মহান স্রষ্টা তার অসীম জ্ঞান, ভালোবাসা ও দয়া দিয়ে আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেবেন-এটা কি হতে পারে? না, এমনটি হতে পারে না। তাই আল্লাহপাক মানবজাতির পথ-নির্দেশনার জন্য সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে মানুষ কিভাবে সুখী হতে পারে এবং কি কারণে সে দুর্দশাগ্রস্ত হবে ও ধ্বংসের মুখে পড়বে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুস্থ সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক, মানুষের নৈতিকতা, অধিকার, দেহ ও আত্মার খোরাক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব, সমাজের সঠিক ও ভুল রীতি-নীতি, অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ব্যক্তি ও সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি এবং অকল্যাণের সাথে জড়িত বহু বিষয় এই আসমানী গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন অতীত জাতির কাহিনী, যুদ্ধ-সংঘাত, বিভিন্ন নারী-পুরুষের জীবন পদ্ধতি তুলে ধরা হলেও এটি কোন গল্পের বই নয় বরং এটি আমাদের বর্তমান জীবনের জন্য এক মহা শিক্ষণীয় বই।
তাইতো এই গ্রন্থের নাম কোরআন অর্থাৎ পাঠযোগ্য বই। এ বইটিকে তেলাওয়াত করতে হবে। অবশ্য শুধু মুখে মুখে তেলাওয়াত করলেই চলবেনা। কারণ এ ধরনের পড়াতো ছোটদের পড়া। বরং গভীর চিন্তা-ভাবনার সাথে পাঠ করতে হবে। অবশ্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক নিজেই এ ধরনের তেলাওয়াত করতে বলেছেন।
আমরা জানি পবিত্র কোরআনে ১১৪ টি সূরা রয়েছে এবং প্রত্যেক সূরায় রয়েছে বেশ কয়েকটি আয়াত। পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরাটিকে ফাতেহাতুল কিতাব বলা হয় যা কিনা সাধারণত: সূরা হামদ নামে পরিচিত। এই সূরাটি দিয়ে কোরআন শুরু হয়েছে বলে একে ফাতেহাতুল কিতাব বা সূরা ফাতেহা বলা হয়। সাত আয়াত বিশিষ্ট এ সূরার গুরুত্ব সম্পর্কে শুধু এতটুকুই বলতে হয় যে প্রতিদিন নামাজে দশ বার এই সূরা পড়া ফরজ এবং এছাড়া নামাজ শুদ্ধ হবে না। ঐশী কিতাবের সূচনাকারী এই সূরাটি এমন এক আয়াত দিয়ে শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে কোন কাজ করলে ঐ কাজের পরিণতি শুভ হয়। এবারে এ আয়াতটির উপর আলোকপাত করব। সূরা ফাতেহার প্রথম আয়াতটি হলো-
" বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" অর্থাৎ পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লার নামে।
অতীতকাল থেকে মানুষের চিরাচরিত রীতি ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোন মহৎ ও বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে শুরু করা, যাতে ঐ কাজটি সফল হয় এবং এর বরকত বাড়ে। যেমন মূর্তিপূজকেরা তাদের পূজনীয় কোন মূর্তির নাম আওড়ায় কাজের সফলতার জন্য। আজকাল রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির নামে বা তার উপস্থিতিতে বিভিন্ন কাজের উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু সব কিছুর উপরে এবং সর্বশক্তিমান হলেন, মহান আল্লাহ্। তাঁরই ইচ্ছায় অসি-ত্বের শুরু এবং বিশ্বজাহানের সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। শুধু বিশ্ব প্রকৃতি নয় বরং শরীয়ত অর্থাৎ কোরআন সহ সকল আসমানী গ্রন্থ তাঁরই নামে শুরু হয়েছে। এছাড়াও ইসলামে ছোট-বড় সব কাজ, খাওয়া-পরা, লেখা-জোখা, ভ্রমণ, ঘুমানো, ইত্যাদি যে কোন কিছু শুরুর আগে আমাদেরকে বিসমিল্লাহ্ বলতে বলা হয়েছে। কোন পশু যদি আল্লার নাম উচ্চারণ করা ছাড়া জবাই করা হয় তাহলে তার গোশ্ত খেতে নিষেধ করা হয়েছে। বিসমিল্লাহ্ শুধু ইসলাম ধর্মের নির্ধারিত কিছু নয়। কারণ পবিত্র কোরআনেই দেখা যায় হজরত নূহ(আ:)এর কিশ্তীর যাত্রা শুরু হয়েছিল বিসমিল্লাহ্ দিয়ে। হজরত সোলায়মান(আ:)ও সারা রাজ্যের রানী বিলকিসকে যে চিঠি লিখেছিলেন তা শুরু করেন বিসমিল্লাহ বলে। আমাদের বিশ্বাস-বিসমিল্লাহ একটি পূর্ণাঙ্গ আয়াত এবং সূরা ফাতেহার অংশ। কারণ রাসূলে খোদা(সা:)এর আহলে বাইত বা নবী বংশের সদস্যরা নামাজে কাউকে বিসমিল্লাহ্ পড়তে দেখলে কিংবা নি:শব্দে বিসমিল্লাহ্ বলতে দেখলে রাগ করতেন। তাঁরা নিজেরা সব নামাজে এই আয়াতটি জোরে শব্দ কোরে পড়তেন।
