আল কোরআনের অলৌকিকতা (৩য় পর্ব)
  • শিরোনাম: আল কোরআনের অলৌকিকতা (৩য় পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:50:45 1-9-1403

পবিত্র কোরআন হচ্ছে আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ। কোরআন প্রতিটি মানুষকে সত্য উপলব্ধি করার আহ্বান জানায়। সূরা সোয়াদের ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি কল্যাণময় গ্রন্থ তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি,যাতে মানুষ এর আয়াতসমুহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে’।
পবিত্র কোরআনে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও মহাবিশ্বের এমন সব রহস্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে যা কোরআন নাজেলের হাজারো বছর পরে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করতে সক্ষম হচ্ছেন। ১৪শ’ বছর আগে কোরআন যখন মহাবিশ্ব, প্রকৃতি ও নভোমণ্ডল সম্পর্কে কথা বলেছে তখন আরব বিশ্বের মানুষ ওই সব বিষয়ে বিন্দুমাত্রও অবগত ছিল না। আরব বিশ্বের বাইরে গ্রীসসহ গুটি কয়েক দেশের কিছু দাশর্নিক প্রাকৃতিক বিষয়াদি সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখতেন।
পঞ্চম হিজরির প্রখ্যাত দার্শনিক ও ফকিহ ইমাম মোহাম্মদ গাজ্জালি কোরআনের অলৌলিকতা সম্পর্কে বলেছেন, যেহেতু সাধারণতঃ আল্লাহর সৃষ্টির মাধ্যমে তাকে চেনা সম্ভব হয় সেহেতু কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় সৃষ্টিজগতের নানা অলৌকিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
বর্তমান যুগেও যেসব উদারমনা বিজ্ঞানী কোরআন নিয়ে গবেষণা করেছেন তারা সবাই এটা স্বীকার করেছেন যে,বিজ্ঞান সম্পর্কে কোরআনে যেসব কথা বলা হয়েছে তা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কানাডার সাবেক খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক ও অধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার পবিত্র কোরআন সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। কোরআন নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যটা মোটেই ভালো ছিল না। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক হওয়ার কারণে তিনি ইসলাম ধর্মের নানা ভুল-ত্রুটি খুঁজে বেড়াতেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কোরআন ঘেটে এমন কিছু বিষয় বের করবেন যা ইসলামের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যাবে এবং কোরআনকে ঐশী ধর্ম হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা যাবে।
তিনি কোরআনে ভুল খোঁজার জন্য কাজ শুরু করলেন। কিন্তু তিনি কোরআন নিয়ে যতবেশি গবেষণা করলেন ততই বিস্মিত হতে থাকলেন। এভাবে কোরআন যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ সে বিষয়টি তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো। অবশেষে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল বলে যে তত্ত্ব বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “সত্য-প্রত্যাখ্যানকারীরা কি ভেবে দেখে না যে,আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এক সাথে মিশে ছিল। অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করলাম এবং সব প্রাণীকে পানি থেকে সৃষ্টি করলাম।”
ড.মিলার বলেছেন,এই আয়াতটি নিয়ে চিন্তা-গবেষণার পর কোরআন যে ঐশী গ্রস্থ তা মেনে নিতে বাধ্য হই। যারা প্রচার চালায় যে কোরআন হচ্ছে হযরত মোহাম্মদ (সা.)’র নিজস্ব বক্তব্য তাদের দাবি নাকচ করার জন্য এই একটি আয়াতই যথেষ্ট।
ড. মিলার বলেছেন, ১৪শ বছর আগে ইসলামের নবীর পক্ষে কীভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য নিয়ে কথা বলা সম্ভব, যিনি কোন দিন কোন স্কুলে পড়ালেখা করেননি। কারণ এটি এমন এক বৈজ্ঞানিক বিষয় যা সম্পর্কে তত্ত্ব আবিস্কার করে মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এক বিজ্ঞানী। মিলারের মতে,এই আয়াতে সেই বিগ ব্যাং’র কথাই বলা হয়েছে যার মাধ্যমে পৃথিবী, আকাশমন্ডলী ও তারকারাজি সৃষ্টি হয়েছে।
এই আয়াতের শেষাংশে পানিকে জীবনের উৎস বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়টিও আধুনিক বিজ্ঞানীদের প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রত্যেক প্রাণি দেহের মৌলিক গাঠনিক একক হচ্ছে কোষ এবং এই কোষের মূল উপাদান হচ্ছে সাইটোপ্লাজম। পানি ছাড়া কেউই তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। একারণে মহাকাশবিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহ বা উপগ্রহে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করেন, তখন তারা সর্বপ্রথমে খোঁজ করেন সেই গ্রহ বা উপগ্রহে কোনো পানির সন্ধান পাওয়া যায় কি-না। এর আগের অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা ফরাসি দার্শনিক ও চিকিৎসক মরিস বুকাইলি সম্পর্কে কথা বলেছি। তিনি তার “বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান” বইয়ে লিখেছেন, কোরআনের বিভিন্ন সূরায় সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে যেসব বক্তব্য এসেছে তার সবগুলোই আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি আরো লিখেছেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনের ঘটনা সম্পর্কে কোরআনের দু’টি আয়াতে সংক্ষেপে বর্ণনা এসেছে। এর একটি হলো সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াত। যেখানে মহাবিস্ফোরণের কথা বলা হয়েছে।
