আল কোরআনের অলৌকিকতা (৭ম পর্ব)
  • শিরোনাম: আল কোরআনের অলৌকিকতা (৭ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:31:50 1-9-1403

পবিত্র কোরআনই একমাত্র ঐশী গ্রন্থ যা অবিকৃত রয়েছে। এ মহাগ্রন্থের ইতিহাস সুস্পষ্ট। গত ১৪০০ বছরে লিখিত হয়েছে এ মহাগ্রন্থের হাজার হাজার ব্যাখ্যা-গ্রন্থ বা তাফসির। ধর্মীয়,ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনসহ মানব-জীবনের প্রয়োজনীয় সব দিকের বিধি-বিধান এবং নবী-রাসূলদের ও বিভিন্ন জাতির কাহিনী তুলে ধরেছে পবিত্র কোরআন। পাশ্চাত্যের অনেক অমুসলিম বিশেষজ্ঞ ও প্রাচ্যবিদও এ মহাগ্রন্থের অতুল মহত্ত্বের কথা শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করেছেন।
কোরআন বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যাপক গুরুত্ব দিলেও –সৌভাগ্যের জন্য কেবল এ দুটি মাধ্যমকেই যথেষ্ট মনে করে না। ঈমান ও নৈতিকতা ছাড়া শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি মানুষকে সৌভাগ্যের শ্রেষ্ঠ পথ দেখাতে পারে না বলে কোরআন মনে করে। কোন সব অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে ও কোন ধরণের ভাল কাজ করতে হবে তা কোরআন মানবজাতিকে বলে দেয়। এভাবে কোরআন নৈতিকতা ও মানুষের পূর্ণতার ভিত্তি ভূমি রচনা করেছে। নৈতিকতা ও শ্রেষ্ঠ মানবীয় গুণাবলী সম্পর্কে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ বা সর্বোত্তম বক্তব্য রেখেছে এই মহাগ্রন্থ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন নৈতিক গুণাবলী মানুষকে দেয় উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবন। কিন্তু কোরআন নৈতিকতাকে তুলে ধরেছে আরও উচ্চ-স্তরে। কোরআনের দৃষ্টিতে,নৈতিকতা মানুষের চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের ভিত্তি গড়ে দেয়।
কোরআন বলে,মানুষের রয়েছে কিছু বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক ঝোঁক-প্রবণতা। বস্তুগত চাহিদাগুলো সবার কাছেই চিহ্নিত। যেমন,পানাহার,ঘুম,বিশ্রাম ও অন্যান্য জৈবিক চাহিদা। কিন্তু মানুষের উচ্চতর বা আধ্যাত্মিক প্রবণতাগুলো সুপ্ত থাকে বলে সেগুলোকে জাগিয়ে তুলতে হয়। এসব প্রবণতা যখন জেগে ওঠে তখনই মানুষ আত্মিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতা অর্জনে সচেষ্ট হয় এবং এভাবে মুক্তির উপত্যকায় পৌঁছতে চায়। কোরআনে এ পর্যায়কেই “নাফসুন মোত্বমায়িন্নাত”বা প্রশান্ত আত্মিক অবস্থা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ যখন কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সচেতন থাকে এবং নিজেকে মুক্ত করতে পারে কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে তখন সে স্থান করে নেয় নৈতিক গুণাবলীর মনোরম গুল-বাগিচায়।
নৈতিকতা হচ্ছে মূল্যবোধ ও ভাল কাজ বা ভাল আচরণের সমষ্টি। এসব গুণ আয়ত্ত্ব করতে হলে ঈমানের পথে চলতে হবে এবং যুক্ত হতে হবে মুমিনদের সারিতে। পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে ঈমান মানুষকে দেয় নতুন উপলব্ধি। ফলে দৃষ্টি হয় প্রসারিত। যাদের অন্তর ঈমানের নুরে প্রজ্জ্বোল হয় তারা সব কিছুতেই দেখেন আল্লাহর রহমতের চিহ্ন। ঈমান তাকে যোগায় সংযম। বিশ্বাসে প্রদীপ্ত বা তাকওয়াপূর্ণ জীবনাচার তাকে রাখে সদা-প্রফুল্ল আর জীবন হয়ে ওঠে অর্থপূর্ণ। মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তাকে কঠিনতম সংকটেও রাখে অবিচল,বরং এসব দূর্যোগ আর সংকটের পরীক্ষা তাকে করে আরো দৃঢ়-চিত্ত। দুঃখ আর বেদনা হয়ে যায় মধুর ও প্রেমময়। কোরআনের দৃষ্টিতে মানুষের বিকাশ বা উন্নয়ন ও তাদের সুপথ দেখিয়ে দেয়াই ঈমানের লক্ষ্য। সূরা বাকারার ১৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।
কোরআনের দৃষ্টিতে যে ঈমান আনতে ব্যর্থ হল সে হারাল সর্বোত্তম সম্পদ বা পুঁজি যার বিনিয়োগ তাকে দিত সর্বোচ্চ মুনাফা। কিন্তু এ সম্পদের অভাব ধ্বংস করে দেয় মানুষকে। সুরা সাফের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “হে ঈমানদাররা! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বানিজ্যের সন্ধান দিব,যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে?আর তা হল এই যে,তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবনপণ করে জেহাদ করবে।”
মানুষের সুখ ও মানসিক প্রশান্তির মাত্রা নির্ভর করে ঈমানের মাত্রার ওপর। হতাশা,উদ্বেগ ও অস্থিরতার মত অনেক রোগ সেরে যায় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের সুবাদে। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমসের মতে ধর্ম-বিশ্বাস এ ধরণের রোগের সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। ধর্ম বিশ্বাস জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষের অন্যতম প্রধান শক্তি,এ বিশ্বাসের মাত্রা যদি শূণ্য হয় তাহলে মানুষের পতন অনিবার্য বলে তিনি মনে করেন।
ডক্টর কার্ল জুনকের মতে,তার রোগীদের মূল সমস্যাটি হল এমন কোনো ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের অধিকারী হওয়া যে ধর্মে রয়েছে জীবনের ব্যাখ্যা। তিনি বলেছেন,”আমি সুনিশ্চিত যে এরা রোগাক্রান্ত হয়েছে এ কারণে যে,জীবন্ত ধর্মগুলো তার অনুসারীদের যা দিয়েছিল তারা তা হারিয়ে ফেলেছে এবং যারা ধর্ম-বিশ্বাস ফিরে পায়নি তারা রোগমুক্ত হচ্ছে না।”
