সূরা আলে ইমরান;(১১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(১১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:35:42 4-10-1403

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ৫৪-৬০

সূরা আলে ইমরানের ৫৪ ও ৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ (৫৪) إِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (৫৫)

"ঈসার শত্রুরা তাঁকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল এবং আল্লাহও কৌশল করলেন। আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।" (৩:৫৪)
"স্মরণ করো!যখন আল্লাহ বললেন : হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে ইহুদীদের কাছ থেকে উঠিয়ে নেব এবং তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেব ও কাফেরদের কাছ থেকে তোমাকে পবিত্র করবো। আর যারা অবিশ্বাস করেছে,তাদের ওপর তোমার অনুসারীদের কর্তৃত্ব কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষুন্ন রাখবো। আমার দিকেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে এবং তোমাদের মধ্যে যে বিষয়ে মতভেদ ছিল আমি তার মীমাংসা করব।" (৩:৫৫)

আমরা এর আগে আলোচনা করেছিলাম হযরত ঈসা (আঃ)'র কাছ থেকে অনেক মোজেজা বা অলৌকিক নিদর্শন দেখার পরও অনেকেই তাঁকে ও তাঁর বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে। এই অবিশ্বাসীরা তাঁকে হত্যা করারও ষড়যন্ত্র করে,যাতে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রচার করতে না পারেন। এই আয়াতে তাঁদের ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। অবিশ্বাসী ইহুদীরা ঈসা নবী ও তার সঙ্গীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য বড় ধরনের পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে ঈসা (আঃ) কে মুক্ত করেন। খ্রিস্টানদের ধারণা,ইহুদীরা হযরত ঈসা (আঃ) কে ক্রুশে বিদ্ধ করেছিল এবং পরে তাকে কবরে দাফন করা হলে আল্লাহ তাকে উর্ধ্বকাশে উঠিয়ে নেন। কিন্তু কোরআন শরীফের সূরা নিসার ১৫৭ নম্বর আয়াত অনুযায়ী ইহুদিরা ঈসা (আঃ)কে নয়,বরং ঈসা (আঃ)'র মত চেহারার অন্য এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। আল্লাহ হযরত ঈসা (আঃ)কে উর্ধ্বকাশে উঠিয়ে নেন। ইসলামের নবীও স্বল্প সময়ের জন্য মেরাজে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ঐশী সংবাদ জেনেছিলেন। এরপর ঈসা নবীর অনুসারীদেরকে সুসংবাদ দিয়ে পবিত্র কোরআন বলছে ঈসা নবীর অনুসারীরা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের নবীর প্রতি অবিশ্বাসী ইহুদীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্তৃত্ব বজায় রাখবে। ১৪০০ বছর আগে ঘোষিত কোরআনের এই ভবিষ্যৎ বাণীর প্রমাণ এখন পর্যন্ত বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,

প্রথমত : আল্লাহর ইচ্ছা মানুষের সব ধরনের কৌশল ও ষড়যন্ত্রের উর্ধ্বে। তাই আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা থেকে বিরত থাকা উচিত।

দ্বিতীয়ত : নবীদের অনুসরণ শ্রেষ্ঠত্ব ও বিজয়ের চাবিকাঠি। অন্যদিকে কুফরী বা অবিশ্বাস পরাজয়ও ডেকে আনে।

সূরা আলে ইমরানের ৫৬,৫৭ ও ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَأُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ (56) وَأَمَّا الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ (57) ذَلِكَ نَتْلُوهُ عَليْكَ مِنَ الْآَيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ (58)

"যারা অবিশ্বাস করেছে,আমি তাদেরকে ইহকাল ও পরকালে কঠোর শাস্তি দেব এবং তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।" (৩:৫৬)

"পক্ষান্তরে,যারা বিশ্বাস করেছে ও সৎ কাজ করেছে তাদেরকে পূর্ণ পুরস্কার দেয়া হবে। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালোবাসেন না।" (৩:৫৭)

"হে নবী যা আপনার কাছে বলছি তা আল্লাহর নিদর্শন ও বিজ্ঞানসম্মত বাণী।" (৩:৫৮)