অন্যটি হলো সূরা ফুস্সিলাতের ১১ নম্বর আয়াত যেখানে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অস্তিত্বের কথা বলে। ওই আয়াতে এসেছে, “অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধোঁয়ার পুঞ্জবিশেষ, এরপর আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি হতে নির্দেশ দেন। এখানে ধূম্রপুঞ্জ শব্দটি বিশ্বের আদিম অবস্থার সঠিক বর্ণনা দিচ্ছে, যা ছিল গরম গ্যাসের পিণ্ড যাতে বস্তুকণা দ্রুত ছোটাছুটি করছে, ধোঁয়ার মত। এ থেকে গ্রহ, নক্ষত্র ও পৃথিবী তৈরি হয়।”
মরিস বুকাইলি বলেছেন, বিশাল জায়গাজুড়ে যে ছায়াপথ রয়েছে তা প্রথমে কী ছিলো, সে ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞান এখনও উত্তর দিতে পারেনি। আধুনিক বিজ্ঞান যা বলতে পারছে তাহলো বিশ্ব গ্যাসের পিণ্ড থেকে সৃষ্টি হয়েছে যা ঘূর্ণায়মান ছিল এবং এর মূল উপাদান হচ্ছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। তারপর নীহারিকা দৃশ্যমান বিভিন্ন খণ্ডে খণ্ডিত হয়েছে।
আমরা মহাবিশ্ব সৃষ্টির বিষয়ে কথা বলছিলাম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিস্ফোরণ বা বিং ব্যাং’র মাধ্যমেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, ওই বিস্ফোরণের পর অতি দ্রুততার সঙ্গে যেসব পদার্থ ছড়িয়ে পড়েছিল তা থেকেই ছায়াপথ, সুর্য্য, তারা, পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
তারা বলছেন, ওই বিস্ফোরণের পর ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে যাতে তিল পরিমাণ বিঘ্ন সৃষ্টি হলে সব কিছু উলটপালট হয়ে যাবে। মহাবিশ্বে এই যে সুনিপুন শৃঙ্খলা, এর অর্থই হলো এর সৃষ্টিকর্তা রয়েছে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তা সৃষ্টি করেছেন।
ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফোর্ড হাবিল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন মহাবিশ্ব একটি বিস্ফোরণে মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু আমরা জানি, যে কোন বিস্ফোরণের ফলে যেসব উপাদান ছিটকে পড়ে তা কখনোই কোন নিয়ম মেনে বা সুশৃঙ্খলভাবে বেরোয় না। কিন্তু মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং’র ক্ষেত্রে এর উল্টো ঘটনাটি ঘটেছে। এটা বিস্ময়কর। কাজেই বিগ ব্যাং’র মাধ্যমে যদি কোন সুশৃঙ্খল ও সুনিপুণ ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সেখানেই ঐশি হস্তক্ষেপ ছিল। অন্যদিকে পৃথিবী নামক গ্রহের অস্তিত্বও বিস্ময়কর। এটি এমন একটি গ্রহ যেখানে প্রাণিকূলের জীবন যাপনের জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে যা কোন ভাবেই দুর্ঘটনাক্রমে হওয়া সম্ভব নয়।
কাজেই আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করছি তা এমন এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেরই প্রমাণ বহন করছে যিনি শুন্য থেকে সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টিতে সুনিপুণ শৃঙ্খলা দিয়েছেন।

ঐশী প্রত্যাদেশ বা ওহী এবং বুদ্ধিমত্তা বা আকল মানুষের জ্ঞান অর্জনের দু’টি প্রধান উৎস। মহান আল্লাহ নবী-রাসূলদের কাছে যে ওহী পাঠিয়েছেন তার সুবাদে মানুষের কাছে বিশ্ব জগতের অনেক রহস্য ও বাস্তবতা স্পষ্ট হয়েছে। মানুষ তার প্রতিভা বা আকলকে কাজে লাগিয়ে, অভিজ্ঞতা ও প্রচেষ্টার সুবাদেও কিছু জ্ঞান অর্জন করে। এ দুই উৎসের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাবিদরা যুগে যুগে অনেক গবেষণা করেছেন। অনেকে মনে করেন আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক তথ্য বা মত পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তুগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা একে কোরআনের বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতা বলে অভিহিত করেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান বা তথ্য আমাদের কাছে বিশ্ব জগতের অনেক রহস্য উন্মোচন করে এবং মহান আল্লাহর অশেষ শক্তি, ক্ষমতা, নৈপুণ্য ও শৈল্পিক কুশলতা সম্পর্কে চিন্তার খোরাক জোগায়। মহান আল্লাহ বহু আকাশ ও জমিনগুলোসহ এর মধ্যকার সব কিছু ছয় যুগে সৃষ্টি করেছেন বলে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন। এ বক্তব্য নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে।