এটা স্পষ্ট ঈমান নৈতিকতার শক্তিমান পৃষ্ঠপোষক। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর ভিত্তি। পবিত্র কোরআন উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ হিসেবে খোদাভীরুতা,আমানতদারি,পরোপকার,সৎকাজ ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া এবং শান্তি-প্রতিষ্ঠার কথা বলে। এ ছাড়াও কোরআন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা,মানবাধিকার মেনে চলাসহ বিভিন্ন উন্নত নৈতিক গুণে গুণান্বিত হতে বলে। সুরা হুজরাতে নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে অনেক মূল্যবান বিধান এবং দিক-নির্দেশনা বা বার্তা তুলে ধরেছে কোরআন। এ সূরার আয়াতে উন্নত মানুষের যোগ্যতা হিসেবে নৈতিক সুস্থতা,যথাযথ সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও অন্যদের সাথে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক শৃঙ্ক্ষলা বা আদব-কায়দা বিষয়ক দিক-নির্দেশনাও রয়েছে এ সূরায়। যেমন,কথা বলার সময় নিচু ও বিনম্র স্বরে কথা বলা,মুমিনদের সাথে ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা,অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভিন্ন জাতি,গোত্র বা বংশকে সমান অধিকার দেয়া ইত্যাদি।
ফরাসি চিন্তাবিদ রেবভা কোরআনের যুক্তি ও সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন,কোরআন কারো ওপর জোর করে নিজের মত চাপিয়ে দেয় না,বরং যুক্তি দিয়ে মানুষকে পক্ষে টানতে চায়। মার্কিন ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট কোরআনের নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন: “কোরআনে বিধান ও নৈতিকতা অভিন্ন,এ গ্রন্থে বর্ণিত ধর্মীয় আচরণ দুনিয়াবী আচরণও বটে এবং এ বইয়ে বর্ণিত সব বিষয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে ঐশী প্রত্যাদেশের মাধ্যমে। কোরআনে রয়েছে আদব-কায়দা,স্বাস্থ্য-সম্মত জীবন,বিয়ে,তালাক,সন্তানদের সাথে আচরণ,বাণিজ্য ও রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে যৌক্তিক রীতি বা নীতি।”
উইল ডুরান্ট আরও লিখেছেন “১৪০০ বছর ধরে কোরআন মুসলমানদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত রয়েছে,এ বই তাদের চিন্তাকে করেছে উজ্জ্বীবিত,তাদেরকে দান করেছে নৈতিকতা ও কোটি কোটি মানুষের প্রতিভাকে দিয়েছে ঔজ্জ্বল্য।এ গ্রন্থ মানুষের পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র আত্মায় দান করেছে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী বিশ্বাস। কোরআন মুসলমানদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নসহ তাদের সার্বিক উন্নয়নের রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।” ব্রিটিশ লেখক ফোর্ড গিয়ামও কোরআনের নৈতিক বিধানের প্রশংসা করে লিখেছেন: ” কেউই এ বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারে না যেকোরআনের নৈতিক শিক্ষাগুলো খুবই ফলপ্রসু এবং এসব শিক্ষা সব সময়ই সৎ,গুণবান ও আস্থাভাজন বা বিশ্বস্ত মানুষ গড়ে তুলছে।”
জাপানের বিশিষ্ট ইসলাম বিশেষজ্ঞ”তোশিহিকু ইজুৎসু” কোরআনের উচ্চাঙ্গের বক্তব্য ও লক্ষ্যগুলোকে তুলে ধরার জন্য ” কোরআনে আল্লাহ ও মানুষ” শীর্ষক একটি বই লিখেছেন। তার মতে কোরআন আল্লাহ ও মানুষের যে চিত্র তুলে ধরে তার মূল কথা হল আল্লাহই সব অস্তিত্বের মূল অক্ষ বা কেন্দ্র,তিনিই সব অস্তিত্বের উৎস ও সৃষ্টিকুলের স্রস্টা। সব জ্ঞান ও ক্ষমতা বা শক্তির উৎস তিনিই। কোরআন বিশ্ব জগতের অশেষ বিস্ময় নিয়ে মানুষকে চিন্তাভাবনা করতে বলে যাতে তারা (নিজ ধারণ ক্ষমতা ও উপলব্ধির যোগ্যতা অনুযায়ী) মহান আল্লাহর অশেষ মহত্ত্ব উপলব্ধি করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত ও কৃতজ্ঞ হয়। কোরআন মানুষের মধ্যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর পরিচিতি দান করতে চায় যাতে তারা বুঝতে পারে যে আল্লাহই অস্তিত্ব জগতের কেন্দ্র;আর এই ঈমান বা বিশ্বাস যেন তাদের বক্তব্য ও কাজে প্রতিফলিত হয়। অন্য কথায় কোরআন মানুষকে খোদা-কেন্দ্রীক চিন্তাধারার অধিকারী হতে বলে এবং তারা যেন মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও মহাকৌশলের প্রতি ঈমান রেখে নিজ জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। কোরআনের বক্তব্য বা চিন্তাধারার লক্ষ্য হল মানুষের মুক্তি ও সৌভাগ্য নিশ্চিত করা।
কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী খোদায়ী বাণীর উদ্দেশ্য হল মানুষকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই বিশেষ লক্ষ্য-পানে তাকে এগিয়ে নেয়া। সূরা তিন ঠিক এ চিত্রই স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এ সূরার চার থেকে ৮ নম্বর আয়াতে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে,মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করা হয়েছে …এবং যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে,তাদের জন্যে রয়েছে নাজাত বা মুক্তি। আর তাদের জন্য খোদার কাছে রয়েছে অশেষ পুরস্কার।