বিসমিল্লাহ্ থেকে আমাদের কয়েকটি প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো-প্রথমত: বিসমিল্লাহ্ ও খোদার নাম উচ্চারণ থেকে আল্লাহর প্রতি ভরসা ও তাঁর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি বোঝা যায়। আল্লাহর নাম প্রত্যেক কাজে বরকতের উৎস। দ্বিতীয়ত: বিসমিল্লাহ্ আয়াতটি প্রত্যেক কাজকে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত করে এবং মানুষের কাজকে শিরক বা অংশীবাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তৃতীয়ত: বিসমিল্লাহ্ মানে-হে আল্লাহ্ আমি তোমাকে ভুলিনি, তুমিও আমাকে ভুলো না। যে ব্যক্তি বিসমিল্লাহ্ বলে সে নিজেকে আল্লাহর অসীম শক্তি ও অপার করুণার সাথে সংযুক্ত করে।
( ২য় পর্ব )
সুপ্রিয় পাঠক, গত পর্বে আমরা সূরা ফাতেহার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম এবং এই সুরার প্রথম আয়াত "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। এবারে আমরা এই সূরার দ্বিতীয় থেকে ৫ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। সূরা ফাতেহার দ্বিতীয় আয়াত হলো ‘‘আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন''। অর্থাৎ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি জগতসমুহের প্রতিপালক।
আল্লাহর নাম ও তাঁকে স্মরণ করার পর আমাদের প্রথম বাক্য হলো আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। জগতের সকল বৃদ্ধি, প্রতিপালন সবই তাঁর হাতে। আসমান-জমিনের সকল জীব-জন্তু, গাছ-পালা ও জড়বস্তু তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। হ্যাঁ, আল্লাহই মৌঁমাছিকে শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে খাবার সংগ্রহ করতে হবে এবং কিভাবে মধুর চাক তৈরী করতে হবে। তিনি পিঁপড়াকে শীতের খাদ্য জমা করার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিই একটি ধান থেকে অসংখ্য ধানের শীষের জন্ম দেন এবং আপেলের ক্ষুদ্র বীজ থেকে আপেল গাছ তৈরী করেন। তিনিই এই বিস্তীর্ণ আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং আসমানের প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এই আল্লাহ আমাদেরকে দূর্গন্ধময় পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং মাতৃগর্ভে ধীরে ধীরে পরিপুষ্ট করে তুলেছেন। জন্মের পর আমাদের জন্য বেড়ে ওঠার উপকরণ দান করেছেন। আমাদের দেহকে এমন ভাবে তৈরী করেছেন যাতে অসুখ-বিসুখের মোকাবেলা করতে পারে কিংবা হাড় ভেঙ্গে গেলে জোড়া লাগাতে পারে এবং দেহে রক্তের প্রয়োজন হলে পুণরায় রক্ত উৎপাদন করতে পারে। আল্লাহর হাতে যে শুধু আমাদের দৈহিক বৃদ্ধি ও লালন-পালনই নির্ভর করছে তাই নয়, আমাদের আত্মিক ও মানসিক গঠন, বিকাশ ও পথপ্রদর্শন তাঁরই হাতে। তিনি আমাদেরকে বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন এবং আমাদেরকে গড়ে তোলার জন্য প্রেরণ করেছেন আসমানী গ্রন্থ ও নবী-রাসূল। যাই হোক সূরা ফাতেহার এই আয়াত থেকে আমরা যে শিক্ষা লাভ করি তা হলো শুধু জন্ম ও সৃষ্টির ক্ষেত্রেই আমরা আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল নই বরং আমাদের প্রতিপালনও তাঁর হাতে। সৃষ্টির সাথে তাঁর সম্পর্ক চিরস্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য। তাই আমাদেরও উচিত তাঁর নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। আরেকটি বিষয় হলো শুধু দুনিয়াতেই নয়, কেয়ামতের দিনও বেহেশতবাসীদের কথা হবে-"আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন"। অর্থাৎ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।
