শিল্প-সৌন্দর্য্য ও ধর্ম মানুষের জীবনের গভীর মর্মমূলে প্রথিত হয়ে আছে। কোরআনের সারগর্ভ ও শিক্ষনীয় কাহিনীগুলো মানুষকে প্রকৃত মূল্যবোধ ও প্রকৃত সৌন্দর্য্যের দিকে আহ্বান জানায়। কোরআনের কাহিনীগুলোতে সৌন্দর্য্যের যেসব দিক বা মূল্যবোধ রয়েছে সেগুলো সৌন্দর্য্য-পিয়াসী মানুষের জন্য আদর্শ ও তা মানুষের পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। কারণ, সব সৌন্দর্য্য ও পরিপূর্ণতার উৎস হলেন অতুলনীয় সত্তা মহান আল্লাহ। তাই মানুষ প্রকৃতিগতভাবে মহান আল্লাহর অশেষ সৌন্দের্য্যের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং এ পথেই তারা পরিপূর্ণতা পেতে চায়।
পবিত্র কোরআনের সুরা হিজরের ৩৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ মিথ্যা সৌন্দর্য্য ও বাহ্যিক চাকচিক্য সম্পর্কে শয়তান বা ইবলিসের ঘটনা তুলে ধরেছেন:
“সে অর্থাৎ ইবলিস বললঃ হে আমার পলনকর্তা,আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে (বস্তুগত) নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ঠ করে দেব।”
শয়তান অশ্লীলতা, পাপ, মন্দ কাজ ও অনাচার ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এসব কাজকে মানুষের কাছে সুন্দর চেহারায় তুলে ধরে যাতে তাদের সর্বনাশ ঘটে। অন্যদিকে কোরআন মানুষকে উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় ও চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়। আর এ লক্ষ্যেই সুন্দর ও আকর্ষণীয় কিছু সত্য ঘটনা বা কাহিনী তুলে ধরেছে বিশ্বনবী (সা.)’র কাছে নাজেল হওয়া মহাগ্রন্থ আল কোরআন। যেমন, ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে এ মহাগ্রন্থ হযরত আইয়ুব (আ.)’র কাহিনী বর্ণনা করেছে। তাঁর ঘটনা আমাদের এটা শেখায় যে, সংকট আর বিপদ-মুসিবৎ যত বেশি ও প্রবল হোক না কেন সেসবের মোকাবেলায় পাহাড়ের মত অবিচল ও ধৈর্যশীল হওয়া একটি অতি উন্নত নৈতিক গুণ। ধৈর্য্য মানুষের আচার-ব্যবহারকে সুন্দর করে এবং ধৈর্যশীল মানুষ অন্যদের প্রশংসা ও সম্মানের পাত্র হন। কোরআন একই ধরণের গুণ তথা ক্ষমাশীলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে হযরত ইউসুফ (আ.)’র পক্ষ থেকে তাঁরহিংসুক ভাইদের ক্ষমা করে দেয়ার ঘটনা উল্লেখ করেছে। কোরআনে বর্ণিত বিবি মরিয়ম (সা.) বা হযরত ঈসা (আ.)’র মায়ের ঘটনায় পবিত্রতা, সতীত্ব ও আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতার অনন্য মহিমা প্রকাশিত হয়েছে।
হযরত ইউনুস (আ.)’র ঘটনায় মাছের পেটে আটকা পড়া সত্ত্বেও আশাবাদী মন নিয়ে একান্ত প্রার্থনার এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে। এ ঘটনা থেকে আমরা এটা শিখতে পারি যে, চরম কষ্ট ও সংকটের সময়ও আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া উচিত নয়। এভাবে কোরআন একত্ববাদী জীবনের নানা সৌন্দর্য্য তুলে ধরে। কোরআনে বর্ণিত ফেরাউন সম্পর্কিত ঘটনায় আমরা ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আসিয়া (সা.)’র অন্যন্য চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সাহসের সৌন্দর্য্য প্রত্যক্ষ করি। ফেরাউনের মত প্রবল প্রতাপান্বিত অত্যাচারী রাজার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বিবি আসিয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ঈমানের বিপদসংকুল পথ বেছে নেন এবং রাজকীয় বিলাস, পদ-মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধাকে দু-পায়ে দূরে ঠেলে আল্লাহর পথে চরম বিপদকেও হাসিমুখে বরণ করে নেন।
এক আল্লাহর প্রতি নিবেদিত প্রাণ ও আন্তরিক ঈমানের ঘোষণার আরেকটি সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র এ ঘোষণায়: “আমি আন্তরিক বিশ্বাস নিয়ে বা একনিষ্ঠ চিত্তে মুখ ফিরিয়েছি ঐ সত্তার দিকে,যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেক বা অংশিবাদী নই।” (সুরা আনআম-৭৯)সুরা আনআমের ৭৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত এ ঘোষণা একজন মুমিন মুসলমানের জন্য অনুকরণীয় প্রধান আদর্শ ও মৌলিক নীতি-বাক্য।
