সূরা আন নিসা; (১২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা; (১২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:31:18 4-10-1403

সূরা আন নিসা; আয়াত ৪০-৪৩

সূরা আন নিসার ৪০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,


إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِنْ تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِنْ لَدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا (৪০)



"নিঃসন্দেহে আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না এবং অণু পরিমাণ পূণ্যকার্য হলেও তিনি তা দ্বিগুণ করে দেন এবং আল্লাহ তার কাছ থেকে মহাপুরস্কার দান করে থাকেন ৷" (৪:৪০)

আগের আয়াতে বলা হয়েছে,যারা বঞ্চিত ও দরিদ্রদের দান খয়রাত করে না, তারা আল্লাহর নেয়ামতের ব্যাপারে কুফরি করছে অর্থাৎ আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করছে এবং এই কুফরির জন্য তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে৷ আর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, "আল্লাহর দেয়া শাস্তির অর্থ তিনি বান্দাদের ওপর জুলুম করেন না, বরং এসব শাস্তি মানুষেরই কাজের পরিণাম মাত্র৷"

পাপের উৎস হল, হয় অজ্ঞতা অথবা ভুল চিন্তাধারা বা উন্মাদনা, কিংবা লোভ লালসা বা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের খাহেশ৷ কিন্তু আল্লাহ এসব ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্ত বলে, নিজের সৃষ্টির ওপর জুলুম করার কোন প্রয়োজনই তাঁর নেই৷ মানুষ নিজেই নোংরা কাজে লিপ্ত হয়ে নিজের ওপর জুলুম করে৷ আয়াতের অন্য অংশে বলা হয়েছে, "আল্লাহ সৎ কাজ করতে মানুষকে আআহ্বান জানাচ্ছেন, যারা এই আহবানে সাড়া দিবেন আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও পরকালে পুরষ্কার দেবেন এবং সে পুরস্কার ও হবে কয়েকগুন৷ এটা মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।" অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ আন্তরিক দান খয়রাতের জন্য ৭০০ গুন প্রতিদান দেয়ার কথা বলেছেন৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমতঃ পৃথিবীতে আমাদের বিপদ ও দুর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে জুলুম নয়,বরং এগুলো আমাদের কৃপণতা এবং কুফরি মনোভাবের ফল৷ অর্থাৎ আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করি ৷
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ আনুপাতিক হারে পাপের শাস্তি দিয়ে থাকেন, পাপের তুলনায় এক বিন্দুও বেশী শাস্তি তিনি দেন না৷ কিন্তু তিনি ভালো কাজের পুরষ্কার অনেকগুণ বেশী দিয়ে থাকেন ৷

সূরা নিসার ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,


فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا (৪১) يَوْمَئِذٍ يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَعَصَوُا الرَّسُولَ لَوْ تُسَوَّى بِهِمُ الْأَرْضُ وَلَا يَكْتُمُونَ اللَّهَ حَدِيثًا (৪২)

"
হে নবী সে দিন তাদের কি অবস্থা হবে,যখন আমি প্রত্যেক ধর্ম সম্প্রদায় থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকেও তাদের প্রতি সাক্ষী করবো?"(৪:৪১)
"যারা অবিশ্বাসী হয়েছে এবং নবী রাসূলদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে, তারা সেদিন বলবে, হায়! আমরা যদি মাটির সাথে মিশে যেতাম ৷ আর সেদিন তারা আল্লাহর কাছে কোন কথাই গোপন করতে পারবে না ৷" (৪:৪২)

আল্লাহ যে কারো ওপর জুলুম করেন না, তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো, পরকালে আল্লাহর বিচারালয়ে মানুষের কৃতকর্মের অনেক সাক্ষী থাকবে৷ মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশের সাক্ষ্য ছাড়াও, ফেরেশতাদের সাক্ষ্য এমনকি নবী রাসূলদেরও সাক্ষ্য নেয়া হবে৷ অবশ্য ইসলামের নবী (সা.) তাঁর উম্মতদের সাক্ষী হওয়া ছাড়াও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে অন্যান্য নবীদের জন্যেও সাক্ষী হবেন৷পরকালের বিচারে নবীজির উপস্থিতি ও সাক্ষ্য দেখে বলবে হায়, আমাদের যদি জন্মই না হত কিংবা মৃত্যুর পর যদি চিরকাল মাটিতেই মিশে থাকতাম৷ কিন্তু তখন এই সব আক্ষেপ আর হা হুতাশ কোন কাজে আসবে না৷ কারণ,পৃথিবীতে তাদেরকে যে জীবন ও সময় সুযোগ দেয়া হয়েছে তা শেষ হয়ে গেছে৷ তাই কিয়ামতে এতসব সাক্ষ্য প্রমাণ থাকবে বলে কোন খারাপ কাজই ঢেকে রাখা যাবেনা ৷ এছাড়াও আল্লাহর কাছে কারো কোন কথা ও চিন্তাও গোপন থাকে না৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমতঃ মানুষের মানুষের কৃতকর্মের বড় সাক্ষী হবেন মানুষের বিচারের জন্য বিচার দিবসে আল্লাহ এটাই দেখবেন যে, কারা তাদের কাছে পাঠানো নবীদের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেছে এবং কারা তা করেনি৷ আর এরই ভিত্তিতে তিনি মানুষকে শাস্তি বা পুরস্কার দিবেন৷
দ্বিতীয়তঃ কিয়ামত বা পুনরুত্থান হল অনুতাপ আর অনুশোচনার দিন৷ সেদিন অনেকেই বলবে, হায় যদি মাটি হতাম বা মাটি থেকে আবার আমাদের জীবিত করা না হত!