এবারে ৩য় আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। "আর রাহমানির রাহিম" অর্থাৎ যিনি পরম করুণাময় অসীম দয়ালু। আমরা যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখি, তিনি হলেন-দয়ালু, ক্ষমাপরবশ ও পরম দয়াময়। আমাদের জন্য তিনি যে অশেষ নিয়ামত সৃষ্টি করেছেন সে সবের মধ্যে প্রতিনিয়ত তাঁর দয়া ও ভালোবাসা দেখতে পাই। সুন্দর ও সুগন্ধি ফুল, সুস্বাদু ফল-মূল, মজার মজার খাবার, রং-বেরঙের পোশাক এ সব কিছু আমাদের জন্য আল্লাহর দান। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসাকে তিনি মায়েদের মন ও প্রাণে সঁপে দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের প্রতি যে কোন মায়ের চেয়ে দয়ালু। আল্লাহর যে শাস্তি ও ক্রোধ তা কেবল গুনাহগার বান্দাদেরকে সাজা দেয়ার জন্য। কোন রকম বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসাবশত: নয়। তাই আমরা যদি তওবা করি এবং অতীতের অপরাধ পুষিয়ে নেই তাহলে তিনি আমাদের গুনাহ ও পাপকাজ ক্ষমা করে দেন এবং আমাদের দোষ ত্রুটি ঢেকে রাখেন। সূরা ফাতেহার তৃতীয় আয়াত থেকে আমাদের জন্য কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো: আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টিকে দয়া ও ভালোবাসা দিয়ে প্রতিপালন করেন। কারণ রাব্বিল আলামীনের আগে এবং পরে তিনি আররাহমানির রাহিম হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিপালনকে দুই দয়ার মাঝে স্থান দিয়েছেন। প্রতিপালন ও শিক্ষাদান দয়া ও ক্ষমা দিয়ে শুরু হয়েছে এবং দয়া ও ক্ষমা দিয়েই সম্পন্ন হয়। তাই সমাজের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শকরা যদি সফল হতে চান, তাহলে তাদেরকেও প্রেম, দয়া ও ভালবাসা নিয়ে কাজ করতে হবে।
এবারে সূরা ফাতেহার ৪র্থ আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। "মালিকি ইয়াওমিদ্দিন" অর্থাৎ বিচার দিনের মালিক। আরবী দ্বীন শব্দটির অর্থ ধর্ম ও মতবাদ। এ শব্দটি পুরস্কার ও প্রতিদান অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এখানে ইয়াওমিদ্দিন এর অর্থ হলো পুনরুত্থান দিবস। যে দিন সব কাজের হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান, শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে। অবশ্য এখানে একটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার, আর সেটি হলো আল্লাহপাক দুনিয়ারও প্রভু আবার আখেরাতেরও প্রভু। কিন্তু কেয়ামতের দিন তার মালিকানা ও প্রভুত্বের রুপ ভিন্ন সে দিন কেউ কোন কিছুর মালিক নয়। অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কিছুই নিজের বলে থাকবে না। বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনও কোন কাজে আসবে না। এমনকি নিজ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপরও মানুষের কোন অধিকার থাকবে না। না মুখ ও জিভ কোন অজুহাত দেখাতে পারবে, না মস্তিস্ক চিন্তার সুযোগ পাবে। একমাত্র আল্লাহই হবেন সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান ও নিয়ন্ত্রণকারী।
এই আয়াতটি থেকে আমাদের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো: পূর্বের আয়াতে আল্লাহর অশেষ দয়ার প্রতি আশাবাদী হবার পাশাপাশি কেয়ামতের দিনের বিচার ও হিসাব-নিকাশের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে। বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস থাকায় আমাদের ভয় ও শঙ্কার কিছু নেই। কারণ দুনিয়ার সব ভালো কাজের পুরস্কার ও প্রতিদান ঐ দিন দেয়া হবে। এ আয়াতের আরেকটি শিক্ষণীয় দিক হলো আল্লাহপাক আমাদের ভালো-মন্দ সব কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত এবং সে সব মন্দ কাজের শাস্তি ও ভালো কাজের পুরস্কার দানে সক্ষম।