কোরআনের কাহিনীগুলোর কিছু কিছু সৌন্দর্য্য বর্ণনার কৌশল ও পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত এবং কিছু কিছু নান্দনিকতা কাহিনীর উপাদান ও বিশেষ অংশের সাথে সম্পর্কিত। কোরআনে বর্ণিত ঘটনা বা কাহিনীগুলোর অপূর্ব বিন্যাস ও শৃঙ্খলাও এ মহাগ্রন্থের অলৌকিকতার এবং সৌন্দর্য্যের অন্যতম নিদর্শন। সত্য ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও এসব কাহিনীকে বিশেষভাবে সাজিয়ে বলার নৈপুণ্য ও ঘটনার শুধু বিশেষ অংশ বাছাইয়ের ক্ষমতা মানুষের সাধ্যাতীত বিষয়। ঘটনার বিভিন্ন দিকের মধ্যে সমন্বয় ও সংযোগের দিক থেকেও কোরআনের বৈশিষ্ট্য অনন্য। এসবের সুবাদে বাস্তবতা খুব স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে ফুটে উঠে পাঠক বা শ্রোতার কাছে।
কোরআনের কাহিনীগুলোতে জীবনী ও ঘটনাগুলো প্রাণবন্ত ও বাস্তব হয়ে দেখা দেয়। কোনো কোনো ঘটনা বা বর্ণনার পুনরাবৃত্তি থাকলেও সেখানেও নতুনত্ব লক্ষনীয়। আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে সুরা শোয়ারায় হযরত মুসা (আ.), ফেরাউন, হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত নুহ (আ.), হযরত হুদ (আ.), হযরত সালেহ (আ.), হযরত লুত (আ.) ও হযরত শোয়াইব (আ.) সম্পর্কিত বক্তব্যের কথা উল্লেখ করতে পারি। এই সুরায় নবী-রাসূলদের ঘটনার শুরু ও শেষের আয়াত একই ধরণের বা পুনরাবৃত্তিমূলক হওয়ায় ঐকতানের অপূর্ব সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে। কোরআনে নবী-রাসূলদের কোনো কোনো ঘটনা বা কাহিনীর পুণরাবৃত্তির কারণ হল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। এ প্রসঙ্গে মরহুম ইমাম খোমেনী (র:) বলেছেন, ” কোরআন ইতিহাসের বই নয়, বরং নৈতিকতার বই। নৈতিকতা বা উপদেশের বইয়ে পুণরাবৃত্তি জরুরি। মানুষকে নীতি-নৈতিকতা শেখাতে হলে বার বার বলতে হয় যাতে তা তাদের মধ্যে প্রভাব ফেলে, কেবল একবার বললে প্রভাব পড়ে না। কোরআনের বহু পৃষ্ঠায় আল্লাহকে ভয় করার বা তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও মূসা (আ.)’র ঘটনা বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআন নাজেল হয়েছে মানুষকে প্রকৃত মানুষ করতে, কেবল একবার বলেই তা করা সম্ভব নয়।”
কোরআনের কাহিনী বর্ণনায় ঘটনার অপ্রত্যাশিত আকস্মিক মোড় পরিবর্তন বা নাটকীয়তার সৌন্দর্য্যও লক্ষ্যনীয়। যেমন, কারুন এত সম্পদশালী ছিল যে সে জন্য তার গর্ব ও অহঙ্কারের অন্ত ছিল না। তার জাতির লোকদের অভাব অভিযোগের দিকেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কোনো কোনো মানুষ কারুণের সম্পদের বিশাল পরিমাণের কথা ভেবে অভিভুত হত এবং এমন ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে বলত, ” ইস্, আমার যদি এত সম্পদ থাকত!”। কেবল অল্প একদল লোক খোদায়ী পুরস্কারের আশা করত। হঠাৎ এমন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যে কারুন তার সমস্ত বিত্ত-বৈভব, সম্পদ ও আভিজাত্যসহ মাটির নিচে তলিয়ে যায় এবং কেউই তাকে কোনো সাহায্য করতে পারেনি।
জাতিগুলোর উত্থান-পতনের নানা ঘটনা বর্ণনায় কোরআনের শৈল্পিক উপস্থাপনাও খুবই অপূর্ব ও হৃদয়গ্রাহী। সুরা আলে ইমরানের ১৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে।”
সুরা রূমের নবম আয়াতও অনেকটা একই ধরণের। এ আয়াতে বলা হয়েছে: “তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না অতঃপর দেখে না যে; তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি কি হয়েছে? তারা তাদের চাইতে শক্তিশালী ছিল, তারা যমীন চাষ করত এবং তাদের চাইতে বেশী আবাদ করত। তাদের কাছে তাদের রসূলগণ সুস্পষ্ট নির্দেশ নিয়ে এসেছিল। বস্তুতঃ আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুমকারী ছিলেন না। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল।”
সুরা মুমিনের ২১ নম্বর আয়াতও একই ধরণের: “তারা কি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে না, যাতে দেখত তাদের পূর্বসুরিদের কি পরিণাম হয়েছে? তাদের শক্তি ও কীর্তি পৃথিবীতে এদের অপেক্ষা অধিকতর ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে তাদের গোনাহের কারণে ধৃত করেছিলেন এবং আল্লাহ থেকে তাদেরকে রক্ষাকারী কেউ হয়নি।”
প্রবল প্রতাপান্বিত খোদাদ্রোহী শক্তি ফেরাউন ও তার দলবলের ডুবে যাওয়া প্রসঙ্গে সুরা আদ দোখানের ২৫ নম্বর থেকে ২৯ নম্বর আয়াতের অপরূপ ভাষাশৈলীও এ প্রসঙ্গে চিরস্মরণীয় :
