সূরা আলে ইমরান;(২৯তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(২৯তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:59:6 4-10-1403

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১৫৪-১৫৮

সূরা আলে ইমরানের ১৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-


ثُمَّ أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ بَعْدِ الْغَمِّ أَمَنَةً نُعَاسًا يَغْشَى طَائِفَةً مِنْكُمْ وَطَائِفَةٌ قَدْ أَهَمَّتْهُمْ أَنْفُسُهُمْ يَظُنُّونَ بِاللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ يُخْفُونَ فِي أَنْفُسِهِمْ مَا لَا يُبْدُونَ لَكَ يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَا قُتِلْنَا هَاهُنَا قُلْ لَوْ كُنْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ وَلِيَبْتَلِيَ اللَّهُ مَا فِي صُدُورِكُمْ وَلِيُمَحِّصَ مَا فِي قُلُوبِكُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (১৫৪)

"এরপর আল্লাহ সেই দুঃখের পর তোমাদের জন্য তন্দ্রার মতো শান্তির ব্যবস্থা করেন। সেই তন্দ্রা তোমাদের একদলকে (যারা পলায়ন করা এবং অলসতার জন্যে অনুতপ্ত ছিল) আচ্ছন্ন করেছিল। কিন্তু আরেকদল যারা শুধু নিজেদের জীবন রক্ষারই চিন্তা করেছিল তারা আল্লাহর ওয়াদা সম্পর্কে অজ্ঞতার যুগের লোকদের মত সত্যের পরিবর্তে মিথ্যা ধারণা পোষণ করছিল। তারা বলছিল কেন যুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষমতা বা অধিকার ছিল না? হে রাসূল! আপনি বলুন,সবকাজ ও সিদ্ধান্তে একমাত্র আল্লাহরই অধিকার রয়েছে। তারা নিজেদের অন্তরে যা গোপন রাখে,তা আপনার কাছে প্রকাশ করবে না। তারা বলে যদি এ ব্যাপারে আমাদের কোন অধিকার থাকতো,তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না। আপনি তাদের বলুন,যাদের মৃত্যু নির্ধারিত ছিল তারা তাদের ঘরে থাকলেও তারা নিজেরাই নিহত হবার জায়গায় উপস্থিত হত। তোমাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা পরীক্ষা করতে চান এবং শুদ্ধ ও পবিত্র করতে চান,আল্লাহ অন্তরের কথা জানেন।" (৩:১৫৪)