সূরা ফাতেহার পঞ্চম আয়াতটি হলো। "ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাইন"। অর্থাৎ আমরা শুধু তোমারই উপাসনা করি এবং একমাত্র তোমার কাছ থেকে সাহায্য চাই।
পূর্বের আয়াতগুলোয় আমরা আল্লাহর কিছু গুণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমরা জেনেছি যে তিনি "রহমান", "রাহীম", "রাব্বুল আলামিন" এবং বিচার দিনের মালিক। এ ছাড়াও এ অন্তহীন বিশ্বজগত এবং আমাদের প্রতি তাঁর প্রশংসা জ্ঞাপন করে বলেছি "আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন"।
তাই আমাদের কর্তব্য হলো তাঁর দরবারে গিয়ে নিজের অক্ষমতা ও দূর্বলতা তুলে ধরে বলা যে-আমরা একমাত্র তোমারই বান্দা এবং একমাত্র তোমার নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো কাছে বা নির্দেশের সামনে মাথা নত করবো না। আমরা দুনিয়ার ধন দৌলতের পূজারী নই এবং শোষক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরও গোলাম নই। ব্যক্তিগত ও সামাজিক ধর্ম ইসলামের সর্বশেষ উপাসনা নামাজ জামাতে আদায় করা হয়। তাই মুসলমানরা একই কাতারে একই সাথে, এক বাক্যে বলে "ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন''। অর্থাৎ হে পরওয়ারদেগার! শুধু আমি নই, আমরা সবাই তোমার বান্দা এবং তোমার কাছ থেকেই সাহায্য কামনা করি। হে আল্লাহ! এমনকি আমাদের এবাদতও তোমার সাহায্যে করছি। তুমি আমাদের সাহায্য না করলে অন্যদের গোলাম ও দাসে পরিণত হবো।
সূরা ফাতেহার ৫ম আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার তুলে ধরছি।
এ আয়াতের প্রথম শিক্ষণীয় দিক হলো-আমরা সৃষ্টি জগতে যে একটি ব্যবস্থা বিরাজ করছে তা স্বীকার করি। তবে মনে করি এ হলো আল্লাহর প্রজ্ঞার নিদর্শন এবং এসব তারই ইচ্ছার অধীন। তাই আমরা আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পন করি; প্রকৃতির হাতে বন্দী নই। আর এমনকি বস্তুগত বিষয়েও তার সাহায্য প্রার্থনা করি। এ আয়াত থেকে আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রত্যেক নামাজে যদি আমরা গভীর উপলদ্ধির সাথে বলি যে, আমরা কেবল তোমারই বান্দা; তাহলে আমাদের মধ্য থেকে গর্ব, অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্য দূর হয়ে যাবে।
( ৩য় পর্ব )
গত দুই পর্বে আমরা সূরা হামদের এক থেকে ৫ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। তাতে আল্লাহপাক নিজেকে পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু, প্রতিপালক ও সব কিছুর মালিক বলে পরিচয় দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের ভালো ও মন্দ কাজের উপযুক্ত প্রতিদান দেবেন। আর আমরাও ঘোষণা দিয়েছি যে আমরা একমাত্র তাঁর কাছে মাথা নত করি, কেবল তাঁর উপর নির্ভর করি এবং তাঁরই উপর ভরসা করি।
এবারে আমরা এ সূরার ৬ষ্ঠ ও ৭ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। সূরা হামদের ছয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-অর্থাৎ "হে আল্লাহ্! আমাদেরকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত কর।" মানুষের জীবন যাপনের জন্য বিভিন্ন পথ রয়েছে। ব্যক্তি তার নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পথ বেছে নিতে পারে। সমাজ ও জনগণের চলার পথ, পূর্বপুরুষদের অনুসৃত পথ, জনগণের জন্য অত্যাচারী শাসক ও তাগুতী শক্তির পক্ষ থেকে নির্ধারিত পথ। একটি পথ হলো দুনিয়ার যাবতীয় রং, রুপ ও সৌন্দর্য উপভোগ করা। আবার অন্য একটি পথ হলো সমাজ জীবন থেকে বেরিয়ে একাকিত্ব ও নি:সঙ্গতা বেছে নেয়া। এত সব পথের মধ্যে সঠিক পথ বেছে নেয়ার জন্য মানুষের কি পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন নেই? আল্লাহ পাক মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য নবী রাসূল ও আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন। তাই মানুষ যদি পবিত্র কোরআন, রাসূলে খোদা (সা:) ও আহলে বাইতের অনুসরণ করে তাহলে সঠিক পথের সন্ধান পাবে। তাইতো আমরা প্রত্যেক