“তারা ছেড়ে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবন, কত শস্যক্ষেত্র ও সূরম্য স্থান।কত সুখের উপকরণ, যাতে তারা খোশগল্প করত। এমনিই হয়েছিল এবং আমি ওগুলোর মালিক করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে।তাদের জন্যে ক্রন্দন করেনি আকাশ ও পৃথিবী এবং তারা অবকাশও পায়নি।”
এভাবে শাশ্বত মোজেজা কোরআন বার বার পাপীদের পরিণতি তুলে ধরে ও সৎকর্মশীল বা ঈমানদারদের চূড়ান্ত সাফল্য বা সৌভাগ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মানুষকে তার প্রকৃতিগত খোদাপ্রেম, সত্য ও মহৎ গুণের দিকে আকৃষ্ট করে।
সুরা হুদের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আর আমার আদেশ যখন উপস্থিত হল, তখন আমি নিজ রহমতে হুদ এবং তাঁর সঙ্গী ঈমানদারদেরপরিত্রাণ দান করি এবং তাদেরকে এক কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করি।”
দৃষ্টান্ত বা উপমা মানুষের কাছে অনেক জটিল বা দূর্বোধ্য বিষয়কেই সহজ করে দেয়। কারণ, জটিল দলিল-প্রমাণ মানুষ খুব সহজে বুঝতে পারে না। মানুষ সাধারণত: ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোকে ভালভাবে বুঝতে পারে বা উপলব্ধি করতে পারে। তাই স্পর্শযোগ্য বিষয়ের সাথে তুলনা বা উপমা মানুষের কাছে জটিল চিন্তাগত বিষয়গুলোকে স্পর্শযোগ্য বিষয়ের মতই বোধগম্য করে তোলে।
সুরা জুমারের ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,”আমি এ কোরআনে মানুষের জন্যে সব দৃষ্টান্ত বা উপমাই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা অনুধাবন করে।” উপমা বা দৃষ্টান্ত তুলে ধরার ক্ষেত্রেও কোরআন অতুলনীয়। দু’টি বিষয়ের পার্থক্য বা তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা এবং বক্তবের উদ্দেশ্য যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য কোরআনের উপমাগুলো নজিরবিহীন।
এ মহাগ্রন্থে উল্লেখিত প্রতিটি উপমা শিল্প-সমৃদ্ধ, প্রজ্ঞাপূর্ণ, সারগর্ভ ও আকর্ষণীয়। আসলে এসব উপমাও কোরআনের অন্যতম মোজেজা। অতুলনীয় সৌন্দর্য, বাগ্মীতা ও বৈচিত্রে ভরপুর এসব উপমা মানুষের অন্তরকে খুব গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং অন্ধকারে পথহারা মানুষকে দেখায় আলোর দিশা।
মহান আল্লাহ তাঁর লক্ষ্য সহজে বোঝানোর জন্য অনেক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। যেমন, কোরআন সত্যকে পানির সাথে আর মিথ্যাকে পানির ওপরে ভেসে ওঠা ফেনার সাথে তুলনা করেছে। আবার কোরআন কখনও সত্যকে এমন মূল্যবান ধাতব পদার্থের সাথে তুলনা করেছে যা চুল্লীতে গলে জলীয় পদার্থের রূপ নিয়েছে এবং মিথ্যাকে তুলনা করেছে ওই জলীয় পদার্থের ওপরে ভেসে ওঠা ফেনার সাথে । এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, শির্ক বা অংশীবাদীতা, কুফর বা অবিশ্বাস ও মিথ্যা টিকে থাকে না, বরং অল্প কিছু সময়ের জন্য সত্যকে ঢেকে রাখে। ফেনা যেমন কিছুক্ষণ পর উবে যায় বা বিলুপ্ত হয় তেমনি অংশীবাদীতা, কুফর বা অবিশ্বাস ও মিথ্যার বিলুপ্তিও অনিবার্য। কিন্তু সত্য কল্যাণকর বা উপকারী বিষয় হিসেবে টিকে থাকে। সুরা রা’দের ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। ফলে উপত্যকাগুলো (নদ-নদীর) গভীরতা বা সংখ্যা অনুযায়ী প্লাবিত হয় বা স্রোতধারা প্রবাহিত হতে থাকে নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী । এরপর স্রোতধারা স্ফীত ফেনারাশি বা আবর্জনা উপরে নিয়ে আসে। এবং অলঙ্কার অথবা তৈজসপত্রের জন্যে যে বস্তুকে আগুনে উত্তপ্ত করে, তাতেও তেমনি ফেনারাশি থাকে, আর ওই ফেনারাশি ফেলে দেয়া হয়। এমনি ভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের দৃষ্টান্ত প্রদান করেন। অতএব, ফেনা তো শুকিয়ে খতম হয়ে যায় এবং যা মানুষের উপকারে আসে, তা জমিতে অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহ এমনিভাবে দৃষ্টান্তগুলো বর্ণনা করেন।”
পবিত্র কোরআন আকাশ, ভূ-মণ্ডল, চাঁদ, সাগর, জীবজন্তু ইত্যাদিকে আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে বর্ণনা করেছে। এমনকি মশার মত একটি ক্ষুদ্র প্রাণীকেও মহান আল্লাহর মহত্ত্বের স্বাক্ষর হিসেবে তুলে ধরেছে এ মহাগ্রন্থ। মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আল্লাহ পাক নিঃসন্দেহে মশা বা (ক্ষুদ্রত্বের দিক হতে) তদুর্ধ্ব তথা আরো ক্ষুদ্র বস্তু দিয়েও উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুতঃ যারা মুমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভূল ও সঠিক। আর যারা কাফের তারা বলে, এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর উদ্দেশ্যই বা কি ছিল।”
