সূরা আন'আম;(২০তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(২০তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 5:28:11 5-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ৮৪-৯০

সূরা আন’আমের ৮৪ থেকে ৮৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ كُلًّا هَدَيْنَا وَنُوحًا هَدَيْنَا مِنْ قَبْلُ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِ دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ وَأَيُّوبَ وَيُوسُفَ وَمُوسَى وَهَارُونَ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (84) وَزَكَرِيَّا وَيَحْيَى وَعِيسَى وَإِلْيَاسَ كُلٌّ مِنَ الصَّالِحِينَ (85) وَإِسْمَاعِيلَ وَالْيَسَعَ وَيُونُسَ وَلُوطًا وَكُلًّا فَضَّلْنَا عَلَى الْعَالَمِينَ (86) وَمِنْ آَبَائِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ وَإِخْوَانِهِمْ وَاجْتَبَيْنَاهُمْ وَهَدَيْنَاهُمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (87(

“আমি ইব্রাহীমকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকুব। তাদের প্রত্যেককেই আমি হেদায়াত করেছি বা সুপথ দেখিয়েছি  এবং অতীতে আমি নূহকে হেদায়াত করেছি-তাঁর সন্তানদের মধ্যে দাউদ, সোলায়মান, আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারুনকে। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে পুরস্কার দিয়ে থাকি।" (৬:৮৪)

"আর যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকেও হেদায়াত করেছি। তারা সবাই পুণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।" (৬:৮৫)

"এবং ইসমাঈল, ইয়াসা, ইউনূস ও লূতকেও প্রত্যেককেই আমি হেদায়াত করেছি বা সুপথ দেখিয়েছি এবং তাঁদেরকে সারা বিশ্বের উপর গৌরবাম্বিত করেছি।" (৬:৮৬)

"এ ছাড়াও হেদায়াত করেছি তাদের কোনো কোনো পিতৃপুরুষ, সন্তান-সন্ততি ও ভাইদেরকে; আমি তাঁদেরকে (যোগ্যতার কারণেই অনুগ্রহভাজন ও নবী হিসেবে ) মনোনীত করেছি এবং সরল পথ দেখিয়েছি।” (৬:৮৭)

গত পর্বে আমরা মূর্তি পূজা বা শির্ক না করতে ও এক আল্লাহর ইবাদত করতে জনগণের কাছে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র আহ্বান সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই কয়েকটি আয়াতে ইব্রাহীম (আ.)’র বংশের ওপর একত্ববাদের প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। এই মহান নবীর সন্তান ও বংশধররা আল্লাহর বিশেষ হেদায়াত পেয়েছিলেন এবং মনোনীত হয়েছিলেন নবী হিসেবে। এই চারটি আয়াতে ১৮ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র যুগের চেয়েও প্রাচীন যুগের নবী। যেমন, হযরত নূহ (আ.)। আর তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন  ইব্রাহীম (আ.)’র বংশধর। ইব্রাহীম (আ.)’র  সন্তান ও বংশধরদের কেউ কেউ নবী হয়েছিলেন বলে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে নবীর সন্তান বা বংশধর ছিলেন বলেই তাঁরা নবী হয়েছিলেন। বরং তাঁরা সৎকর্মশীল ও যোগ্য ছিলেন বলেই আল্লাহ তাঁদেরকে নবী হিসেবে মনোনীত করেছেন। তারা যে পূণ্যবান ও সৎকর্মশীল ছিলেন তা আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। একমাত্র সৎ কাজ ও দৃঢ় ঈমানের কারণেই মহান আল্লাহ তাঁদেরকে নবী হিসেবে মনোনীত করে অন্যদের চেয়ে বেশি গৌরব ও  সম্মান দিয়েছেন।

এ আয়াতগুলো থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. বাবা-মায়ের সৎকর্ম সন্তানদের হেদায়াত ও উন্নতিতে প্রভাব রাখে। বাবা-মায়ের অনেক সৎ কাজের পুরস্কার তাঁদের জীবিত থাকা অবস্থায় প্রকাশিত হয় না, বরং তাদের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।

দুই. সৎ ও যোগ্য সন্তান সৎকর্মশীল, সৎ ও খোদাভীরু মানুষের জন্য আল্লাহর পুরস্কার এবং অনুগ্রহ। 

সূরা আন’আমের ৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

“এটি আল্লাহর হেদায়াত। তিনি নিজ বান্দাদের মধ্যে (যোগ্যতা দেখে) যাকে ইচ্ছা, এ পথে চালান। যদি তারা শেরেকী করত, তবে তাদের কাজ কর্ম তাদের জন্যে ব্যর্থ হয়ে যেত।” (৬:৮৮)

এই আয়াতে নবী-রাসূলদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ হেদায়াতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ যাদের হেদায়াত করাকে কল্যাণকর মনে করেন এবং যারা হেদায়াতের যোগ্য তারাই এই বিশেষ হেদায়াত পেয়ে থাকেন। আল্লাহ তাদেরকে নবী হিসেবেও নিয়োগ করেন। অবশ্য এ ধরনের মানুষ সব সময়ই ভাল থাকতে বাধ্য এমন ধারণা ঠিক নয়। তাঁরাও খারাপ কাজ করার স্বাধীনতা রাখেন। তাই তাঁরাও যদি কখনও শির্ক করেন, আল্লাহ তাদের নবুওত কেড়ে নেবেন।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. প্রকৃত ও চূড়ান্ত হেদায়াত একমাত্র আল্লাহর হাতেই রয়েছে। এমনকি নবী-রাসূলও নিজেকে হেদায়াত করার ক্ষমতা রাখেন না। তাঁরাও খোদায়ী হেদায়াতের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করেন।