ফ্রান্সের মরিস বুকাইলি ও লাপ্লাস, রাশিয়ার জর্জ গামুফ মনে করেন- কোরআনের দেয়া তথ্যগুলো নতুন বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এ মহাগ্রন্থের ৭৫০টিরও বেশি আয়াতে সৃষ্টি জগতের রহস্য নিয়ে বক্তব্য এসেছে।
সৃষ্টি জগতের নানা বিষয় নিয়ম ও লক্ষ্যের চাহিদা অনুযায়ী নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সৃষ্টির নানা বিস্ময়কর নিদর্শন স্রষ্টার মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিশ্ব জগতের কাঠামো সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে। যেমন, গ্রহ-নক্ষত্রের নানা ভূবন বা জগত রয়েছে যেখানে এসব গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যাকর্ষণ ক্ষমতা, শৃঙ্খলার চলক ও রক্ষণাবেক্ষণ নিজ নিজ অক্ষপথকেন্দ্রীক। বিজ্ঞানী নিউটন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের পর এর চেয়েও আরো গভীর বাস্তবতার সন্ধান পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, “গ্রহ-নক্ষত্রের জগতের নানা বিস্ময় ব্যাখ্যা করার জন্য কেবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়। আসলে অত্যন্ত শক্তিশালী ও মহাজ্ঞানী এক উৎস এসব গ্রহ-নক্ষত্রের চলার পথ, গতি, ব্যবধান প্রভৃতি সূক্ষ্মভাবে হিসেব করেছেন এবং এসব গ্রহ-নক্ষত্রকে নির্দিষ্ট অক্ষ পথে স্থাপন করেছেন। আর এই উৎসই হলেন খোদা।”
পবিত্র কোরআনের সূরা রাদের ২ নম্বর আয়াতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে ইশারা রয়েছে। এ আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ, যিনি উর্ধ্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে অদৃশ্য স্তম্ভ দিয়ে বা দৃশ্যমান স্তম্ভ ছাড়াই। অতঃপর তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন ( তথা বিশ্ব পরিচালনার নিয়ন্ত্রণকে নিজ ক্ষমতার আওতায় এনেছেন) । এবং সূর্য ও চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক আবর্তন করে। তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শনগুলো প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাত সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাসী হও।”
মহান আল্লাহ কোরআনের আয়াতে আকাশগুলোকে তারকারাজি দিয়ে সুশোভিত বা সাজানোর কথা বলেছেন। এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার উৎসাহ দিয়ে তিনি বলেছেন, “তারা কি তাদের উপরস্থিত আকাশের পানে তাকায় না আমি কিভাবে তা নির্মাণ করেছি এবং সুশোভিত করেছি? তাতে কোন ছিদ্র বা ফাটলও নেই।”
মহান আল্লাহ সুর্য ও এর আলো, চাঁদ ও এর গতির কথা এবং সুপরিকল্পিতভাবে এসব সৃষ্টির কথা বলেছেন। জ্যোতি-পদার্থ বিদ্যা বা এস্ট্রোফিজিক্সের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, আমাদের সৌর জগত বা সূর্যকেন্দ্রীক এই মহাকাশে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাইরের ছায়াপথমুখী একটি প্যাঁচানো গতি রয়েছে। সূরা ইয়াসিনের ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, সূর্য তার নির্দিষ্ট অক্ষ বা অবস্থানের দিকে সব সময় গতিশীল বা আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ।
সূরা নুহের ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ কিভাবে সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। এবং সেখানে চন্দ্রকে রেখেছেন আলোরূপে এবং সূর্যকে রেখেছেন প্রদীপরূপে।”
ভূপৃষ্ঠ বা পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য ও এর গঠন এবং সৃষ্টি কৌশল নিয়ে বক্তব্য রয়েছে পবিত্র কোরআনে। অতীতে মানুষ মনে করত পৃথিবী স্থির। মহান আল্লাহ সূরা নামলের ৮৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, তুমি পর্বতমালাকে দেখে অচল মনে কর, অথচ সেদিন এগুলো মেঘমালার মত চলমান।”
অনেক তাফসিরকারক মনে করেন পাহাড়ের গতিশীলতার কথা বলে কোরআন আসলে পৃথিবী যে গতিশীল সেটাই হয়তো বলতে চেয়েছে। পৃথিবী যে গতিশীল তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে। সূরা ত্বাহা’র ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
“তিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে শয্যা বা দোলনা করেছেন এবং তাতে চলার পথ করেছেন, …”
দোলনার ধীর গতির দোলা যেমন শিশুকে প্রশান্ত করে এবং তার চোখে ঘুম নিয়ে আসে তেমনি পৃথিবীও মানুষের জন্য ধীর গতির দোলার মাধ্যমে প্রশান্তি দেয়। পৃথিবী যে গোলক আকৃতির বা গোলাকার তাও কোরআন পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছে। মহান আল্লাহ সূরা মাআরেজের ৪০ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আমি শপথ করছি উদয়াচল ও অস্তাচলগুলোর পালনকর্তার, নিশ্চয়ই আমি সক্ষম!”