কোরআনের এ উপমা প্রসঙ্গে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, “মহান আল্লাহ মশার উদাহরণ দিয়েছেন, কারণ, হাতির যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে সেই সব অঙ্গ ছাড়াও মশার আরো দুটি অঙ্গ বেশি রয়েছে। আল্লাহ এ উপমা দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকূল ও সৃষ্টি জগতের অপূর্ব সূক্ষ্ম নানা দিকের প্রতি জনগণের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন।”
অর্থাৎ কোরআনের দৃষ্টিতে বড় বা ছোট বিষয়ের সাথে তুলনা তুলনার গুরুত্বকে কমায় বা বাড়ায় না, তুলনাটি বা উপমাটি লক্ষ্যের সাথে মানানসই হল কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ যখন আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছু বা অন্য কোনো আশ্রয় স্থলের ওপর নির্ভর করতে চায় তখন সে মরিচীকার মত বিভ্রান্ত হয়। এ ধরণের আশ্রয়ের অকার্যকারিতা ও অস্থায়ীত্ব তুলে ধরে পবিত্র কোরআন। এ মহাগ্রন্থ এ ধরণের আশ্রয়স্থলকে মাকড়সার ঘরের সাথে তুলনা করেছে। সুরা হজ্বের ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে মানুষ! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না, প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন।”
সর্বশেষ ঐশী বা খোদায়ী গ্রন্থ মিথ্যা প্রভু বা মানুষের গড়া মূর্তির ও দেব-দেবীর দূর্বলতা তুলে ধরার জন্য বলেছে, এসব খোদা মাছির মত একটি ক্ষুদ্র জীবও সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না, আরো বড় জীব বা বড় কিছু সৃষ্টি করা তো দূরের কথা। অর্থাৎ পৃথিবীতে এদের কোনো ভূমিকা বা কোনো ক্ষমতাই নেই।
কোরআনের বিচিত্র উপমাগুলো মানুষের অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। পৃথিবী বা পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে এ মহাগ্রন্থের সতর্কবাণীগুলো এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন, মহান আল্লাহ সুরা কাহাফের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা তুলে ধরুন। পার্থিব জীবন পানির মত, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। পানি বর্ষণের ফলে শ্যামল সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা গজিয়ে ওঠে; কিন্তু এরপর তা এমন শুস্ক চুর্ণ-বিচুর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এ সবকিছুর উপর শক্তিমান।”
অন্য একটি দৃষ্টান্তে সুরা হাদিদের ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,”তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার মাধ্যমে উৎপন্ন শস্য-সম্ভার বা সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার মাধ্যমছাড়া আর কিছুই নয়।” পরকালে সৎকর্মের ও অসৎকর্মের নিশ্চিত প্রতিফল থাকা প্রসঙ্গে সুরা বাকারার ২৬৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,”হে ঈমানদারা! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যাক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। এরপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হওয়ায় তা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে যায়। তারা ঐ বস্তুর কোন সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফেরদের পথ দেখান না।”
পবিত্র কোরআনের উপমাগুলো মানুষের পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির জগত থেকে নেয়া হয়েছে। তাই তা সব যুগের মানুষই বুঝতে পারে এবং কখনও মলিন বা পুরনো হয় না। যেমন, দানের বরকত সম্পর্কে মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ২৬১ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজ ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ যাকে পছন্দ করেন তাকে বহু গুণ দান করেন। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।”