দুই. খোদায়ী বিধানে ও নিয়মে কোনো বৈষম্য নেই। এমনকি নবী-রাসূলও যদি ভুল বা বাতিল পথে চলেন আল্লাহ তাঁদেরকে ভর্ৎসনা করেন ও শাস্তি দেন।

সূরা আন’আমের ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أُولَئِكَ الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ فَإِنْ يَكْفُرْ بِهَا هَؤُلَاءِ فَقَدْ وَكَّلْنَا بِهَا قَوْمًا لَيْسُوا بِهَا بِكَافِرِينَ

“তাদেরকেই আমি গ্রন্থ, শরীয়ত ও নবুয়ত দান করেছি। অতএব, যদি এরা (তথা মুশরিকরা) আপনার নবুয়ত অস্বীকার করে, তবে (আপনি দুঃখিত হবেন না, কারণ) এর জন্যে এমন সম্প্রদায় নির্দিষ্ট করেছি, যারা এতে অবিশ্বাসী হবে না।” (৬:৮৯)

নবী-রাসূলদের জন্য আল্লাহর বিশেষ হেদায়াত সম্পর্কে বক্তব্য ছিল আগের আয়াতে। এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, আসমানী কিতাব ও নবুয়ত ছাড়াও আমরা নবী-রাসূলকে দিয়েছি বিচার ও রাষ্ট্র শাসনের ক্ষমতা যাতে তাঁরা জনগণের মধ্যে খোদায়ী বিধান বাস্তবায়ন করতে পারেন এবং বিভিন্ন বিরোধ মীমাংসা করতে পারেন সত্যের আলোকে।

আয়াতের পরবর্তী অংশে বিশ্বনবী (সা.)-কে সান্তনা দিয়ে আল্লাহ বলছেন, যুগে যুগে বহু মানুষ নবী-রাসূলদের অস্বীকার করেছে এবং প্রত্যাখ্যান করেছে তাঁদের মাধ্যমে প্রচারিত খোদায়ী বিধি-বিধান, কিন্তু এতে দুঃখ কর না, কারণ, একদল রয়েছে যারা নবী-রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে ও ঈমানের পথে অবিচল-অটল থাকবে। 

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. মানব সমাজে বিচার ও রাষ্ট্র শাসন নবী-রাসূল এবং ইমামদের  অন্যতম অধিকার।

দুই. জনগণকে কাউকে মানল কিনা বা কারো বিরোধিতা করল কিনা তা সত্যের মানদণ্ড নয়। তাই এই শ্রেণীর জনগণের দিকে তাকিয়ে আমরা যেন নিজ ঈমানে সন্দিহান না হই।

সূরা আন’আমের ৯০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهِ قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرَى لِلْعَالَمِينَ

“(হে নবী!) এই (নবী-রাসূলরা) ছিলেন এমন ব্যক্তি যাঁদেরকে আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছিলেন। অতএব, আপনিও তাঁদের পথ অনুসরণ করুন। আপনি (মানুষকে) বলে দিনঃ আমি তোমাদের কাছে এর জন্যে (তথা খোদায়ী রেসালাতের জন্য) কোন পারিশ্রমিক চাই না। এই কুরআন বিশ্ববাসীর জন্যে একটি উপদেশ মাত্র। (জ্ঞানীরা যেন শিক্ষা বা উপদেশ গ্রহণ করে সেটাই আমি চাই।)” (৬:৯০)

বিশ্বনবী (সা.)’র রেসালাত যে অতীতের নবী-রাসূলদের মিশনেরই ধারাবাহিকতা  ও সেইসব মিশন থেকে বিচ্ছিন্ন বা নতুন কিছু নয় তা এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে বলছেন, এ বিষয়টি মানুষের কাছে তুলে ধরে বল যে জনগণকে সর্তক করা ও পথ দেখানোই আমার কাজ। তোমাদের কাছে আমি টাকাও চাই না, বা অন্য কিছু পাওয়ারও আশা করছি না।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. কোনো নতুন নবী আসার অর্থ এ নয় যে অতীতের নবীদের আহ্বান বা দাওয়াত বাতিল হয়ে গেছে। বরং প্রত্যেক নবী ও সব খোদায়ী ধর্মই একত্ববাদের শিক্ষা প্রচার করেছে। কেবল কর্মপন্থা ও ধর্মীয় আইন বা বিধি-বিধানগত কিছু পার্থক্য ছিল।

দুই.  উপদেশ ও সতর্ক করা বা সমালোচনা করাই নবী-রাসূলের দাওয়াতের পদ্ধতি। জোর করে মানুষকে ঈমানের পথে আনা তাঁদের দাওয়াতের পদ্ধতি ছিল না।

তিন. পার্থিব বা বস্তুগত স্বার্থ হাসিল নবী-রাসূলদের দাওয়াতের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই ধর্ম প্রচারকদের উদ্দেশ্যও তা হওয়া উচিত নয়।