কোরআনে মানুষের আত্মিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব পেয়েছে। এ মহাগ্রন্থ মানুষের যেসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে তা খুবই যথাযথ। যেমন,সূরা ইব্রাহিমের ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: “(যেসব বস্তু তোমরা চেয়েছ,তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর,তবে গুণে শেষ করতে পারবে না)। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী,অকৃতজ্ঞ।”(১৪:৩৪)
সূরা আসরা বা বনি-ইসরাইলের ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:
“মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে,সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষ তো খুবই দ্রুততা বা তাড়াহুড়া প্রিয়।”(১৭:১১)
সূরা আসরা বা বনি-ইসরাইলের ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
“(যখন সমুদ্রে তোমাদের উপর বিপদ আসে,তখন শুধু আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা আহবান করে থাক তাদেরকে তোমরা বিস্মৃত হয়ে যাও। অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে স্থলে ভিড়িয়ে উদ্ধার করে নেন,তখন তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও।) মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।”(১৭:৬৭)
একই সূরার ৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“আমি মানুষকে নেয়ামত দান করলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অহংকারে দুরে সরে যায়;যখন তাকে কোন অনিষ্ট স্পর্শ করে,তখন সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে।”(১৭:৮৩)
কোরআনের ৭০ নম্বর সূরা তথা সূরা মাআরিজের ১৯ থেকে ২১ নম্বর আয়াতে বলছে: “মানুষ তো সৃজিত হয়েছে ভীরুরূপে।যখন তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে,তখন সে হা-হুতাশ করে।আর যখন কল্যাণপ্রাপ্ত হয়,তখন কৃপণ হয়ে যায়।”
কোরআনের ৯৬ নম্বর সূরার ৬ ও ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“নিঃসন্দেহে মানুষ সীমালংঘন করে,কারণ,সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।”
অন্যদিকে পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে মানুষের ভাল গুণ বা দিকগুলোর প্রশংসাও করা হয়েছে। যেমন,বলা হয়েছে- মানুষ বিশ্বজগতে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। এ মহাগ্রন্থ বহু আয়াতে সেইসব নির্বাচিত মানুষের কথা তুলে ধরেছে যারা উচ্চতর ও পরিপূর্ণতার পথ অতিক্রম করেছেন দৃঢ়তা নিয়ে এবং এভাবে লাভ করেছেন উচ্চতর মানবীয় মর্যাদা। পবিত্র কোরআনের বিশ্বদৃষ্টি অনুযায়ী মানুষের রয়েছে পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা। মানুষ আল্লাহর নৈকট্য ও পরিপূর্ণতা পাবার ইচ্ছা নিয়ে এ পথে সচেষ্ট হলে ঈমান ও সৎ কাজের মাধ্যমে এসব মহান গুণ অর্জন করতে সক্ষম হয়।
কোরআনের দৃষ্টিতে মানুষ যদি পবিত্র গুণ বা নৈতিক গুণাবলীর সৌন্দর্য বুঝতে পারে তাহলে সে অশালীন বা অশোভনীয় কাজ পরিহার করবে। যারা সত্য কথার সৌন্দর্য্য বোঝে না তারাই মিথ্যা বলতে কুণ্ঠিত হয় না। তাই মানুষকে হতে হবে সৌন্দর্য-পিপাসু।
কোরআন মানুষকে ইহ ও পরকালীন সৌভাগ্য অর্জনের নানা শিক্ষা দেয়। মানুষের চরিত্রকে বিকশিত করা ও অধঃপতন থেকে তাদের রক্ষার জন্য নৈতিকতার মূল নীতি শেখায় এ মহাগ্রন্থ। যত বেশি সম্ভব খোদায়ী গুণের অনুসারী হতে বলে কোরআন। যেমন,সূরা মায়েদার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“হে মুমিনরা,তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর,নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।”
কোরআন যে কোনো অবস্থায় অন্যের ও নিজের ওপর জুলুম করতে নিষেধ করে। কারণ,আল্লাহ কারো ওপর বিন্দু-পরিমাণ বা ক্ষুদ্রতম অবিচারও করেন না।
মানুষকে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা শেখাতে গিয়ে কোরআন প্রথমেই বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে দয়াদ্র ব্যবহার করতে বলে। এরপর সমাজের অন্যান্যদের মধ্যেও এ মানবিক গুণের চর্চা করতে বলেছে। আল্লাহ নিজে দয়া,ক্ষমাশীলতা ও করুণার অশেষ আধার এবং মানুষেরও দয়াশীল ও ক্ষমাশীল হওয়া উচিত। আল্লাহর মহান গুণের অনুসারী হিসেবে মানুষেরও উচিত অন্যদের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করা। কোরআনের বহু আয়াতে ক্ষমাশীল হতে বলা হয়েছে মানুষকে।
সূরা হুজুরাতে পবিত্র কোরআন মানুষকে কিছু অপূর্ব সামাজিক ও নৈতিক দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। এ সূরার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“মুমিনগণ,কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা,সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা,সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম।
মুমিনগণ,তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পেছনে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী,পরম দয়ালু।” সমাজকে চিন্তাগত দিকসহ সব দিক থেকে নিরাপদ ও সুখময় করার জন্য কোরআনের এসব নৈতিক শিক্ষা মেনে চলা অপরিহার্য।