পবিত্র কোরআন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অফুরন্ত উৎস। চিরনবীন বা চিরনতুন এ মহাগ্রন্থ সুরক্ষিত। শত্রুরা কখনও এর মধ্যে কোনো বিকৃতি সাধন করতে পারবে না। কারণ, মহান আল্লাহ নিজেই এ মহাগ্রন্থ রক্ষা করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। এ মহাগ্রন্থের অলৌকিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব এত উচ্চ পর্যায়ের যে আল্লাহ নিজেই এর নামে শপথ নিয়েছেন। যেমন, তিনি সুরা ইয়াসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে বলেছেন, ” ইয়াসিন ও প্রজ্ঞাময় কোরআনের শপথ।”
বিশিষ্ট মুসলিম চিন্তাবিদ আবদুল ফাত্তাহ বলেছেন, ” কোরআনের শপথগুলো এ মহাগ্রন্থের অলৌকিকতা ও সূক্ষ্মতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই কোরআনের মধুর কাজগুলোর মধ্যে এসব শপথ অন্যতম। শপথ নেয়া একটি আন্তর্জাতিক রীতি। কোরআন বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ তুলে ধরার পাশাপাশি শপথের মত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমকেও ব্যবহার করেছে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নিজ সৃষ্টিকূলের মধ্য থেকে প্রাকৃতিক বিভিন্ন বস্তু বা বিষয়ের শপথ নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হল, এসব শপথের উদ্দেশ্য বা দর্শন কি? এ ব্যাপারে যেসব গবেষণা হয়েছে তা থেকে বোঝা যায়, মহান আল্লাহ এসব শপথের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ওইসব বিষয় বা বস্তুর ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও জ্ঞান সৃষ্টি এবং এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনার অভ্যাস গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে আল্লাহ এসব শপথের মাধ্যমে মানুষকে বিভিন্ন বিজ্ঞান যেমন, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূ-তত্ত্ব, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদ বিদ্যা এবং এমনকি মানবিক বিজ্ঞান যেমন, সমাজ বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানোর উৎসাহ দিয়েছেন।
প্রত্যেক জাতি বা গোত্র তাদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত বিষয়গুলোর শপথ নিয়ে থাকে। যেমন, অনেকেই বলে থাকেন ” আমার জীবনের শপথ, যা বলছি সত্য বলছি। ” এর মাধ্যমে তারা নিজ জীবন ও বক্তব্যের মধ্য এক ধরণের সম্পর্ক সৃষ্টি করেন, যে সম্পর্কের অর্থ হল- জীবন যেমন তাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত তেমনি তাদের কথারও মূল্য রয়েছে। অনুরূপভাবে কেউ যদি আল্লাহর নামে শপথ করে কিছু করার কথা বলে তার অর্থ হল সে অবশ্যই সর্বোচ্চ সম্মানিত সত্তা তথা স্রস্টার মর্যাদার খাতিরে তা বাস্তবায়ন করবে।
বিশিষ্ট সুন্নি মুফাসসির তানতাভি বলেছেন, “মহান আল্লাহ কোরআনে ৪০ ধরণের শপথ নিয়েছেন। এর মধ্যে বিশটি শপথ আকাশমণ্ডল ও আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে আর বিশটি শপথ বস্তু-জগতকে নিয়ে। এসব শপথের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা-ভাবনার উৎসাহ দিয়েছেন। তাই কোরআনের শপথগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাবি। ”
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র জীবনের শপথও নিয়েছেন। সবচেয়ে প্রিয় ও নির্বাচিত বান্দার জীবনের শপথ নিয়ে মহান আল্লাহ এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র জীবন যেমন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আমার এ বক্তব্য ও প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
মহান আল্লাহ সূরা তিন-এ ডুমুর ও জয়তুনের শপথ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি এসব ফলের ব্যাপক গুরুত্ব ও উপকারিতা তুলে ধরেছন। ” মাজমায়ুল বায়ান” শীর্ষক গ্রন্থে বিখ্যাত মুফাসসির তাবরেসি বলেছেন, ” আল্লাহ এসব সৃষ্টির শপথ নিয়েছেন, কারণ, এসবের মধ্যে মানুষের জন্য ব্যাপক কল্যাণ রয়েছে এবং এসব সৃষ্টি মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতার নিদর্শন বা প্রকাশ-স্থল।”