এখানে কয়েকটি পূর্ব ও কয়েকটি পশ্চিমের কথা বলা হয়েছে। পৃথিবী সমতল হলে তাতে কেবল একটি পূর্ব ও একটি পশ্চিম দিক থাকত। কিন্তু গোলাকার হওয়ায় সব জায়গাতেই একটি পূর্ব ও একটি পশ্চিম দিক তথা উদয়াচল ও অস্তাচল রয়েছে।
সৃষ্টি তত্ত্ব বা রহস্য বর্ণনা করে কোরআন মানুষকে আল্লাহমুখী বা আল্লাহর পরিচিতির দিকে আকৃষ্ট করতে চায়। মানুষের হাতের মুঠোয় এত যে ব্যাপক নেয়ামত এনে দেয়া হয়েছে তা থেকে বোঝা উচিত মানুষকে বিনা উদ্দেশ্যেই এসব নেয়ামত ও শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি। তাই মানুষকেও এ বিশ্ব জগতে তার অবস্থান ও দায়িত্ব বুঝতে হবে। কোরআনের সূরা আম্বিয়ায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “আমি আকাশ ও জমিনে যা কিছু আছে তা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। “
প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবায়ি’র মতে, কোরআনে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নানা শাখাসহ জ্ঞানের সব শাখার তথ্য রয়েছে এবং কোরআন এসব জ্ঞান মানুষকে উপহারদিয়েছে তার কল্যাণ, সৌভাগ্য ও মুক্তির জন্য। তবে শর্ত হল মানুষকে প্রকৃত বিশ্বদৃষ্টি, যার মূলে রয়েছে আল্লাহর পরিচিতি- সেই বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে এসব জ্ঞান চর্চা করতে হবে। কারণ, যেসব জ্ঞান মানুষকে মূল্যহীন বিষয়ে ব্যস্ত রাখে এবং আল্লাহকে ও বাস্তবতাকে চেনা বা জানা থেকে বিরত রাখে কোরআনের দৃষ্টিতে তা অজ্ঞতার সমতুল্য। (ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন, পৃ-৬৪) #
ঐশী জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে সুশৃংখল এই বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে। আর সৃষ্টি জগতের সর্বত্রই রয়েছে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অস্তিত্বের নিদর্শন। আর এই পৃথিবীতে মানুষ হচ্ছে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষকে সৃষ্টির রহস্য উপলব্ধি এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার গুরু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব- মানুষকে ওই দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগালে সহজেই জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে এবং পৃথিবীতে আরো উন্নত সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
মানব ভ্রুণ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় এবং মানব সৃষ্টিতে ব্যবহৃত উপাদান সম্পর্কে কোরানের আয়াতগুলো বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতা হিসেবে গণ্য করা হয়। পবিত্র কোরানের সূরা আনআম, হজ্ব, মু’মিনূন, রুম ও সিজদায় এ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। সূরা মুমিনূনের ১২ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে মানব ভ্রুণের বিকাশের প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। এ আয়াতের শুরুতে মানুষকে কাদা মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি মানুষকে মাটির উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছি।অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি। এরপর জমাট রক্তকে মাসংপিণ্ডে পরিণত করি এবং মাংসপিণ্ডকে অস্থিপঞ্জরে, অতঃপর অস্থিপঞ্জরকে মাংস দিয়ে ঢেকে দেই। অবশেষে আমি আরেক রূপ দেই। অতএব কত মহান সেই আল্লাহ যিনি শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিকর্তা।
