সূরা আন নিসা;(১ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা;(১ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:51:23 4-10-1403

সূরা আন নিসা; আয়াত ১-৩

সূরা আন নিসায় মোট ১৭৬টি আয়াত রয়েছে। এ আয়াতগুলো মদীনায় নাজিল হয়েছিল। এই সূরার অধিকাংশ আয়াতে পরিবারে মহিলাদের অধিকার এবং পারিবারিক বিষয়ে বক্তব্য থাকায় এর নাম হয়েছে সূরা নিসা।

সূরা নিসার এক নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا ((১

"হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। যিনি তোমাদের একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সহধর্মিনী সৃষ্টি করেছেন। যিনি তাদের দু'জন থেকে পৃথিবীতে বহু নর-নারী বিস্তার করেছেন। সেই আল্লাহকে ভয় কর,যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে আবেদন কর। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করাকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন।" (৪:১)

সূরা নিসার প্রথম আয়াতেই দু'দু'বার খোদাভীরু হবার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্ম, প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারেই হয়ে থাকে। তাই পরিবারের এসব ভিত্তি যদি আল্লাহর আইন অনুযায়ী না হয়,তাহলে ব্যক্তি ও সমাজের মানসিক সুস্থতা বলতে কিছুই থাকবে না। আল্লাহ মানুষের মধ্যে নিজেকেই বড় ভাবার যে কোন ইচ্ছা বা ঝোঁক প্রবণতাকে প্রত্যাখ্যান করে বলছেন,সমস্ত মানুষকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই বংশ,বর্ণ ও ভাষাকে শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ মনে না করে বরং খোদাভীরু হওয়াকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি মনে করা উচিত। এমনকি নারী ও পুরুষের মধ্যে মানসিক এবং দৈহিক পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের কেউই একে অপরের চেয়ে বড় নয়। কারণ সমস্ত নারী ও পুরুষ একজন পুরুষ এবং নারী থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে।

পবিত্র কোরআনের অন্য এক আয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের পরই মা-বাবার প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। এভাবে তাদের উচ্চ মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। আর এই আয়াতে আল্লাহর নামের পর সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের অধিকার রক্ষার আআহ্বান জানানো হয়েছে এবং তাদের প্রতি যাতে কোন রকম অবিচার করা না হয় সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ইসলাম একটি সামাজিক ধর্ম। তাই এ ধর্মে সমাজ ও পরিবারে পরস্পরের সম্পর্কের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। খোদাভীরু হবার জন্যে এবং আল্লাহর ইবাদত তথা দাসত্ব করার জন্যে অন্যদের অধিকার রক্ষা জরুরী।
দ্বিতীয়ত : মানব সমাজকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং প্রত্যেক মানুষকেই মানব সমাজের সম্মানিত সদস্য হিসেবে ধরে নিয়ে অন্যদের সমান অধিকার দিতে হবে। কারণ,মানুষের মধ্যে অঞ্চল,বর্ণ,গোষ্ঠী ও ভাষার ভিত্তিতে বৈষম্য করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকেই একই উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছেন।
তৃতীয়ত : গোটা মানব জাতি একে অপরের আত্মীয়। কারণ,তাদের সবার আদি পিতা ও মাতা ছিলেন হযরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া। তাই সব মানুষকেই ভালবাসতে হবে এবং তাদেরকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনের মতই শ্রদ্ধা করতে হবে।

সূরা নিসার দুই নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَآَتُوا الْيَتَامَى أَمْوَالَهُمْ وَلَا تَتَبَدَّلُوا الْخَبِيثَ بِالطَّيِّبِ وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَى أَمْوَالِكُمْ إِنَّهُ كَانَ حُوبًا كَبِيرًا (২)

"এতিমদের প্রাপ্য সম্পদ তাদেরকে দাও,নিজেদের খারাপ সম্পদ এতিমদের দিয়ে এতিমদের ভালো সম্পদ কেড়ে নিও না। তাদের সম্পদ তোমাদের সম্পদের সাথে মিশিয়ে গ্রাস কর না। নিশ্চয়ই এটা মহা পাপ।" (৪:২)

এ আয়াতে এতিমদের সম্পদ আত্মসাৎ করা অথবা ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী এতিমদের যতটুকু সম্পদ পাওনা তারচেয়ে কম দেয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে এতিমদের ভালো সম্পদ নিয়ে এর বিনিময়ে তাদেরকে নিজের কম মূল্যবান সম্পদ দেয়া এবং যে কোন পন্থায় তাদের সম্পদ গ্রাস করাকেও মহাপাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ,এতিমের অভিভাবকরা হল তাদের ধন সম্পদের আমানতদার এবং এতিম শিশুরা বড় হলে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দেয়াও এ সব অভিভাবকদের দায়িত্ব। তাই এতিমদের সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে করে যাচ্ছে তাই কাজ করা যাবে না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমতঃ এতিমদের সম্পদ অবশ্যই তাদেরকে দিতে হবে। তারা তাদের সম্পদের কথা না জানলেও অথবা ভুলে গেলেও এটাই অভিভাবকদের কর্তব্য।
দ্বিতীয়তঃ শিশুরাও সম্পদের মালিক হয়। অবশ্য তারা প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত নিজস্ব সম্পদ দখলের অধিকার রাখে না।
তৃতীয়তঃ ইসলাম বঞ্চিত ও অভিভাবকহীন ব্যক্তিদের প্রতি গুরুত্ব দেয় এবং তাদের সহায়তা করে।