বিখ্যাত মুফাসসির সুইয়ুতি কোরআনের শপথগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: প্রথমত: নিজের য’ত বা সত্তার শপথ, দ্বিতীয়ত: নিজের কর্ম এবং তৃতীয়ত: নিজের সৃষ্ট বিষয়ের শপথ। যেমন, মহান আল্লাহ সূরা হিজরের ৯২ নম্বর আয়াতে বলেছেন,”অতএব আপনার পালনকর্তার কসম, আমি অবশ্যই ওদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব।”-এটা প্রথমোক্ত শ্রেণীর শপথ। সূরা শামসের ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,”শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন,তাঁর।”-এটা দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণীর শপথ।সূরা নযমের প্রথম আয়াতে রাব্বুল আ’লামিন বলেছেন, ” শপথ নক্ষত্রের যখন তা অস্তমিত হয়।”-এটা তৃতীয়োক্ত শ্রেণীর শপথ।
কখনও কখনও পবিত্র কোরআনে আল্লাহর শপথগুলো উচ্চারিত হয়েছে চিন্তাগত ভুল-ভ্রান্তি ও কূসংস্কারাচ্ছন্নতা মোকাবেলার জন্য। যেমন, কোরআনে বলা হয়েছে, কেউ কেউ আল্লাহকে সন্তানের অধিকারী বলে অপবাদ দিত। তারা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে অভিহিত করত। এ ধরণের বক্তব্য সত্যের বিচ্যুতি। আল্লাহর প্রতি এ ধরণের অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য আল্লাহ নিজ সত্তার কসম দিয়ে তাদেরকে শাস্তি দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন।
আল্লাহর সন্তান থাকার মত জঘন্য অপবাদ দেয়ার অপরাধে বিচার বা পুণরুত্থান দিবসে এ ব্যাপারে তাদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হবে বলে শপথ করেছেন মহান আল্লাহ।
পবিত্র কোরআনে মানুষের নামেও শপথ নিয়েছেন মহান আল্লাহ। মানুষ মহান আল্লাহর সৃষ্ট জীবকূলের মধ্যে সেরা জীব এবং তাঁর প্রিয় সৃষ্টি। এ জন্য তিনি সুরা শামসের ৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন: ” শপথ (মানুষের) প্রাণের এবং যিনি তা (সৃষ্টি ও ) সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর।”
অস্তিত্ব জগতের বিভিন্ন বিষয়ের শপথ বিশ্ব জগতের বিশাল ব্যাপ্তি ও মহাস্রস্টা হিসেবে আল্লাহর মহত্ত্বকে স্পষ্ট করে তুলে।
অনেক সময় কোনো বিষয়ে মানুষের কিছু সন্দেহ নিরসনের জন্য কোরআনে ওই বিষয়ের শপথ নিয়েছেন আল্লাহ। যেমন, যারা কিয়ামত বা পুণরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করত বা এখনও করে তাদের এ বিষয়ে সন্দেহ দূর করার জন্য আল্লাহ কিয়ামতের শপথ নিয়েছেন। অর্থাৎ এই দিন তথা বিচার-দিবস যে অবশ্যই আসবে তাতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
মিশরীয় আলেম আল কাত্তানের মতে যারা নিজ প্রকৃতিকে পংকিল ও অসুন্দর করেনি তারা সহজেই বা সামান্য ইশারাতেই সত্যকে মেনে নেয়। কিন্তু যাদের অন্তর অজ্ঞতা ও অসচেতনতার আঁধারে কলুষিত তাদের হৃদয়কে সহজেই নাড়া দেয়া যায় না। তাঁর দৃষ্টিতে এদের জন্যই জোরালো ও কঠোর সতর্ক-বাণী দরকার হয়। শপথ কোনো বিষয়কে জোরালোভাবে বা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরার অন্যতম পদ্ধতি ও বিষয়টির সত্যতার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই অনেক সময় এ ধরণের শপথের কারণে অস্বীকারকারী ব্যক্তি বাস্তবতাকে মেনে নেয়।
কোরআনে রাত ও দিনের এবং দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ের শপথ দেখা যায়। যেমন, দিন, রাত, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, বিকাল বা অপরাহ্ন। সুরা আসরে আল্লাহ যুগের শপথ নিয়েছেন। অনেকে নিজের কষ্ট বা বিপদের জন্য যুগ বা সময়কে অশুভ কিংবা দোষী বলে মনে করে। কিন্তু কোরআনে যুগ বা সময়ের শপথ এ সংক্রান্ত ধারণাকে কুসংস্কার হিসেবে বাতিল করে দেয়। বরং সময় বা যুগ মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন। কোরআনে যুগ বা সময়ের শপথ পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের কথা ও সময়ের সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তাকে পরকালের জন্য প্রস্তুত হতে বলে।
বরফ বিক্রেতাকে যেমন সময় থাকতেই তথা বরফ গলার আগেই তা বিক্রি করতে হয়, তেমনি মানুষের জীবনকেও সময় থাকতে সংশোধন করা উচিত। নইলে দেখা যাবে জীবনের বরফ গলে গেছে, লাভ তো দূরের কথা মূল পূঁজিটুকুই বিনা মূল্যে হারাতে হয়েছে।
হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন: আল্লাহ নিজ সৃষ্টিকূলের অনেক কিছুর শপথ নিয়েছেন যাতে মানুষ যেসব বিষয়ে শিক্ষা নেয়া দরকার সেসব বিষয়ে শিক্ষা নেয় ও সচেতন হয়। যে বস্তুর নামে শপথ করা হয় তা ওই বস্তুর গুরুত্ব তুলে ধরে। ”