নামাজে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যাতে তিনি আমাদেরকে সরল, সঠিক পথে পরিচালিত করেন যে পথে কোন ক্ষতি ও বিভ্রান্তি নেই, তিনি যাতে ঐ পথে আমাদেরকে পরিচালিত করেন। সরল পথ হলো মধ্যম পথ। সরল পথ মানে সব কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন এবং যেকোন ধরনের বাড়াবাড়ি বর্জন। অনেকে মূলনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির শীকার হয় এবং অনেকে কর্মক্ষেত্রে ও নৈতিক ক্ষেত্রে ভুল পথে চলে যায়। অনেকে আবার সব কাজের জন্য আল্লাহকে দায়ী করে; যেন পরিণতির ব্যাপারে মানুষের কোন হাত নেই। কেউ আবার সব কাজে নিজের ক্ষমতাকে চূড়ান্ত মনে করে যেন সৃষ্টি জগতের কাজ-কর্মে আল্লাহর কোন হাত নেই। অনেক কাফের আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নবী-রাসূলদেরকে সাধারণ মানুষ এমনকি পাগল বলেও আখ্যায়িত করেছিল। অনেক বিশ্বাসী ব্যক্তি আবার হজরত ঈসা(আ:)এর মত নবীকে খোদার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের চিন্তা ও আচরণের অর্থ হলো রাসূল এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যূত হওয়া। পবিত্র কোরআন আমাদেরকে আর্থ-সামাজিক কাজ-কর্ম ও এবাদতের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। যেমন সূরা আঁরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ "তোমরা খাও এবং পান করো। তবে অপব্যয় করোনা।" সূরা আসরা বা বনী ইসরাইলের ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে অর্থাৎ "নামাজে স্বর উঁচুও করো না আবার অতিশয় ক্ষীণও করো না। বরং এ দুইয়ের মধ্য পন্থা অবলম্বন কর। একই ভাবে সূরা ফুরকানের ৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ "মুমিন ব্যক্তিরা যখন দান করে তখন তারা অপব্যয় করে না আবার কার্পণ্যও করে না। বরং তারা এ দুইয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের উপর অত্যন্ত জোর দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, "পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করো।" আবার সেখানে এও বলা হয়েছে যে, "তারা যদি তোমাকে মিথ্যা পথে পরিচালিত করতে চায় তবে তাদের আনুগত্য করবে না।" যারা কেবল সমাজ থেকে বেরিয়ে একাকি এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হয় কিংবা শুধু মানব সেবাকে এবাদত বলে, তাদের ধারনার জবাবে পবিত্র কোরআন নামাজ ও জাকাতকে পাশাপাশি বর্ণনা দিয়ে বলেছে, " তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত আদায় কর।" এর একটি স্রষ্টার সাথে সম্পর্কিত এবং অন্যটি মানুষের সাথে সম্পর্কিত এবাদত। প্রকৃত মুমিন হলো তারা- যাদের আকর্ষণও রয়েছে এবং বিকর্ষণও রয়েছে।সূরা ফাতেহার শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, "মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা:) এবং তাঁর অনুসারীরা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।
সূরা ফাতেহার ৬ নম্বর আয়াত থেকে যে বিষয়গুলো শিক্ষণীয় রয়েছে , তাহলো-সিরাতে মুস্তাকিম বা সরল পথই হলো কল্যাণের পথ। কারণ আল্লাহর সরল পথ অপরিবর্তনিয় কিন্তু মানব রচিত পথগুলো প্রতিদিন পরিবর্তীত হয়। অন্যদিকে দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী পথ হলো সরল পথ এবং এই পথ একাধিক নয়। সরল সোজা পথে কোন বাঁক নেই এবং সবচেয়ে কম সময়ে এ পথ তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। আর সুরা "হামদ" এর ৬ নম্বর আয়াতের শেষ শিক্ষা হলো-সরল সঠিক পথ নির্বাচন এবং এ পথে টিকে থাকার জন্য আল্লার কাছে সাহায্য চাওয়া। কারণ আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে পারি। এ যাবত জীবন চলার পথে কোন বিভ্রান্তির মধ্যে না পড়লেও এটা কখনোই ভাবা ঠিক নয় যে পরবর্তী জীবনেও সঠিক চলতে পারবো। আমাদের মধ্যে এমন কত লোকই না আছে যারা সারা জীবন মুমিন ছিলেন কিন্তু যখন অর্থ-সম্পদ বা কোন পদ লাভ করেছেন তখন খোদাকে ভুলে গেছে। সরল সঠিক পথ চেনা কঠিন কাজ। তাই পরবর্তী আয়াতে এ পথের বাস্তব আদর্শ এবং যারা ঐ পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরে। সূরা ফাতেহার ৭ম আয়াত হলো- হে আল্লাহ! আমাদেরকে ঐ ব্যক্তিদের পথে পরিচালিত কর, যাদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছো। তাদের পথে নয় যারা ক্রোধের শিকার এবং পথভ্রষ্ট।