পবিত্র কোরআন কি সাধারণ মানুষের জন্য বোধগম্য বা তাদের উপযুক্ত ধর্মীয় গ্রন্থ? এর উত্তরে কোরআনেরই বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে ,এতে রয়েছে সাধারণ ও আপামর মানুষের জন্য বর্ণনা,তবে এ আসমানি কেতাব কেবল তাদেরকেই পথ দেখায় যারা নিজেরাই সুপথ পাওয়ার চেষ্টা করে। সূরা আলে ইমরানের ১৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা। আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশবাণী।”বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কোরআনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে ভূপৃষ্ঠ ও বৃষ্টির সম্পর্কের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন,“ভূপৃষ্ঠ যখন শুস্ক ও মৃত থাকে তখন মহান আল্লাহর পাঠানো বৃষ্টি তাকে নাড়া দেয়,প্রবল বৃষ্টি ভূমিকে আবারও নাড়া দেয় এবং ভূমির বিকাশ ঘটে বা ভূমি সমৃদ্ধ হয়। এ ছাড়াও মহান আল্লাহ পর্বত বা উপত্যকাগুলো থেকে প্রবাহিত করেন নদ-নদী,ফলে ভূ-পৃষ্ঠে জন্ম নেয় উদ্ভিদ ও সেগুলো বেড়ে উঠে। এভাবে আল্লাহ এইসব পানির মাধ্যমে জমিনকে করেন সু-সজ্জিত ও তাতে সৃষ্টি করেন মানুষ ও জীব-জন্তুর জন্য রকমারি খাদ্য। কোরআনও ঠিক একই কাজ করে তাদের সাথে যারা তাকে মেনে চলে বা গ্রহণ করে।”
কোরআন ধনী ও দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষকেই পথ দেখায়। যাদের জ্ঞান বেশি তারা কূল-কিনারাহীন এ মহাসাগর থেকে বেশি উপকৃত হয়। কোরআনের বক্তব্য গভীর ও সারগর্ভ হওয়া সত্ত্বেও তা সব মানুষের জন্যই সহজ ও কল্যাণকর এবং ব্যবহারযোগ্য। কোরআনের চিরন্তনতা ও চির-নাব্যতা এখানেই যে এর শিক্ষাগুলো কেবল বিশেষ কোনো যুগের জন্যই প্রযোজ্য নয়,বরং সব যুগের জন্যই প্রযোজ্য। অবশ্য এমন দাবি কেউই করে না যে কোরআন হল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্বকোষের মত,ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে গবেষণার বা নব-উদ্ভাবনের চেষ্টার কোনো দরকার নেই।
কোরআনের লক্ষ্য হল মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্য নিশ্চিত করা। এ জন্য এ মহাগ্রন্থ ব্যক্তি ও সমাজের নানা ধরণের সম্পর্কসহ পার্থিব সব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিবিহীন কর্মসূচি উপহার দিয়েছে। অন্য কথায় কোন কোন পথে মানুষের জন্য রয়েছে সৌভাগ্য ও কোন কোন বিষয় সৌভাগ্যের পথে বাধা -সেগুলোই বর্ণনা করে কোরআন।
এ গ্রন্থের মতে মানুষের সৌভাগ্য ঈমান ও আল্লাহকে জানার ওপর নির্ভর করে। এর পাশাপাশি নবুওয়্যাত বা আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশী বাণী প্রচারের দায়িত্ব ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস এসব বিষয়েও স্পষ্ট জ্ঞান তুলে ধরে আল-কোরআন। এ ছাড়াও নৈতিকতার ভিত্তি বা প্রধান মূল্যবোধগুলো বর্ণনা করে এ মহাগ্রন্থ। আর এসবই পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করেছে সর্বশেষ আসমানি কেতাব। মানুষের বিকাশ,পূর্ণতা ও প্রকৃত সৌভাগ্যের পথ দেখানোর জন্য বাস্তব বিধান তুলে ধরাও কোরআনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন। কোরআন মানুষকে শরিয়তের বাস্তব বিধি-বিধান শেখায়। আর এসব বিধি-বিধানের বিস্তারিত ব্যাখ্যার দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে বিশ্ববনবী (সা:)’র ওপর।
কোরআনের কর্মসূচি ব্যক্তিক ও সামাজিক ক্ষেত্রসহ মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রে বিস্তৃত। এই সব ক্ষেত্রেই মানুষের দায়িত্ব কি তা বলে দিয়েছে কোরআন। সামাজিক অঙ্গনে কোরআনের নৈতিক শিক্ষার উদাহরণগুলো অত্যন্ত চমৎকার। যেমন,কোরআন ব্যবসাকে সামাজিক কাজ ও সেবা বলে মনে করে। উপার্জন করলেই তা যথেষ্ট নয় কোরআনের দৃষ্টিতে। মুনাফা বা উপার্জন বৈধ হতে হবে।
সূরা নিসার ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: “হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু।”
ইসলাম স্বচ্ছল ও সম্মানজনক এমন জীবনের কথা বলে যে জীবনের আয়-উপার্জন হবে বৈধ বা হালাল। আর ইসলামের এই অর্থনৈতিক বিধান মানব-রচিত বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিধান ও পুজিবাদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামের দৃষ্টিতে বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা ও মালিকানা উচ্চতর লক্ষ্যে ও স্থায়ী সৌভাগ্যের পথে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। কোরআন মানুষকে সামাজিক ক্ষেত্রে দানশীল ও দয়ালু বা মানব-প্রেমিক হতে বলে। কোরআনে কারিমে মহান আল্লাহ বলেছেন,“তোমরা আল্লাহর পথে দান কর এবং নিজেকে নিজের হাতে ধ্বংস করো না। তোমরা ভাল কাজ কর,আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন।”