ইহুদীরা হযরত ঈসা (আঃ)কে হত্যার ষড়যন্ত্র করায় আল্লাহ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায় প্রায় চল্লিশ বছর ধরে রোমের একজন শাসক ইহুদীদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐ রাজা সে সময় কয়েক হাজার ইহুদীকে হত্যা অথবা বন্দী করেছিল এবং কোন কোন ইহুদীকে পশুর খাদ্য করা হয়েছিল। অবশ্য আল্লাহ কারো ওপর জুলুম করেন না এবং আল্লাহ মানুষের আচরণ অনুযায়ী শাস্তি দিয়ে থাকেন। নবীদের প্রতি অবিশ্বাস ও তাদের সাথে গোয়ার্তুমির পরিণাম অত্যাচারী শাসকদের হাতে বন্দী হওয়া এবং সৌভাগ্যের পথ থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। আর অন্যদিকে ঈমান ও সৎ কাজের পরিণতি হলো,দুনিয়া ও পরকালে বৈষয়িক এবং আত্মিক নেয়ামতের অধিকার হওয়া তথা সৌভাগ্যবান হওয়া।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : আল্লাহ সাধারণত শাস্তি ও পুরস্কার কেয়ামত পর্যন্ত বিলম্বিত করে থাকেন,কিন্তু মাঝে মধ্যে আল্লাহ এই দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়ে থাকেন ।

দ্বিতীয়ত : কোন কিছুই আল্লাহর ক্রোধের মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। তাই আমাদের কাজের পরিণতি সম্পর্কে ভাবা উচিত।

সূরা আলে ইমরানের ৫৯ ও ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِنْدَ اللَّهِ كَمَثَلِ آَدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (৫৯) الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُنْ مِنَ الْمُمْتَرِينَ (৬০)

"আল্লাহর কাছে ঈসাকে সৃষ্টির পদ্ধতি আদম সৃষ্টির মতই । আল্লাহ আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর তাকে বলেছিলেন ‘হও' ফলে সে হয়ে গেল।" (৩:৫৯)

"হে নবী,সত্য সেটাই যা তোমার প্রতিপালক থেকে তোমার প্রতি নাজেল হয়েছে। কাজেই তোমরা সংশয়-সন্দেহবাদী হয়ো না।" (৩:৬০)

একবার মদীনায় একদল খ্রিস্টান ইসলামের নবীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে এল। তারা পিতা ছাড়া হযরত ঈসার জন্মকে তাঁর খোদা হবার প্রমাণ বলে উল্লেখ করল। এ সময় কোরআনের এই আয়াত নাজেল হয়। রাসুল (সাঃ) তাদেরকে বললেন : যদি পিতা ছাড়া জন্ম হওয়াটা কোন মানুষের জন্য খোদা হবার প্রমাণ হয়,তাহলে তো আদমের সৃষ্টি আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ,তারও পিতা ছিল না,মাতাও ছিল না। তাই আপনারা আদমকে কেন খোদার সন্তান বা খোদা মনে করেন না? এরপর আল্লাহ ইসলামের নবী ও অন্যান্য মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন,আল্লাহর বাণীই হলো সম্পূর্ণ সত্য। কারণ,আল্লাহ সমস্ত কিছু সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। আল্লাহর বাণী সব ধরনের বিদ্বেষ,অজ্ঞতা,ভুল ও খেয়ালিপনা থেকে মুক্ত। তাই শুধু আল্লাহর বাণীর ওপরই দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন এবং অন্যদের সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ফলে মুসলমানরাও যেন আল্লাহর বাণীর প্রতি সন্দিহান না হয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : নবীরা যেসব মোজেজা দেখিয়েছেন বা তাদের মাধ্যমে যেসব মোজেজা সংঘটিত হয়েছে সেগুলো আল্লাহরই শক্তির নিদর্শন,এগুলো তাদের আল্লাহ হবার নিদর্শন নয়।

দ্বিতীয়ত : সত্য ও বাস্তবতা একমাত্র আল্লাহর বাণীতেই পাওয়া যায়। যদি আমরা সত্য খুঁজতে চাই তবে আমাদেরকে খোদায়ী বিধান ও সূত্রগুলোর অনুসারী হতে হবে।