সূরা নিসার তিন নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَى فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ مَثْنَى وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ذَلِكَ أَدْنَى أَلَّا تَعُولُوا ( (৩


"যদি তোমরা এতিম কন্যাদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না বলে আশঙ্কা কর,তাহলে তাদেরকে বিয়ে কর না এবং পবিত্র ও পছন্দনীয় নারীদের মধ্য থেকে দু'জন,তিনজন বা চারজনকে বিয়ে কর। কিন্তু যদি আশঙ্কা কর ন্যায় বিচার করতে পারবে না,তাহলে একটি মাত্র বিয়ে করবে,অথবা তাও যদি না পার,তবে তোমাদের অধিকারভূক্ত দাসীদেরকে বিয়ে করবে,এতে অবিচার না হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।" (৪:৩)

এতিম সংক্রান্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে এতিম কন্যাদের কথা বলা হয়েছে। এতিম কন্যাদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো তারা এতিম ছেলে শিশুদের তুলনায় বেশী বঞ্চিত ও অত্যাচারের শিকার হয়। তাই ন্যায় বিচারক মহান আল্লাহ বলছেন, এতিম কন্যাদের ওপর যে কোন অন্যায় আচরণ নিষিদ্ধ। অনেক স্বার্থান্বেষী মানুষ এতিম কন্যাদের সম্পত্তি দখলের জন্য তাদেরকে বিয়ে করতে চায় এবং এ জন্যে সব ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। কিন্তু আল্লাহ বলছেন,তোমরা এতিম কন্যাদের বিয়ে করার ফলে তাদের প্রতি যদি সামান্য জুলুমেরও আশঙ্কা থাকে,তবে তাদের বিয়ে কর না।

বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনায় বলা হয়েছে,এক শ্রেণীর লোভী মানুষ এতিম কন্যাদেরকে লালন পালনের নামে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসতো এবং কিছুকাল পর ওইসব কন্যাদেরকে বিয়ে করে তাদের সম্পত্তি দখল করতো। তাদেরকে বিয়ের মোহরানাও প্রচলিত রীতির তুলনায় অত্যন্ত কম দেয়া হতো। এ অবস্থায় এতিম কন্যাদের ওপর যে কোন অবিচারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এই আয়াতসহ সূরা নিসার ১২৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। বহু পুরুষ তাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় অথবা চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে এতিম কন্যাদেরকে বিয়ে করতো। আল্লাহ তাদের মর্যাদা রক্ষার জন্য এ সব পুরুষদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,যদি নতুন বিয়ের ইচ্ছে থাকে তাহলে কেন শুধু এতিম কন্যাদের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছ? অন্যান্য মেয়েদেরকেও বিয়ের প্রস্তাব দাও অথবা অন্তত তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকেই বিয়ে কর। 
এই আয়াতে পুরুষদেরকে চারটি বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে,যদিও এই রীতি ইসলামের আবিস্কার নয় বরং সামাজিক কারণে চার বিবাহ কোন কোন অবস্থায় অতীতের মত এ যুগেও অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। আসলে ইসলাম ধর্ম বহু বিবাহ প্রথা চালু করেনি,বরং সামাজিক বাস্তবতা হিসেবে বিরাজমান এই প্রথাকে বিশেষ নিয়মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত করেছে। ইসলাম এক্ষেত্রে অর্থাৎ একাধিক বা চার বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার শর্ত বেঁধে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন,"যদি তোমরা স্ত্রীদের সবার সঙ্গে সমান ও ন্যায় আচরণ করতে পারবে না বলে ভয় কর,তাহলে একের বেশী স্ত্রী গ্রহণ করা বৈধ নয়।"
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
এক. এতিম কন্যাদের সম্পদ ও সম্মান নিয়ে হেলাফেলা বন্ধের জন্য তাদের সাথে সব সময় এমনকি বিয়ের সময়ও ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।

দুই. স্বামী ও স্ত্রী নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হলো,অন্তর দিয়ে পছন্দ করা পুরুষকে জোরপূর্বক কারো সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করা বৈধ নয়।

তিন. একই সাথে চার জন স্ত্রী রাখা ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত । কিন্তু কোন কোন পুরুষ যদি এ আইনের অপব্যবহার করে,তাহলে এ আইনটি ভাল নয় এমন বলা যাবে না। বরং এটা সমাজের বিশেষ প্রয়োজন বা চাহিদা মেটানোর প্রতি ইসলাম ধর্মের উদার নীতির প্রকাশ।