অজানাকে জানা তথা জ্ঞান অর্জন মানব সভ্যতার চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। প্রকৃতিকে জয় করাসহ বস্তুগত ও ইহকালীন অশেষ কল্যাণের মাধ্যম হল জ্ঞান। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও পারলৌকিক সৌভাগ্যেরও নিয়ন্তাও হল জ্ঞান। অন্যকথায় জ্ঞান কেবল অর্থই যোগায় না, যোগায় মানসিক বা আধ্যাত্মিক সুখ ও চিন্তার খোরাক। কোরআনের দৃষ্টিতে চিন্তার দারিদ্র বস্তুগত দারিদ্রের চেয়েও বেশি ধ্বংসাত্মক। অন্যদিকে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সাধনা জ্ঞান ছাড়াও কখনও অর্জিত হতে পারে না। জ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরে কোরআন প্রশ্ন করে:” যারা জানে আর জানে না তারা কি সমান?” উল্লেখ্য নবী-রাসূল ও নির্বাচিত মহাপুরুষদের মহত্ত্ব তুলে ধরতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন যে, ” আমরা তাকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছি।” এ জাতীয় অনেক আয়াত রয়েছে কোরআনে। মহান আল্লাহ কোরআনের অনেক আয়াতে সৃষ্টি জগতের নানা বিস্ময় সম্পর্কে মানুষকে চিন্তা-ভাবনার আহ্বান জানিয়েছেন। যেমন, তিনি বলেছেন, ” তবে তোমরা কি দেখছ না বা দেখতে পাও না?”, কিংবা “অত:পর তাকিয়ে দেখ।” এসব বাক্য জ্ঞান ও সচেতনতা অর্জনেরই আহ্বান।
জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে কোরআন শিক্ষক ও ছাত্রের জন্য এবং স্থান ও সময়ের দিক থেকে কোনো সীমাবদ্ধতার কথা বলেনি। মানব জাতির কোনো আদর্শ বা মতাদর্শেই জ্ঞানের প্রতি এত সীমাহীন ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেখা যায় না। কোরআনের দৃষ্টিতে আলো ও আঁধারের মধ্যে আলোই শ্রেয় এবং এ মহাগ্রন্থ জ্ঞানকে আলো, আর অজ্ঞতাকে আঁধারের সাথে তুলনা করেছে।
কোরআন যেসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করতে বলে, সেসবের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতি-বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিদ্যা, ইতিহাস ইত্যাদি। এসব বিজ্ঞান বর্তমান বিশ্বে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সূরা বাকারার ১৬৪ নম্বর আয়াতে এসেছে: “আকাশ ও ভূমণ্ডল সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে, আর যা মানুষের উপকারী জিনিসপত্র নিয়ে পানির ওপরে ভেসে বেড়ায় সেসব তরীসমূহে, আর আসমান থেকে আল্লাহ যে বারিধারা বর্ষণ করেন-তাই দিয়ে মরা মাটিকে বাঁচিয়ে তোলেন এবং তার মধ্যে যাবতীয় জীব-জন্তুর বিস্তারণে, বাতাসের গতি পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থ সঞ্চিত মেঘের সঞ্চারণে চিন্তাশীল ও জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য (আল্লাহর পবিত্র সত্তার ও তাঁর একত্বের) নিদর্শন রয়েছে। “
অন্যদিকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরাও জ্ঞানের ওপর অশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, “প্রকৃত জ্ঞান মুমিনের জন্য হারানো সম্পদ, যেখানেই তা পাও না কেন তা তার কাম্য হওয়া উচিত।”তিনি আরো বলেছেন, ” জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীনে যাও।”
বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, ” আমি যুব সমাজকে কেবল এ দুই অবস্থার মধ্যে দেখতে পছন্দ করি যে তারা হয় বিশেষজ্ঞ বা জ্ঞানী হবে অথবা জ্ঞান বিতরণকারী হবে।”
কোরআন নাজেল হওয়ার যুগে মানুষের জ্ঞানগত অবস্থান ছিল খুবই নিচে। জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যার মত বিদ্যায় মানুষের জ্ঞান ছিল খুবই সামান্য। অথচ সে যুগেই কোরআন জ্ঞানের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করেছে। সে সময় আরবরা ছিল অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন। প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও যথেষ্ট তথ্য না থাকায় সে যুগের আরবরা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শোনা রূপকথার ভিত্তিতে মনে করত যে, পাহাড়গুলোই আকাশকে উপরে ধরে রেখেছে, পৃথিবী সমতল এবং এর দুই প্রান্তে থাকা পাহাড়গুলো আকাশের নীচের স্তম্ভ। কোরআন তাদের এ জাতীয় ধারণার অসারতা তুলে ধরেছে।
