সূরা বাকারাহ; (২৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ; (২৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 17:34:35 4-10-1403

 

সূরা বাকারাহ; আয়াত ৮৫-৮৮

সূরা বাকারাহ'র ৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে-


ثُمَّ أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ تَقْتُلُونَ أَنْفُسَكُمْ وَتُخْرِجُونَ فَرِيقًا مِنْكُمْ مِنْ دِيَارِهِمْ تَظَاهَرُونَ عَلَيْهِمْ بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَإِنْ يَأْتُوكُمْ أُسَارَى تُفَادُوهُمْ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْكُمْ إِخْرَاجُهُمْ أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ

 

"অতঃপর সেই তোমরাই প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও তোমাদের একে অন্যকে হত্যা করছ এবং তোমরাই একদলকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বের করে দিচ্ছ, তোমরা তাদের প্রতি অন্যায় ও সীমা লঙ্ঘনে পরস্পরকে সাহায্য করছ এবং তারা বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসলে তোমরা মুক্তিপণ নাও। অথচ তাদেরকে বহিষ্কার করাই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশ অবিশ্বাস কর ? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তারা পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া অন্য কিছু পাবে না এবং পুনরুত্থান বা কিয়ামতের দিনে তারা কঠোর শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে। আর তোমরা যা কিছু করছ আল্লাহ সে সম্পর্কে উদাসীন নন।" (২:৮৫)

এ আয়াতে বনী ইসরাইলকে তিরস্কার করে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে একে অন্যকে হত্যা করেছে এবং তাদেরই একদলকে মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করেছে। অথচ অদ্ভুত বিষয় হলো, তারা তাওরাত গ্রন্থের বিধান অনুযায়ী বন্দীদের মুক্তি দেয়ার জন্য মুক্তিপণ নেয়। মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দেয়া যেমন তাওরাতের বিধান তেমনি হত্যা না করা ও কাউকে তার ঘর বাড়ী থেকে তাড়িয়ে না দেয়াও তাওরাতের বিধান। প্রকৃতপক্ষে তোমরা আসমানী গ্রন্থের পরিবর্তে প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়েছিল। তারা খোদার যেসব বিধানকে নিজেদের রুচি ও ইচ্ছের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মনে করতো শুধু সেগুলোকেই মান্য করতো,আর নিজেদের মনমত না হলে আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করতে।

এই আয়াত অনুযায়ী মানুষের প্রকৃত ঈমানের পরিচয় পাওয়া যায় তার কাজে-যেসব কাজের জন্য আল্লাহই নির্দেশ দিয়েছেন। ঈমানের পরিচয় সে ধরনের কাজে পাওয়া যায় না যেসব কাজ মানুষ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পছন্দ অনুযায়ী কারে থাকে। কারণ এ ধরনের কাজ আল্লাহর ইবাদত নয় বরং নিজেরই পূজা বা উপাসনা। শুধু পাপ করা নয়, পাপীকে সহযোগিতা করাও নিষিদ্ধ। রাসূল (সাঃ)-এর আহলে বাইত হযরত ইমাম কাজেম (আঃ) একজন মুসলমানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশীদের দরবারের জন্য উট ভাড়া দেয়া জায়েজ নয়। যদি তারা হজ্বে যাবার জন্যেও ভাড়া নিতে চায় তবুও উট ভাড়া দেয়া জায়েজ হবে না। কারণ তারা সফর থেকে নিরাপদে ফিরে এসে তোমাকে ভাড়ার অর্থ পরিশোধ করুক এটাই তুমি চাইবে। কিন্তু কোন অত্যাচারী বেশি দিন বেঁচে থাকুক এই কামনা করাও তো পাপ।

এবারে সূরা বাকারাহ'র ৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآَخِرَةِ فَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ

"এরাই পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করেছে। সুতরাং তাদের শাস্তি হ্রাস করা হবে না এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে না।"(২:৮৬)

এই আয়াতে আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করা, হত্যা করা এবং অন্যদেরকে ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বনী ইসরাইলীরা শুধু দুনিয়ার জীবনের পিছনেই ছুটছে এবং শুধু নিজেদের স্বার্থ রক্ষাকারী বিধানগুলোই পালন করছে। কিন্তু আখেরাতের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ের প্রতি তারা উদাসীন। এত দুনিয়া পূজা ও পাপ করা সত্ত্বেও ইহুদীরা পরকালে শাস্তি পাবে না বলে দাবি করতো। কিন্তু এই আয়াতে বলা হয়েছে যে,তাদের এই দূরাশার বিপরীতে অন্যান্য পাপীদের মত তারাও তাদের পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করবে এবং কেউই তাদের সাহায্য করবে না।