ভ্রুণ সম্পর্কে কোরানের বক্তব্যের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বের প্রায় হুবহু মিল রয়েছে। আর এ কারণে আধুনিক যুগের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা বিস্মৃত হয়েছেন। ড. কেইট মোর হলেন ভ্রুণতত্ত্বের জনক। তিনি ১৯৮৪ সালে কানাডার বিজ্ঞান বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারটি পেয়েছেন। কোরানে ভ্রণতত্ত্ব সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে কথা বলতে তাকে একবার একটি মুসলিম দেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি প্রথমে এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, কোরান হচ্ছে এক হাজার চৌদ্দশ’ বছর আগের এক গ্রন্থ। কাজেই সেখানে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কিছুই থাকার কথা নয়। কারণ মাত্র প্রায় ৫০ বছর আগে ভ্রুণ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। ড. কেইট মোর এ বিষয়ে কোরানের দূর্বল দিকগুলো তুলে ধরার মনোবাসনা নিয়ে মুসলিম দেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি ভ্রুণ সম্পর্কে কোরানের কয়েকটি আয়াত পড়ে দেখার পর বিস্মিত হন এবং এরপর তার দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তন আসে। তিনি বলেছেন, কোরানের ভ্রুণ সংক্রান্ত বেশির ভাগ বক্তব্য আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়। তিনি আরো বলেছেন, এ সংক্রান্ত কোরানের আরো কিছু বক্তব্য আছে যেগুলো সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট জ্ঞান নেই। কারণ কোরানে ভ্রুণ সম্পর্কে আরো যেসব কথা বলা হয়েছে,বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কথা বলেনি। এক হাজার চারশ’ বছর আগে কোন ব্যক্তির পক্ষে এমন তত্ত্ব দেয়া সম্ভব নয় বলে তিনি জানিয়েছেণ। কোরান যে আল্লাহর বাণী অবশেষে কেইট মোরই তা স্বীকার করেছেন।
ড. মোর ঐশী গ্রন্থ কোরানের কোন ত্রুটিতো খুঁজে বের করতে পারেনইনি বরং কোরান থেকে পাওয়া তথ্য ও জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি তার প্রকাশিত কয়েকটি বই ও নিবন্ধে মৌলিক পরিবর্তন এনেছেন। তার একটি বই হলো মানব বিকাশ সম্পর্কে। তিনি ওই বইয়ের নতুন সংস্করণেও বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন। ওই বইটি ১৯৮২ সালে চিকিৎসা বিষয়ক সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে এবং অনেক দেশে তা পাঠ্যবই হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
কেইট মোর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেছেন, মানুষের বিকাশ সংক্রান্ত কোরানের বক্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। তিনি আরো বলেছেন, আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে, কোরানের বানী আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মোহাম্মদ(স.) এর কাছে পাঠানো হয়েছে। কারণ রাসূলের যুগের কয়েক শ বছর পরেও ভ্রুণ সংক্রান্ত সব বিষয় আবিস্কৃত হয়নি। আমি নিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করে, রাসূল হচ্ছে আল্লাহর দূত।
তার মতে, বর্তমানে ভ্রুণের বিকাশের যে পর্যায়গুলোর কথা বলা হয় তা খুব সহজে বোধগম্য নয়। কিন্তু কোরানে ভ্রুণের বিকাশের পর্যায়গুলোকে সুস্পষ্টভাবে বিভাজন করা হয়েছে। এর ফলে সহজে তা বোধগম্য। কোরানের বক্তব্য অনুযায়ী আল্লাহতায়ালার নির্দেশে ভ্রুণের পরিপূর্ণতার সকল পর্যায় সম্পন্ন হয়। সুরা এনফেতারের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন ,অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। তিনি তোমাকে তার ইচ্ছামত আকৃতিতে গঠন করেছেন।
মানুষ তার অস্তিত্বের প্রথম পর্যায়ে ভুমিষ্ঠ হওয়ার আগে ভ্রুণ অবস্থায় থাকে। জন্মের পর মানুষ অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করে। সুরা হজ্বের ৫ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমাদের সন্দেহ থাকে তবে এ বিষয়টির দিকে লক্ষ্য করো যে, আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর শুক্র হতে ,তারপর রক্তপিণ্ড হতে। যেন আমি তোমাদের সুবিদিত করি। আমি যা ইচ্ছা করি,তা এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে রেখে দেই।, তারপর আমি তোমাদের শিশুরুপে বের করি, যেন তোমরা স্বীয় যৌবনে উপনীত হও। তোমাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্য ঘটে। কেউ কেউ এতদিন বেচে থাকে যে জীবনের সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌছে দেয়। যার ফলে তারা যা জানতো সে সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না।