এর আগে আমরা বলেছি ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একদল মুসলমান রাসূলের নির্দেশ অমান্য করা এবং নিষ্ক্রিয় হবার পরিণতিতে যুদ্ধে পরাজিত হবার পর দুঃখ বেদনায় ভেঙ্গে পড়ে। তারা রাসূল (সা.) এর কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করে। রাসূল (সা.) তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং আল্লাহও তাদের তওবা কবুল করে তাদেরকে প্রশান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন করেন। কিন্তু আরেকদল মুসলমান পরাজয়ের ব্যাপারে তাদের কোন ভুল বা অবহেলার কথা স্বীকার করতে চাচ্ছিল না। তারা পরাজয়ের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সা.)কেই দায়ী করেন। একদিকে তারা বলছিল আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেন আমাদের সাহায্য করেন নি এবং আমাদেরকে শত্রুদের ওপর বিজয়ী করেননি? অন্যদিকে তারা রাসূল (সা.)কে এটাও বলছিল- আমরা মদীনায় থেকেই যুদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলাম,কিন্তু আপনি আমাদের পরামর্শে কান না দিয়ে আমাদেরকে শহর থেকে বের করে এনেছেন এবং এর ফলেই আমরা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি। আল্লাহ এই আয়াতে ঐসব মুসলমানদের অভিযোগের জবাবে বলছেনঃ
প্রথমত: আল্লাহর সাহায্য প্রতিরোধ ও দৃঢ়তার ওপর নির্ভরশীল। তোমরা একদিকে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য রাসূল (সা.)কে ছেড়ে পালিয়ে যাবে। আবার অন্যদিকে শত্রুদের ওপর জয়ী হবার আশাও করবে এটাতো জাহেলী যুগের লোকদের প্রত্যাশার মত।
দ্বিতীয়ত : মৃত্যু ও শাহাদাত তো তোমাদের হাতে নয় যে তোমরা শহরে ঘরের ভেতরে থাকলে মারা যেতে না। যারা শহীদ হবে বলে ভাগ্যলিপিতে নির্ধারিত হয়েছে তারা দূর্গে বা ঘরের মধ্যে থাকলেও মারা যেত। এছাড়াও দুঃখজনক ও সুখময় ঘটনা তোমাদের পরীক্ষার জন্যেই ঘটে থাকে,যাতে তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ করা যায় ।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলোঃ
প্রথমত: স্বার্থপরতা প্রকৃত ঈমানের বিরোধী। যারা শুধু নিজেদের বাঁচাতে সচেষ্ট,তারা আল্লাহর কাছ থেকে এমন কিছু পাবার আশা করে যার যোগ্য নয় তারা। এইসব মানুষ আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ ধারণাই পোষণ করে।
দ্বিতীয়ত : পরাজয়ের পর আল্লাহ সম্পর্কে অনর্থক খারাপ ধারণা পোষণ না করে বরং নিজেদের দুর্বল দিকগুলো কী তা জানা উচিত এবং এরই আলোকে নিজেদেরকে সংশোধন করতে হবে।
তৃতীয়ত : আল্লাহ আমাদের মনের কথা খুব ভালোভাবেই জানেন। বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও বিপদে আমাদের প্রকৃত মনোভাব প্রকাশ হয়ে পড়ে। এইসব দুর্ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন যাতে আমরা নিজেরাও আমাদের যোগ্যতা ও দুর্বলতাকে বুঝতে পারি এবং অন্যরাও আমাদের ঈমানের গভীরতা ও যোগ্যতা বা অযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন।

সূরা আলে ইমরানের ১৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْا مِنْكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا وَلَقَدْ عَفَا اللَّهُ عَنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ ((১৫৫

"ওহুদ যুদ্ধে দু'দলের লড়াইয়ের সময় যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা আসলে তাদের কৃতকর্মের জন্যেই শয়তানের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট হয়েছিল। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।" (৩:১৫৫)

এই আয়াতে ওহুদ যুদ্ধের সময় একদল মুসলমানের পালিয়ে যাওয়ার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন,অতীতে পাপ করার কারণেই তাদের ঈমান শক্তিশালী হয়নি এবং এরফলে তারা খুব দ্রুত শয়তানের প্ররোচনায় পথভ্রষ্ট হয়েছে। তাই যখন তারা নিজেদের জীবনকে বিপদাপন্ন দেখল,তখন তারা ধর্মের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত হয়নি।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
প্রথমত : ছোটখাটো পাপ বড় পাপ তথা শয়তানের বড় ধরনের কু-মন্ত্রণার পথ খুলে দেয়। ফলে মানুষ নিজের জীবন রক্ষার জন্যে নবী ও খোদাকে পর্যন্ত ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়।
দ্বিতীয়ত : পাপ ধর্ম যোদ্ধাদের মনোবল কমিয়ে দেয় এবং শয়তানের অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত করে। তাই মুজাহিদদের উচিত জিহাদে যাবার আগে অর্থাৎ শত্রুদের মোকাবেলা করার আগেই আল্লাহর কাছে তওবা করা।
তৃতীয়ত : অপরাধীদের সব সময় শাস্তি দেয়া বা প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়। আল্লাহ পালিয়ে যাওয়া অনুতপ্ত মুসলমানদের তওবা কবুল করে তাদেরকে ক্ষমা করেছেন।