এরপর ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


وَلَقَدْ آَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ وَآَتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ بِمَا لَا تَهْوَى أَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ

"অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি। এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রসূল পাঠিয়েছি। আমি মরিয়ম তনয় ঈসাকে সুস্পষ্ট মোজেযা দান করেছি এবং পবিত্র রূহের মাধ্যমে তাকে শক্তিদান করেছি। অতঃপর যখনই কোন রসূল এমন নির্দেশ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে, যা তোমাদের মনে ভাল লাগেনি, তখনই তোমরা অহংকার করেছ। শেষ পর্যন্ত তোমরা একদলকে মিথ্যাবাদী বলেছ এবং একদলকে হত্যা করেছ।" (২: ৮৭)

এ আয়াতে মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর অবিরাম অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে মহান আল্লাহ মূসা (আঃ)এর পর বনী ইসরাইলের কাছে অন্যান্য নবীদের পাঠিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন অন্যতম। কিন্তু ইহুদীরা দুনিয়াপূজা ও আত্মপূজার কারণে নিজেদের অবাধ্যতার চিরাচরিত রীতি অনুসরণের মাধ্যমে ঐসব নবীদের অস্বীকার করেছে, এমনকি তাদের অনেককে শহীদ করেছে। কারণ নবীরা ইহুদীদের অবৈধ দাবি মেনে নিতে রাজি হননি।

৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


وَقَالُوا قُلُوبُنَا غُلْفٌ بَلْ لَعَنَهُمُ اللَّهُ بِكُفْرِهِمْ فَقَلِيلًا مَا يُؤْمِنُونَ

"তারা (নবীদেরকে) বলেছিল, আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত, (আমরা তোমাদের বক্তব্যের কিছুই বুঝি না)। আসলে তা নয় বরং অবাধ্যতার জন্য আল্লাহ তাদের অভিশাপ দিয়েছেন (আর এ জন্যই তারা বুঝতে পারছে না) এবং তাদের অল্প সংখ্যকই বিশ্বাস করে। " (২:৮৮)

দাম্ভিক ও অবাধ্য ইহুদীরা নবীদের আহ্বানের জবাবে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে বলতো আমরা এসব কথা বুঝি না এবং যা আমরা বুঝতে পারি না তা গ্রহণও করতে পারব না। পবিত্র কোরআন তাদের এই বিদ্রুপের জবাবে বলেছে, নবীদের বক্তব্য জনগণের জন্য দুর্বোধ্য নয়। আসলে গোয়ার্তুমি ও সত্যকে ঢাকা দেয়ার চেতনার কারণেই একদল ইহুদী সত্যকে বুঝতে পারছে না এবং তারা খুব কমই বিশ্বাস করে। নফস বা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে আত্মপূজার প্রবল চেতনা তাদের চিন্তাধারা ও হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে এবং তারা সত্য ও বাস্তবতাকে পার্থিব বা বৈষয়িক দৃষ্টি দিয়ে দেখে বলে শুধু বাহ্যিক দিকই দেখতে পায়। আর এ জন্যেই তারা ঐশী জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে।

এ আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,

এক. আমাদেরকে আল্লাহর সকল বিধান মেনে নিতে হবে। যেসব বিধান আমাদের পছন্দের বা মনপুত শুধু সেসব মানলেই হবে না। যদি আমরা আল্লাহর বিধান মানার ক্ষেত্রে শুধু পছন্দনীয় বিধানগুলো মানি আর অপছন্দনীয় বিধানগুলো না মানি তাহলে তা হবে আল্লাহর অনুগত্যের পরিবর্তে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ।
দুই. আমরা যা-ই করি না কেন আল্লাহ যে তা দেখছেন তা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং এটা মনে রাখতে হবে যে আমরা আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীন হলেও আল্লাহ আমাদের ব্যাপারে কখনো উদাসীন নন। আমরা যা কিছু করছি সে সম্পর্কে আল্লাহ সবই জানেন।
তিন. আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সকল মানুষ সমান। অনেকে মনে করেন তাদের জাতি সেরা এবং আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয়। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। আর এ ধরনের ভুল ধারণার বা দূরাশার জন্য অপরাধীদের শাস্তি মোটেও হ্রাস পাবে না।
চার. আল্লাহ মানুষের মুক্তির জন্য অনেক নবী পাঠিয়েছেন। কিন্তু মানুষ কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে নবীদেরকে অস্বীকার করেছে এবং অনেক নবীকে শহীদও করেছে।