ইসলামের অর্থনৈতিক বিধানে মাপে কম দেয়ার ও সুদের মন্দ দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। সূরা বাকারার ২৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: “এমন কে আছে যে,আল্লাহকে ধার দেবে,উত্তম ঋণ; অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহই (বান্দাদের রুজি) সংকুচিত করেন এবং তিনিই (রিজিকে) প্রশস্ততা দান করেন (দান তাদের রুজিকে কমায় না)এবং তাঁরই কাছে তোমরা সবাই ফিরে যাবে (তখন তোমরা দানের প্রতিদান পাবে)।”
সূরা নিসার ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: “আর উপাসনা কর আল্লাহর,শরীক করো না তাঁর সাথে অন্য কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্নীয়,এতীম-মিসকীন,(কাছের ও দূরের)প্রতিবেশী,অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে।”
পবিত্র কোরআন মানুষের মন ও আত্মার খাদ্য- খোরাকের প্রভাবকেও গুরুত্ব দেয়। এক্ষত্রে মানুষের প্রকৃত চাহিদা ও কল্যাণের আলোকে বিধান দিয়েছে এই মহাগ্রন্থ। আর এ জন্যই কোন্ কোন‌ জন্তু বা পশুর গোশত হালাল ও কোন কোন্ জন্তুর গোশত হারাম তা উল্লেখ রয়েছে মহাকল্যাণময় এই বইয়ে।
কোরআন মজিদ মানুষের অধিকার বা আইনগত বিষয়েরও বর্ণনা দিয়েছে। যেমন,কিসাস বা রক্তের বদলার বিধান,তালাক,উত্তরাধিকার,অসিয়ত বা উইল সংক্রান্ত নীতিমালা ইত্যাদি।
ইসলাম সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রেও দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিধান। যেমন,পরামর্শ করা । এ সম্পর্কে সূরা শুরায় এসেছে:
“যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে,নামায কায়েম করে; পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি,তা থেকে ব্যয় করে।”
কোরআন পরিবার-ব্যবস্থাকে সুস্থ-সমাজের ভিত্তি বলে মনে করে। তাই স্বাম-স্ত্রীর দয়াদ্র সম্পর্ককে জোরদারের কার্যকর বিধানও দিয়েছে এই অনন্য জীবন-বিধান।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও কোরআন জাতিগুলোকে নিজ ভাগ্য গড়তে বলেছে। সমাজের নেতৃত্ব সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের হাতে ন্যস্ত থাকার কথাও বলেছে আল-কোরআন। এবাদত-বন্দেগীর বিষয়েও যেমন,নামাজ,রোজা,হজ্ব ইত্যাদির বিধান দিয়েছে। এসব এবাদত মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তি তথা ঈমান ও নানা বিশ্বাসকে মজবুত করে।
মোটকথা পরকালীন বা চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের ক্ষেত্র তৈরির জন্য পার্থিব এ জীবনে মানুষের যা যা করা উচিত তার সব নির্দেশনাই রয়েছে সর্বশেষ খোদায়ী গ্রন্থ কোরআনে। এ গ্রন্থ মানুষকে সৃষ্টি জগতের নানা রহস্য ও নিদর্শন নিয়ে চিন্তা করতে বলে যাতে মানুষের চিন্তাশক্তি ও প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
পবিত্র কোরআন সামাজিক,সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকসহ মানব-জীবনের সব দিকের নির্দেশনা ও বিধান সম্বলিত পরিপূর্ণতম বা পূর্ণাঙ্গ ঐশী গ্রন্থ। মানব সমাজের এমন কোনো দিক নেই যে দিক সম্পর্কে কোরআনের দিক-নির্দেশনা নেই। ন্যায়বিচার-ভিত্তিক সব ধরণের মানবীয় সম্পর্ক এবং স্রস্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক এই মহাগ্রন্থের আলোচ্য বিষয়।
বিকৃতির যে কোন ছোবল বা প্রচেষ্টা বিন্দুমাত্রও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি আসমানি এ গ্রন্থের বাণীতে।
কোরআনের বাণীগুলোকে সব সময়ই নতুন মনে হয় এবং এর প্রভাব ও স্থায়ীত্বও অলৌকিক। বিকৃতির যে কোন ছোবল বা প্রচেষ্টা বিন্দুমাত্রও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি আসমানি এ গ্রন্থের বাণীতে। আর এ জন্যই এই কোরআন নিয়ে কেবল মুসলিম বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিতদেরই নয়,অমুসলিম অনেক চিন্তাবিদ ও মনীষীদের বিস্ময় আর কৌতুহলের কোনো শেষ নেই। কোরআনের অশেষ প্রভাবের রহস্য উদঘাটন করার আশায় যারা বিদ্বেষমুক্ত মন নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত হয়েছেন তারাই কোরআনের সৌন্দর্য্যে ও ঐশ্বর্যে অভিভূত হয়েছেন এবং এখনও অভিভূত ও আকৃষ্ট হচ্ছেন এই শ্রেণীর গবেষকরা। অবশ্য যারা সংকীর্ণ দৃষ্টি দিয়ে কোরআনের নানা দিকের বিচার-বিশ্লেষণ করেন তারা অনেক অপবাদ বা অবাস্তব মন্তব্য চাপিয়ে দেন এ মহাগ্রন্থের ওপর।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র অন্তরে কোরআন নাজেল হওয়ার দিনগুলোতেই যারা এ পবিত্র গ্রন্থ সম্পর্কে অশোভনীয় ও অযৌক্তিক বক্তব্য রাখত তাদেরকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে আল্লাহ বলেছেন,যদি ক্ষমতা থাকে তবে কোরআনের সূরার মত একটি সূরা বা একটি আয়াত রচনা করে দেখাও। এমনকি এ জন্য যত ইচ্ছা অন্যদের সাহায্যও নাও!
সেই প্রাথমিক যুগ থেকে আজও কোরআন অবমাননার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের আর কোনো গ্রন্থই কোরআনের মত এত বেশি সমালোচনা,চুল-চেরা বিশ্লেষণ ও এমনকি অবমাননার শিকার হয়নি। কিন্তু তারপরও সত্য-সন্ধানী ও বিবেকবান মানুষের অন্তরে এ মহাগ্রন্থের প্রভাব অপ্রতিহত গতিতে বেড়েই চলেছে। পাশ্চাত্যেই কোরআন ও ইসলাম নিয়ে রচিত হয়েছে হাজার হাজার বই। কোরআন ও ইসলামের নানা দিক নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার মাত্রা ও পরিধিও দিনকে দিন বাড়ছে।