সূরা আলে ইমরানের ১৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ كَفَرُوا وَقَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ إِذَا ضَرَبُوا فِي الْأَرْضِ أَوْ كَانُوا غُزًّى لَوْ كَانُوا عِنْدَنَا مَا مَاتُوا وَمَا قُتِلُوا لِيَجْعَلَ اللَّهُ ذَلِكَ حَسْرَةً فِي قُلُوبِهِمْ وَاللَّهُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ((১৫৬

"হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা তাদের মত হয়ো না,যারা অবিশ্বাসী হয়েছে ও তাদের ভাইয়েরা যখন দেশে দেশে সফর করে অথবা যুদ্ধে লিপ্ত হয়,তাদের সম্পর্কে বলে,তারা যদি আমাদের কাছে থাকতো,তবে তারা মৃত্যুবরণ করতো না। আল্লাহ তাদের এ ধরনের বক্তব্যকে কেয়ামতের দিন তাদের জন্য দুঃখ বা মনস্তাপে পরিণত করবেন। আল্লাহই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন।" (৩:১৫৬)

মোনাফিকেরা ওহুদ যুদ্ধে অংশ না নেয়ার জন্য যেসব অজুহাত দেখাতো এই আয়াতে তাকে কুফরী হিসেবে উল্লেখ করে আল্লাহ বলছেন- হে বিশ্বাসীরা! তোমরাও কেন মোনাফিকদের কথার পুনরাবৃত্তি করছ,তারা বলত আমাদের ভাইয়েরা যদি যুদ্ধে না গিয়ে আমাদের কাছে থাকতো তাহলে তারা মারা যেত না। তারা যেন এটা ভুলে গেছে যে জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তারা যখন বিচার দিবস অর্থাৎ কেয়ামতের দিন সত্য বুঝতে পারবে,তখন খুবই দুঃখিত হবে। এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : কোন কোন কথা কুফরী বা ধর্মদ্রোহিতাকে উস্কে দেয়। মোনাফিকরা কাফেরদের খুবই ঘনিষ্ঠ।
দ্বিতীয়ত : অজ্ঞ বন্ধুদের মন্তব্য ও অনুমান থেকে দূরে থাকা উচিত। শত্রুরা তাদেরকে দিয়ে সমাজে হতাশার বাণী ছড়িয়ে দেয় ।
তৃতীয়ত : বেঁচে থাকার আশা নিয়ে জিহাদের ময়দানে কোন ধরনের অবহেলা করা বা জিহাদে অংশ নেয়া উচিত নয়। বহু বৃদ্ধ মুজাহিদও বিজয়ী হয়ে ফিরে এসেছে। আবার অনেক যুবকও শহরে নিজ ঘরে থেকেই মারা গেছে।

সূরা আলে ইমরানের ১৫৭ ও ১৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


وَلَئِنْ قُتِلْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ مُتُّمْ لَمَغْفِرَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَحْمَةٌ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ (১৫৭) وَلَئِنْ مُتُّمْ أَوْ قُتِلْتُمْ لَإِلَى اللَّهِ تُحْشَرُونَ ((১৫৮

"অন্যরা সারা জীবনে যা সঞ্চয় করে আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা তার চেয়ে উত্তম।" (৩:১৫৭)

"তোমরা আল্লাহর পথে শহীদ হলে নিশ্চিতভাবে আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে এবং আল্লাহর কাছেই তোমাদের একত্রিত করা হবে।" (৩:১৫৮)

মুমিনদের মনোবল বৃদ্ধির জন্যে এ আয়াতে বলা হয়েছে,মোনাফিকদের অযৌক্তিক কথায় কান দিও না। জেনে রাখ,আল্লাহর পথে শহীদ হলে কোন ক্ষতি তো নেই,বরং মোনাফিক ও কাফেররা সারা জীবনে যা সঞ্চয় করেছে তোমাদের পুরস্কার তার চেয়ে অনেক মূল্যবান ও স্থায়ী। আর এই পুরস্কার হলো আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা যা কিনা চিরস্থায়ী বেহেশতের চাবিকাঠি। তাই,আল্লাহর পথে জীবিত থাকা ও মৃত থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।