সূরা নিসার ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوا وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُورًا (৪৩)

 

"হে মুমিনগণ, তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাজের কাছে যেও না, যে পর্যন্ত তোমরা যা বল ,তা বুঝতে না পার৷ আর মুসাফির না হয়ে থাকলে অপবিত্র অবস্থায় নামাজের স্থান বা মসজিদেও যাবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা গোসল করবে৷ তবে এসব স্থান অতিক্রম করা যাবে৷ আর যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা সফরে থাক, অথবা তোমাদের মধ্যে কেউ শৌচাগার থেকে আসে, অথবা তোমরা স্ত্রী-গমন কর এবং এসব ক্ষেত্রে পানি না পাও তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে তোমাদের মুখ ও হাত মুছে ফেল অর্থাৎ তায়াম্মুম কর৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল৷" (৪:৪৩)

এই আয়াতে নামাজের কিছু বিধান বর্ণনার আগে প্রথমে নামাজের মূল চেতনা বা আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করার কথা বলা হয়েছে৷ এরপর গোসল ও তায়াম্মুমের বিধান উল্লেখ করা হয়েছে ৷ নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের মূল লক্ষ্য হল মানুষ যেন তাঁর স্রষ্টার প্রতি স্থায়ীভাবে মনোযোগী হয় এবং একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভর করে৷ যে মানুষের হৃদয় আল্লাহর প্রেমে বা আল্লাহর আকর্ষণে বাঁধা, তিনি সব মুখাপেক্ষীতা ও সব নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হন৷ তাই যেসব বিষয় মানুষকে নামাজে পূর্ণ সচেতনতার পথে বাধা সৃষ্টি করে, সে সব বর্জন করতে বলা হয়েছে৷ যেমন- এ আয়াতে মদ বা মাদকতা সৃষ্টিকারী দ্রব্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অন্য কয়েকটি আয়াতে অসুস্থ ও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নামাজ না পড়ার নির্দেশ দেখা হয়েছে৷ নামাজে দাঁড়ালে মানুষকে এটা মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা আল্লাহর সামনে উপস্থিত৷ তাঁদের এটাও বুঝতে হবে যে তাঁরা আল্লাহর সামনে কি বলছেন এবং আল্লাহর কছে কি প্রার্থনা করছেন? মানুষের মনকে আল্লাহমুখী বা আল্লাহর প্রতি মনোযোগী করা ছাড়াও মানুষের শরীরকেও সব ধরনের কদর্যতা থেকে পবিত্র ও পরিষ্কার রাখতে হবে৷ তাই স্ত্রী- মিলনের পর বা অপবিত্র অবস্থায় নামাজ পড়া তো দূরের কথা নামাজের স্থান মসজিদেও যাওয়া যাবে না৷ জরুরী অবস্থা দেখা দিলে মসজিদের এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করে দ্রুত অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে৷ কিন্তু সফরে থাকা অবস্থায় ফরজ গোসলের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া না গেলে বা কোন অসুস্থতার কারণে পানি ব্যবহার করা ক্ষতিকর হলে মানুষ পবিত্র মাটি ছুঁয়ে তথা তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্র হয়ে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
নামাজ অর্থ শুধু বারবার কিছু কথা বলা আর অঙ্গভঙ্গী করা নয় ৷ নামাজের প্রাণ হলো আল্লাহর প্রতি মনোযোগ আর এ জন্যে সচেতনতা জরুরী ৷
মসজিদ ও ইবাদতের স্থান পবিত্র এবং এসবের মর্যাদা রয়েছে ৷ তাই অপবিত্র অবস্থায় এসব স্থানে যাওয়া উচিত নয়৷ মন ও শরীর পবিত্র করা আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবার ও আল্লাহর সাথে কথা বলার পূর্বশর্ত ৷ সফর ও অসুস্থতার সময়ও নামাজ পড়তে হবে৷ তবে এসব ক্ষেত্রে নামাজের বিধানে কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে৷