পাশ্চাত্যের অনেক প্রাচ্যবিদ কোরআনের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। তারা এটা দেখাতে চান যে কোরআন সহিংসতাকামী। আবার কখনওবা কোরআনের বাণীর মত বাণী রচনার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।আরবি সাহিত্যের গদ্য ও পদ্যের কিছু অংশকে তারা কোরআনের বাণীর মতই সমৃদ্ধ বা অসাধারণ বলে প্রচার করেছেন। এ প্রসঙ্গে লিইডেনের কোরআন-বিশ্বকোষের ” কোরআনের অলৌকিকতা” শীর্ষক প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করা যায়। রিচার্ড সি মার্টিন ঐ প্রবন্ধে “মুসায়লামা কাজ্জাব” বা মিথ্যাবাদী কাজ্জাবের কথা তুলে ধরেছেন। মুসায়লামা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র জীবদ্দশায় ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল এবং মহানবী (সা.)’র জীবনের শেষের দিকে নবুওয়্যাত লাভের দাবি করে। সে কোরআনের বাণীর অনুরূপ কিছু বাণী রচনার দাবি করেছিল। ছন্দ,কাঠামো,সুর ও মিলের দিক থেকে অগোছালো এবং অর্থের দিক থেকে অশ্লীল ও অর্থহীন ছিল সেসব বাণী। এসব বাণী রচনা করতে গিয়ে মুসায়লামা কোরআনের কিছু কিছু কাঠামো,সুর ও শব্দ ব্যবহার করেছিল। অন্যদিকে যা সে যোগ করেছিল ওইসব বাণীতে তা ছিল অর্থহীন ও অস্থির প্রলাপতুল্য।
বিশ শতকের প্রথদিকেও ইসলামের একদল শত্রু কোরআনের কথিত অনুরূপ বই লেখার চেষ্টা করে। তারা এ কাজে আরবী ভাষাভাষী কিছু লোককে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। নাসিরউদ্দিন জাহের নামের একজন খ্রিস্টান লেখক কোরআনের অলৌকিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি দাবি করেন যে,কোরআনের মত বই রচনা যে কেবলই সম্ভব তা নয়,বরং তার চেয়ে ভাল বইও লেখা সম্ভব। তিনি তার ভাষায় সুরা কাওসার ও সুরা ফাতিহা’র অনুরূপ (জাল) সুরা রচনা করেন। কিন্তু আরব সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে এসব রচনা ছিল ভুল-ভ্রান্তি বা অসঙ্গতিতে ভরা। এসব রচনার শব্দগুলোয় ব্যক্তিগত চিন্তার প্রভাব থাকায় অর্থ,বিষয়বস্তু,স্টাইল,শৃঙ্ক্ষলা প্রভৃতি দিক থেকে সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে বলে আরব সাহিত্যিকরা মন্তব্য করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে ওই রচনাগুলোয় ছিল না কাঙ্ক্ষিত অর্থের আভাস। ভাষাও কোরআনের মত আলঙ্কারিক ও বাগ্মিতাপূর্ণ হয়নি।
১৯৯৭ সালে আমেরিকান অনলাইন কয়েকটি জাল সূরা প্রকাশ করে। কথিত সুরাগুলোর নাম দেয়া হয়,মুসলিমুন,তাজাসসাদ,ওয়সাইয়া ও ঈমান। কোরআনের আয়াত থেকে চুরি করে আনা শব্দ ব্যবহার করা সত্ত্বেও এ সুরার কোনো কোনো অংশ অর্থহীন ও অস্পষ্ট থেকেছে। এ ছাড়াও এসব রচনার কোনো কোনো অংশের অসঙ্গতি বা বৈপরীত্যই সূরাগুলোর জাল হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেছে।
ইসলামের শত্রুরা কোরআনের বাগ্মিতা ও আলঙ্কারিকতা,ভাষাগত বিশুদ্ধতা,বিধি-বিধান,বিজ্ঞান বিষয়ক রহস্য,স্টাইল,ছন্দ ও সুর প্রভৃতি বিষয়েও সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। উইলিয়াম জেমস ডুরান্ট সভ্যতার ইতিহাস শীর্ষক বইয়ে দাবি করেছেন,কোরআনের বাণীগুলোর বিভিন্ন ধরণের শানে নজুল বা প্রেক্ষাপট ও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আয়াত নাজেল হওয়ার কারণে এ বইয়ে পুনরাবৃত্তি ও বিক্ষিপ্ততা দেখা যায়।
অথচ কোরআন নাজেল হওয়ার যুগেই অনেক অমুসলমান আরব পণ্ডিত কোরআনের আলঙ্কারিকতা ও ভাষার বিশুদ্ধতা এবং আভিজাত্যকে অলৌকিক বলে স্বীকার করেছেন। ওলিদ বিন মুগিরা,খালেদ বিন উকবা,তাফিল বিন আমরু,উৎবা বিন রবিয়া ও আনিস বিন জিনাদেহ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব বিশ্বনবী (সা.)’র কঠোর শত্রু হওয়া সত্ত্বেও কোরআনের এইসব ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। কোরআনের বিশুদ্ধভাষীতা,বাগ্মীতা ও অন্যান্য সৌন্দর্য ছিল ইসলামের দিকে আরব জনগণের আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
এটা স্পষ্ট যে সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় একই মানুষের বক্তব্যের মধ্যে স্ববিরোধিতা,অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য দেখা দেয়। কিন্তু পবিত্র কোরআন দীর্ঘ ২৩ বছরে পর্যায়ক্রমে নাজেল হওয়া সত্ত্বেও এ ধরণের বৈপরীত্য,অসঙ্গতি ও স্ববিরোধিতা থেকে মুক্ত। এ বৈশিষ্ট্য এই মহাগ্রন্থের অন্যতম মোজেজা বা অলৌকিকত্বের প্রমাণ।
কোরআনের বিধি-বিধান বা আইন-ব্যবস্থাও অসাধারণভাবে মজবুত এবং স্থায়ী। মানব-রচিত বিধানগুলোর নানা দোষ-ত্রুটি যুগের পরিক্রমায় প্রকাশ পায়। তাই সেগুলোর সংস্কার বা সংশোধন দরকার হয়। কিন্তু কোরআনের বিধি-বিধান এত পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রীক যে তা সব যুগ ও সব স্থানের জন্য প্রযোজ্য। ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ ডেভিড স্যামুয়েল মারগলিউথ কোরআনের বিধি-বিধানের এ অলৌকিকত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আশায় বলেছেন,এসব বিধি-বিধানে আরবের তীব্র উষ্ণ ও শুস্ক মরুময় অঞ্চলের লোকদের নানা বৈশিষ্ট্যের প্রভাব রয়েছে!কিন্তু পাশ্চাত্যের অনেক প্রাচ্য-বিদই এটা স্বীকার করেছেন যে কোরআনের বক্তব্য ও বিষয়বস্তুগুলো মানুষের সাধ্যাতীত বিষয়। এমনকি উইল ডুরান্ট কোরআন সম্পর্কে নেতিবাচক বক্তব্য রাখা সত্ত্বেও বলেছেন,