ভ্রুণবিদ্যা অনুযায়ী, ভ্রুণ অবস্থায় মানুষের যে ইন্দ্রিয়টি সক্রিয় হয় তাহলো শ্রবণ ইন্দ্রিয়। ভ্রুণ অস্তিত্ব লাভের ২৪ সপ্তাহ পর থেকে শব্দ শুনতে পায়। এর পরবর্তী পর্যায়ে ভ্রুণের দৃষ্টি শক্তি বিকশিত হয়। ২৮ সপ্তা বয়স থেকে চোখের রেটিনা আলোর সামনে প্রতিক্রিয়া দেখায়। সুরা সিজদার ৯ নম্বর আয়াতে ভ্রুণের ইন্দ্রিয় শক্তি সক্রিয় হওয়া সম্পর্কে এভাবে বর্ণনা করেছেঃ অতপরঃ তিনি ওকে সুঠাম করেছেন, তাতে রুহ সঞ্চার করেছেন তার নিকট হতে এবং তোমাদের দিয়েছেন চোখ,কান ,অন্তর।
ড. মোর কোরানের বৈজ্ঞানিক দিকগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর কোরানের বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতা সংক্রান্ত অধিকাংশ সম্মেলনেই অংশ নিয়েছেন। রাশিয়ার এক সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি মুসলিম ও অমুসলিম জ্ঞানী-গুণিদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ওই সম্মেলন রাশিয়ার একটি টিভি চ্যানেল থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে। ওই সম্মেলনের ফলে রাশিয়ার ৩৭ জন বিজ্ঞানী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ড.মোর মুসলমান হয়েছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে, এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, কোরান আল্লাহর গ্রন্থ এবং মোহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। এরপর প্রশ্নকর্তা বলেন, তাহলে আপনি এখন মুসলমান?
তিনি এরপর বলেছিলেন, আমি মুসলমান হওয়ার কথা এখনো ঘোষণা করিনি কিন্তু তারপরও আমি সামাজিকভাবে নানা চাপের মধ্যে আছি। এর এক বছর পর ভ্রুণ তত্ত্বের জনক ড. কেইট ইসলাম গ্রহণের কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেন। ড. কেইটের মতো আরো অনেক বিজ্ঞানী আছেন যারা আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ইসলামের প্রতি ঈমান আনছেন।
মার্কিন নাগরিক ও বিজ্ঞানী মার্শাল জনসন ভ্রুণতত্ত্ব সম্পর্কিত আয়াত প্রসঙ্গে বলেছেন, ভ্রুণের বিকাশের পর্যায়গুলো সম্পর্কে কোরানের বর্ণনা দুর্ঘটনাজনিত হতে পারে না। কেবলমাত্র শক্তিশালী মাইক্রোসকোপের সাহায্যেই এ বাস্তবতা আবিস্কার করা সম্ভব। কোরান হলো, ১ হাজার চৌদ্দশ বছর আগের গ্রন্থ। সে সময় কোন মাইক্রোসকোপের অস্তিত্ব ছিল না। তখনও মাইক্রোসকোপ আবিস্কৃতই হয়নি। কোরান নাজিলের বহু বছর পরে যখন মাইক্রোসকোপ আবিস্কৃত হলো তখন ওই মাইক্রোসকোপ কোন বস্তুকে ১০ গুণের বেশি বড় করতে পারতো না এবং এর স্বচ্ছতাও কম ছিল। কাজেই কোরানের বাণী মানুষের হতে পারে না।
কোরান হলো, মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করার দিকনির্দেশনা। প্রাকৃতিক বিষয়াদি সম্পর্কে কোরানে যেসব সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ও বক্তব্য রয়েছে তা চিন্তাশীলদের জন্য পথনির্দেশক। সুরা আল ইমরানের ১৯০ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: নিশ্চয় আকাশ ও জমিন সৃষ্টিতে এবং দিন ও রাতের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে।
কোরানের আয়াত আমাদেরকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয় যে , আল্লাহতায়ালা মানুষকে তার কিছু গুণ মানুষকে আমানত হিসেবে দিয়েছেন। যদি এসব গুণ ধারণ করে মানুষ এগিয়ে যায় এবং যোগ্যতাকে বিকশিত করার চেষ্টা চালায় তাহলে অনেক কিছু অর্জন করতে পারবে। পৃথিবীর মানুষ তার মাধ্যমে উপকৃত হবে।

পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু সমুদ্রের পানির স্বাদ কটু ও নোনা। অবশ্য সমুদ্রের আশপাশের স্থলভাগের নিচের পানি বা ভূগর্ভস্থ পানি নোনা ও তিক্ত হয় না। যদি সাগরের নোনা পানি ভূগর্ভস্থ মিষ্টি পানির সাথে মিশে যেত তাহলে এই পানিও পানের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ত। পবিত্র কোরআনে সাগরগুলোর পানির মধ্যে দেয়াল থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলামী সংস্কৃতিতে পানি পবিত্রতা ও জীবনের প্রতীক এবং পানিকে সর্ব সাধারণের সম্পদ ও শ্রেষ্ঠ পানীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কোরআনে ৫৯ বার পানি শব্দটি স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে পানিকে জীবনের উৎস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের সুরা আম্বিয়ার ত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে
“..প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। ..”বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) পানিকে শ্রেষ্ঠ পানীয় বলে উল্লেখ করেছেন। পানি সংক্রান্ত গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হল নোনা ও মিষ্টি পানি। সুরা ফোরকানের ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“তিনিই সমান্তরালে দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন, এটি মিষ্ট, তৃষ্ণা নিবারক ও এটি লোনা, বিস্বাদ; উভয়ের মাঝখানে রেখেছেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল।”
কোরআনে সাগর বা সমুদ্র সম্পর্কে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে সেসব তথ্য মানুষ শত শত বছর ধরে জানত না। সূরা নামলের ৬১ নম্বর আয়াতেও “দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায়” থাকার কথা এসেছে। এ আয়াতে দুই সাগরের পানির বৈশিষ্ট্য হিসেবে “স্বচ্ছ ও মিষ্টি পানি” এবং “নোনা ও কাদাযুক্ত” পানির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা ফাতিরের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,”দু’টি সমুদ্র সমান হয় না-একটি মিঠা ও তৃষ্ণা-নিবারক এবং অপরটি লোনা। উভয়টি থেকেই তোমরা তাজা গোশত (মৎস্য) আহার কর এবং পরিধানে ব্যবহার্য গয়নাগাটি আহরণ কর। তুমি তাতে তার বুক চিরে জাহাজ চলতে দেখ, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”
সমুদ্র সম্পর্কিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সুবাদে এটা স্পষ্ট যে সাগর উপকূলে মিষ্টি পানির প্রবাহ পাওয়া যায় এবং এসব প্রবাহের ওপর নোনা পানির কোনো প্রভাব নেই। মিষ্টি পানির ওজন নোনা পানির চেয়ে হাল্কা হওয়ায় মিঠা পানি নোনা পানির ওপরে থাকে। এ দুই পানির মধ্যে থাকে অভিন্ন পর্দা বা আড়াল। বেশিরভাগ জীব-জন্তু পাওয়া যায় উপকূলীয় অঞ্চলে। যেমন, শৈবাল, শামুক, মাছ প্রভৃতি। উপকূলীয় অঞ্চলের পানির সর্বোচ্চ গভীরতা ২০০ মিটার। তাই সূর্যের আলো এই গভীরতায় পৌঁছতে পারে। ফলে মাছসহ বিভিন্ন জীব-জন্তু এসব অঞ্চলে ব্যাপক হারে জন্ম নেয় যা মানুষের খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এ ছাড়াও সমুদ্রের উপকূলীয় অঞ্চলে উর্বর বা সমৃদ্ধ পলি জমে। এ অঞ্চলে লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালমুনিয়াম ও বিভিন্ন ধরণের ধাতব লবণ এবং ধাতু ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ধরণের বৈশিষ্ট্য পূর্ণ নোনা দরিয়া রয়েছে। এসব দরিয়ার পানির প্রবাহ সব সময়ই আলাদা থাকে। যেমন,লোহিত সাগরের পানি ভারত মহাসাগরের পানির চেয়ে বেশি গরম এবং এ সাগরে লবণও বেশি। এ দুই সাগরের মধ্যে রয়েছে মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের নির্দিষ্ট পানি সীমা।