জীবন চলার পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষ ৩টি দলে বিভক্ত। এক দল আল্লাহর পথ বেছে নেয় এবং আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালনা করে। এ দল সবসময় আল্লাহর রহমত, অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করে। প্রথম দলের বিপরীতে আরেকটি দল রয়েছে যারা সত্য চেনার পরও আল্লাহকে ছেড়ে গায়রুল্লাহকে বেছে নিয়েছে এবং নিজের কামনা-বাসনা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন ও সমাজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দেয়। এ দলের লোকদের মধ্যে তাদের কৃতকর্মের প্রভাব ধীরে ধীরে গেঁড়ে বসে এবং তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়। তারা আল্লাহর সান্নিধ্য এবং দয়া লাভের পরিবর্তে ধ্বংসের অতল গহ্বরে পতিত হয়, আর আল্লাহর গজবের মধ্যে পড়ে। এই আয়াতে এ দলকে "মাগদুবি আলাইহিম" বা ক্রোধ নিপতিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তৃতীয় আরেকটি দল রয়েছে যাদের কোন সুনির্দিষ্ট পথ নেই এবং কোন্ পথে চলবে তা ঠিক করতে পারেনি। তারা দিকভ্রান্ত এবং বিভ্রান্ত । এ আয়াতে তাদেরকে "দা'ল্লিন" বা পথভ্রষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তারা প্রতিদিন একেক পথ বেছে নেয় কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। আমরা প্রত্যেক নামাজে যে বলি- "হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর, তাদের পথ যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছো। নবী-রসূল, ওলী-আওলীয়া ও সৎ কর্মশীলদের পথে। তাদের পথে আমাদেরকে পরিচালিত করোনা যারা মানবতা থেকে দূরে সরে গেছে, তোমার ক্রোধের শিকার, দিক-ভ্রান্ত এবং একেক দিন একেক রুপ ধারণ করে। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, তাহলো-ক্রোধের শিকার ও পথভ্রষ্ট কারা? এর উত্তর হলো পবিত্র কোরআনে বহু দল ও ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট ও ক্রোধের শিকার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমরা এখানে একটি স্পষ্ট উদাহরণ পেশ করবো।
কোরআনে বনি ইসরাইলের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে এবং হযরত মূসা (আ:) কিভাবে তাদেরকে ফেরাউনের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন তারও বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বনী ইসরাইল বংশের লোকেরা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলায় আল্লাহ তাদেরকে ঐ যুগের সব মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-"আমি তোমাদেরকে বিশ্বে সবার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।" কিন্তু এই বনী ইসরাইল জাতিই তাদের আচরণের জন্য আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে- "তারা আল্লাহর গজবের শিকার হয়েছে"। কারণ ইহুদী পুরোহিতরা আসমানী গ্রন্থ তৌরাতের বিধান বিকৃত করেছিল। তাদের মধ্যে যারা ব্যবসায়ী ও ধনী তারা সুদ গ্রহণ ও হারাম ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছিল। এত সব বিকৃতি ও অন্যায় সত্ত্বেও বনী ইসরাইল জাতির ভালো লোকেরা নিরবতা অবলম্বন করে এবং কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তাই শেষ পর্যন্ত এ জাতি সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষ থেকে অপমান ও ধ্বংসের মধ্যে পতিত হয়।(রেডিও তেহরান)