“কোরআন মুসলমানদেরকে দিয়েছে নৈতিকতা,দিয়েছে সরল-প্রাণ মানুষকে সহজ ও স্পষ্ট কিছু বিশ্বাস যেগুলো মূর্তিপূজা ও গণক-সন্যাসীদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথা বা অনুষ্ঠানের শৃঙ্ক্ষল থেকে মুক্ত। মুসলমানদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি কোরআনেরই অবদান। এ গ্রন্থ মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্ক্ষলার নীতি ও ঐক্যকে সংহত করেছে,স্বাস্থ্য বিধি মান্য করতে উৎসাহ দিয়েছে এবং তাদের মন-মগজকে বহু কুসংস্কার,অস্পষ্টতা,জুলুম-অবিচার ও সহিংসতা থেকে মুক্তি দিয়েছে।”
ইসলাম-পূর্ব যুগের সাতজন বিখ্যাত আরব সাহিত্যিকের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত লবিদ আবু রাবিয়া যখন সুরা বাকারার প্রথম আয়াতটি কাবাঘরের দেয়ালে দেখেন,তিনি এর বালাগাত ও ফাসাহাত তথা আলঙ্কারিক ভাষা দেখে অভিভূত চিত্তে বলে ওঠেন: এ বক্তব্য কেবলই ও একমাত্র খোদার পক্ষ থেকেই নাজেল হয়েছে। তার এ মন্তব্য প্রাচ্যবিদদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি।
কোরআন নিয়ে অবমূল্যায়ন বা অবমাননা কিংবা এর কপি পোড়ানোর মত নোংরা কাজগুলো যতই জোরদার হচ্ছে ততই বিবেকবান মানুষরা এ মহাগ্রন্থ অধ্যয়নে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।
পবিত্র কোরআন অশেষ অলৌকিকতায় ভরা প্রাণবন্ত ও চিরজীবন্ত এক মহাগ্রন্থ। মানুষের মুক্তি ও সৌভাগ্যের নির্দেশক এ আসমানি গ্রন্থ সুললিত বাণী ও অকাট্য যুক্তি দিয়ে সব মানুষের কাছে তুলে ধরে সত্যকে। বিরোধীদেরকেও চ্যালেঞ্জ দিয়ে রেখেছে এ পবিত্র গ্রন্থ। মানব-জীবনের সব দিকের নির্দেশনা রয়েছে এ মহাগ্রন্থে। চিরনতুন এ কিতাব বিশ্বনবী (সা.)’র যুগের মত বর্তমান যুগেও সত্য-পিপাসুদের আকর্ষণ করছে দারুণভাবে।
কোরআনের অশেষ মোজেজা বা অলৌকিকতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা আমরা গত অনুষ্ঠানগুলোতে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এ মহাগ্রন্থের নানা আয়াতের বক্তব্যের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সত্যের সাদৃশ্যও আমরা তুলে ধরেছি মোজেজার প্রমাণ হিসেবে। কোনো ওষুধ কতটা মূল্যবান ও রোগ নিরাময়ের জন্য কতটা কার্যকর তা বোঝার অন্যতম উপায় হল ওই ওষুধকে নিয়েই নানা গবেষণা করা। কেবল চিকিৎসকদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট হওয়া উচিত নয়। কোরআন সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে কোরআনের বৈজ্ঞানিক রহস্যপূর্ণ বাণীগুলো ততই স্পষ্ট হচ্ছে।
কোরআনের বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের দৃষ্টান্ত হিসেবে,সুরা নাবার ৬ ও ৭ নম্বর আয়াতের কথা এখানে তুলে ধরছি। এ দুই আয়াতে বলা হয়েছে,“আমি কি করিনি ভূমিকে বিছানা এবং পর্বতমালাকে (দৃঢ়ভাবে আটকে রাখার) পেরেক?”
কোরআনের এ বক্তব্য অতীতে অনেকের কাছেই বোধগম্য ছিল না। বর্তমান যুগের ভূতাত্ত্বিক বা বিজ্ঞানীরা বলছেন পাহাড়গুলো পাদদেশ বা নিচের দিক থেকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত এবং ফলে তা ভূপৃষ্ঠের জন্য ইস্পাত-কঠিন ঢালের কাজ করছে। অন্য কথায় ভূপৃষ্ঠের বহির্ভাগের গভীরতা কম হওয়ায় পর্বতমালা ও পৃথিবীর গভীরে সেগুলোর মূল প্রোথিত হওয়ার বিষয়টিকে পেরেকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই পাহাড়গুলো ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগকে স্থিতিশীল রেখেছে। কোরআনের এ বাণী চিন্তাশীল ও গবেষকদের ব্যাপক মাত্রায় আকৃষ্ট করে।
গেল সপ্তাহয় কোরআন সম্পর্কে পাশ্চাত্যের কোনো কোনো প্রাচ্যবিদের কিছু অপবাদের কথা ও সেগুলোর জবাব আমরা তুলে ধরেছি। পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের অনেকে তাদের মতামতের কোনো কোনো অংশে কোরআনের সত্যতার স্বীকৃতিও দিয়েছেন।
ইতালীয় চিন্তাবিদ মায়িল এঞ্জেলো কোরআন সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে প্রথমে ইসলাম ও কোরআন সম্পর্কে বিজাতীয়দের বই অধ্যয়ন করেন। তিনি লিখেছেন,“ইসলামের চিরন্তন বা শাশ্বত বিধান সম্পর্কে তাদের লেখাগুলো বিদ্বেষ ও নিন্দাবাদে ভরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের মন্তব্যের কোনো কোনো অংশে খুঁজে পাওয়া যায়,ইসলামের উজ্জ্বল বাস্তবতা ও কোরআনের গভীরতার মাত্রা। ইসলাম ও কোরআনের প্রাণসঞ্চারক ও আলোকোজ্জ্বল বাণী বা শিক্ষা আমার মধ্যে সৃষ্টি করেছে নতুন ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গিএবং সৃষ্টিজগত ও এর দর্শন সম্পর্কে আমার ধারণা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। আমি অনুভব করেছি যে ইসলামের শিক্ষাগুলো খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষার মত নয়,বরং ইসলাম মানুষকে সম্মানিত সত্তা বলে মনে করে। কোরআন মানুষের জীবনের পথ চলার পূর্ণাঙ্গ বিধান। এ মহাগ্রন্থ দুনিয়ার জীবনের নানা স্বাদ আস্বাদন ও জীব ব্যবহারের উপায় অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং প্রজ্ঞাপূর্ণভাবে বর্ণনা করেছে।”
ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক ও চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনঁ বিজ্ঞান,ইতিহাস ও সেমিটিক ভাষা নিয়ে অনেক গবেষণা এবং লেখালেখি করেছেন। তিনি বলেছেন,
“আমার পাঠাগারে রাজনৈতিক,সামাজিক ও সাহিত্য এবং অন্য অনেক বিষয়ের হাজার হাজার বই রয়েছে। এসব বইয়ের কোনোটিই আমি একবারের বেশি পড়িনি। কিন্তু একটি বই আছে যা সব সময়ই আমার প্রিয় । যখনই আমি ক্লান্তি অনুভব করি এবং পরিপূর্ণতা ও গভীর অর্থের দরজাগুলো খুলতে চাই তখন আমি এ বইটি পড়ি। এ বইটি খুব বেশি বেশি মাত্রায় পড়েও আমি ক্লান্ত(বা একঘেয়েমির শিকার) হই না,ও জড়তা অনুভব করি না। আর এ বইটি হল কোরআন,ঐশী বা আসমানি গ্রন্থ।”
ফরাসি প্রাচ্যবিদ ডক্টর গ্রিনি পবিত্র কোরআন ও ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন,“চিকিৎসা,স্বাস্থ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কিত বিষয়ে ইশারা রয়েছে কোরআনের এমন একটি আয়াত নিয়ে গবেষণা করে জানতে পারলামএ আয়াতটি যে কোনো বিচারেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।শিল্প বা বিজ্ঞান মহলের যে কেউ কোরআনের আয়াতকে শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা যা শিখেছে বা জেনেছে তার সাথে যদি তুলনা করেন ঠিক সেভাবে যেভাবে আমি তুলনা করেছি,তাহলে নিঃসন্দেহে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন। অবশ্য তারা যদি সুস্থ জ্ঞান-বিবেক ও বিদ্বেষ-মুক্ত মনের অধিকারী হন।”
মিশরের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক সাইয়্যেদ কুতুব মনে করেন কোরআনের শৈল্পিক ভাষা মানুষের মন-প্রাণের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি বলেছেন,“কোরআনের ভাষায় চিত্রকল্প বা চিত্রময়তার প্রয়োগ লক্ষ্যনীয় যা পাঠক/শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে। তাই কোরআনের তিলাওয়াত শুনে মানুষের মন ধেয়ে যায় উচ্চতর বাস্তবতার দিকে। এক্ষেত্রে শব্দগুলো মাধ্যম হলেও কোরআন যেসব প্রাঙ্গন বা পরিবেশ ও ঘটনাবলীর দৃশ্য তুলে ধরে তা জীবনের প্রকৃত অর্থেরই প্রকাশ।”
সাইয়্যেদ কুতুবের মতে,আল্লাহর বাণীর সুর কোরআনের চিরস্থায়ী শিল্প,এ সুর গভীর প্রভাব ফেলে মানুষের আত্মায়। কোরআনের উচ্চতর ভাবার্থ,শিল্প ও অনুভূতির সমন্বয় ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরবদের ওপর গভীরপ্রভাব রেখেছিল। তার মতে কোরআনের এইসব প্রভাব এত গভীর ও সূক্ষ্ম যে তা মানব জাতির সব প্রজন্মকেই এ মহাগ্রন্থের সৌভাগ্যময় বাণীর দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম ।
মানব সভ্যতার বিকাশে কোরআন ও ইসলামের রয়েছে অনন্য অবদান।
ঐতিহাসিকরা এ সত্য স্বীকার করেছেন যে ইসলাম-পূর্ব যুগে বিশ্ব নৈতিক ও জ্ঞানগত দিকে চরম অধঃপতনের শিকার হয়েছিল। অন্ধকার যুগে আরব সমাজে ছিল বলদর্পীতা ও হীনতার রাজত্ব। লুট-তরাজ ছিল বৈধ। মানুষ ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং হিংস্র আচরণে অভ্যস্ত। কিন্তু ইসলাম ও কোরআনের আলো বদলে দেয় বর্বর আরব জাতিকে। মানবিকতা,নৈতিকতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার সুবাদে আরব ও আশপাশের মুসলিম জাতিগুলো গড়ে তোলে উজ্জ্বলতম মানব-সভ্যতা।
সুইডেনের প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ইয়ান হিয়ারপে বলেছেন,“বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের গবেষণাগুলোর রয়েছে স্যেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দিক। আমরা যখন কোরআন নিয়ে গবেষণা করি,তখন এ গ্রন্থকে অন্যান্য প্রামাণ্য সনদের মতই মনে করি। কিন্তু আমার মতে,মানুষের ওপর কোরআনের ও এর সাহিত্য-মাধ্যমের প্রভাবকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যখন দেখি যে এ গ্রন্থ কিভাবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার সঞ্চার করেছে এবং এখনও মানুষের জীবনে কি প্রভাব ফেলছে -তা আমাদেরকে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে। কোরআন এমনসব শব্দমালা এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও ব্যাপক বিস্তৃতভাষা সৃষ্টি করেছে যে এ ব্যাপারে উদাসীন থাকা যায় না।”
ইয়ান আরও বলেছেন,“আমরা বর্তমানে এক বিশ্ব-রাষ্ট্রে বাস করছি। ইসলাম এই বিশ্ব-রাষ্ট্রের অংশ। তাই ইসলাম চিন্তাজগতে যে মডেল দিয়েছে,যার উৎস হল কোরআন তাকে উপেক্ষা করা যায় না। আজ ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যে হাজার হাজার বই ও প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে। আর এ থেকেই পাশ্চাত্যে ইসলামের সক্রিয় উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলাম সম্পর্কিত নানা শাস্ত্র অধ্যয়নের ব্যবস্থাও এর অন্যতম প্রমাণ। আর এ জন্যই ইউরোপীয়দের কাছে কোরআন বেশ গুরুত্ব পাছে এবং কোরআন সম্পর্কিত জ্ঞান আমাদের জন্য খুবই জরুরি।”
আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)বলেছেন,“যারা কোরআনের সঙ্গী হয়,তাদের একটি বিষয় বাড়ে ও একটি বিষয় কমে,যা বাড়ে তা হল হেদায়াত বা সুপথের আলো,আর যা কমে তা হল,মনের অন্ধকার”।