কয়েকটি সাগর মিলিত হয়ে গড়ে ওঠে মহাসাগর। এসব সাগরের পানির ঘনত্ব, তাপমাত্রা, উপাদান ও জীবনের পরিবেশ ভিন্ন ধরণের। কিন্তু এসব সাগরের মধ্যে রয়েছে অদৃশ্য সীমানা বা দেয়াল যা সাগরগুলোর পানিকে পরস্পরের সাথে মিশতে দেয় না। বিংশ শতকে আধুনিক উপগ্রহ থেকে বিভিন্ন মহাসাগরের পানির আলোকচিত্র নেয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে সাগরগুলোর পানির রং এক নয় এবং কয়েকটি সাগর মিলে একটি মহাসাগর গঠিত হওয়া সত্ত্বেও সেসবের পানি পরস্পরের সাথে মিশে যায় না বা নিজ সীমানা লংঘন করে না। বিশেষ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই এই স্বাতন্ত্র বা পার্থক্য বজায় থাকে। ঘনত্বের পার্থক্য এ আকর্ষণ তৈরি করে এবং এর ফলে সৃষ্ট একটি কোমল দেয়াল বা পর্দা এক সাগরের পানির সাথে অন্য সাগরের পানিকে মিশতে দেয় না। এমনকি বিশাল ঢেউ ও স্রোতের প্রবাহও এই দেয়ালকে ভাঙ্গতে পারে না।
ফরাসি চিন্তাবিদ ও চিকিৎসক অধ্যাপক মরিস বুকাইলি বলেছেন, “সাগরগুলো সম্পর্কে কোরআনের আয়াত বা বক্তব্যগুলোর সাথে এ মহা গ্রন্থ নাজেল হওয়ার সময়কার সাগর সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তী ও বক্তব্যগুলোর কোনো মিল নেই। আধুনিক বিজ্ঞান সাগরের নোনা পানির সাথে নদীর মিঠা পানির মিশ্রিত না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে। অনেকে বিষয়টিকে কেবল ফোরাত ও টাইগ্রিস সম্পর্কে প্রযোজ্য মনে করেন। কিন্তু মিসিসিপি ও ইয়াংসি’র মত বড় নদীর ক্ষেত্রেও কোরআনের এ বক্তব্য সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোরআনের এসব আয়াত এ মহা গ্রন্থের অলৌকিকতাই তুলে ধরছে। সাগর থেকে মুক্তা ও মূল্যবান অলঙ্কার বা গয়না যে আহরণ করা যায় কোরআন তাও উল্লেখ করেছে যা পাঠককে এসব বিষয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার আমন্ত্রণ জানায়।”
অনেক আলেম মনে করেন মিষ্টি পানি ও নোনা পানির সাগর পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য বজায় থাকার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ কাফের ও মুমিনদের পার্থক্যও তুলে ধরেছেন। তিনি মুমিনদেরকে “স্বচ্ছ ও মিষ্টি পানি” এবং কাফেরদেরকে “নোনা ও কাদাযুক্ত” পানির সাথে তুলনা করেছেন যদিও তারা পৃথিবীতে পাশাপাশি বসবাস করে।
মুমিনদের মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলো পবিত্র। তারা সৎ কাজের মাধ্যমে চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের অধিকারী। কিন্তু অবিশ্বাসীরা মানবীয় প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে বিভ্রান্ত ও ধ্বংসের শিকার হয়। কাফেররা দুনিয়ার নানা নেয়ামত ভোগ করা সত্ত্বেও মুমিনদের মত সত্যের অনুসারী নয় এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য অভিন্ন নয়। সুরা নুরের ত্রিশ ও ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“যারা কাফের, তাদের কাজ মরুভুমির মরীচিকার মত, যাকে পিপাসার্ত ব্যক্তি পানি মনে করে। এমনকি, সে যখন তার কাছে যায়, তখন কিছুই পায় না এবং পায় সেখানে আল্লাহকে, এরপর আল্লাহ তার হিসাব চুকিয়ে দেন। আল্লাহ দ্রুত হিসাব নেন। অথবা (তাদের কাজ) প্রমত্ত সমুদ্রের বুকে গভীর অন্ধকারের মত, যাকে উদ্বেলিত করে তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ, যার ওপরে ঘন কালো মেঘ আছে। একের ওপর এক অন্ধকার। যখন সে তার হাত বের করে, তখন তাকে একেবারেই দেখতে পায় না। আল্লাহ যাকে জ্যোতি দেন না, তার কোন জ্যোতিই নেই।”
সমুদ্র বিজ্ঞান অনুযায়ী সূর্যের আলোর তিন থেকে ত্রিশ ভাগ সাগরে প্রতিফলিত হয়। তাই ২০০ মিটার গভীর সাগরে নীল রং ছাড়া আলোর সবই রংই মিশে যায়। সাবমেরিনসহ নানা উন্নত সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন গভীর সাগরের পানির ঘনত্ব বেশি হওয়ায় দুই ধরণের ঢেউ সৃষ্টি হয়। ওপরের ঢেউ ও ভেতরের ঢেউ। নিচের ঢেউ অন্ধকার হওয়ায় দেখা যায় না। সাগর বিষয়ক জার্মান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দুগারো মনে করতেন বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে ধর্মের দরকার নেই। কিন্তু সুরা নুরের এ আয়াত শোনার পর তিনি বলেছেন, ” এসব কথা কোনো মানুষের কথা হতে পারে না, এ আয়াত ইসলামের অলৌকিকতার প্রমাণ”।(রেডিও তেহরান)