সূরা রা’দের দুই নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:” আল্লাহই তিনি যিনি উর্ধ্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে কোনো ধরণের স্তম্ভ ছাড়াই।” বিশ্ব জগত সম্পর্কে কোরআনে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বাস্তবতা রয়েছে যে অনেক বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ সেগুলোকে কোরআনের অলৌকিকতার নিদর্শন বলে স্বীকার করেছেন। এভাবে কোরআন মানব জাতিকে অজ্ঞতার আঁধার থেকে মুক্ত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের ব্যবস্থা করেছে। তাই ইসলামের আবির্ভাবের পর অল্প সময়ের মধ্যেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে হিজরী তৃতীয় শতক থেকে হিজরী পঞ্চম শতকের শেষের দিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের অসাধারণ অগ্রগতি ঘটেছিল। কোরআনের উৎস ও ইসলামের বিস্তৃতির কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল বলে বেশির ভাগ গবেষক মনে করেন। ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল লিখেছেন: যদি মধ্য যুগে মুসলমানদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা না থাকত তাহলে বিজ্ঞানের পতন হত অনিবার্য। ফরাসি চিন্তাবিদ পিয়েরে রুশো ” বিজ্ঞানের ইতিহাস” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন,”ইসলামের নবী (সা.)’র ইন্তেকালের পর তিন শতক না যেতেই কর্ডোভায় দশ লাখ নাগরিকের জন্য গড়ে উঠেছিল ৮০টি কলেজ বা মহাবিদ্যালয় এবং আরবি ভাষাসহ বিজ্ঞান-চর্চার বিভিন্ন ভাষায় লিখিত ৬ লাখ বই সম্বলিত বিশাল লাইব্রেরি। ” পাশ্চাত্যে আল্লাহর সূর্য ” শীর্ষক বইয়ে জার্মান লেখিকা মিসেস জিইগ্রিদ হুনকা লিখেছেন: ” মিশরের কোনো এক খলিফার লাইব্রেরিতে ১৬ লাখ বই ছিল। এসব বইয়ের মধ্যে ছয় হাজার বই ছিল কেবল গণিত বিষয়ের এবং ১৮ হাজার বই ছিল দর্শন সম্পর্কিত।”বেলজীয়ামে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন ঐতিহাসিক জর্জ সার্টন বলেছেন, “সম্ভবত: মধ্যযুগে বিজ্ঞানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথচ সবচেয়ে কম-অনুভূত সেবাটি ছিল পরীক্ষামূলক বা অধুনিক বিজ্ঞানের চিন্তা। আর এ বিষয়টি আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ভিত্তি গড়ে তুলেছে। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতকের শেষের দিক পর্যন্ত এ চিন্তার বিকাশ ঘটেছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান এ জন্য মুসলমানদের প্রচেষ্টা ও পবিত্র কোরআনের শিক্ষার কাছ ঋণী। ”
কোরআন কেবল মানুষের জন্য উপকারী জ্ঞানকেই গুরুত্ব দেয়। উপকারী জ্ঞান মানুষকে শান্তি, সৌভাগ্য ও ন্যায়বিচারের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু যে জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষকে ক্ষমতালোভী ও আত্মকেন্দ্রীক করে এবং ডেকে আনে সমাজের ধ্বংস, তা কোরআনের কাম্য নয়।
ভুল বিশ্বাস ও পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া অযৌক্তিক ধারণার অন্ধ অনুকরণের নিন্দা জানায় কোরআন। যেমন, সূরা বাকারার ১৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “তারা ছিল এক সম্প্রদায়-যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্যে। তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না।” অজানাকে জানার জন্য জ্ঞানীদের কাছে প্রশ্ন করার গুরুত্ব তুলে ধরে কোরআনের সূরা নাহলের ৪৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর,যদি তোমাদের জানা না থাকে।” কোরআন মানুষকে অজ্ঞতাপূর্ণ কাজ ও চিন্তার ব্যাপারে সতর্ক করার পাশাপাশি তাদেরকে গভীর চিন্তা ও অনুসন্ধানের আহ্বান জানায়। আল্লামা মোহাম্মাদ তাকি জা’ফরির মতে কোরআনের প্রায় ৭৩০টি আয়াতে জ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার সুফল তুলে ধরা হয়েছে। পবিত্র ও সৌভাগ্যময় জীবনের দিক নির্দেশনা দেয়াই এসব আয়াতের লক্ষ্য।
মানুষ প্রজ্ঞা ও বিবেক-সম্পন্ন সত্তা। বিবেক ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে মানুষ সত্য ও মিথ্যা বা ভাল ও মন্দের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে। জ্ঞান ও জ্ঞান অর্জনের ভিত্তি হল আকল। প্রকৃতির বিস্ময়কর নানা দিক, জীবন ও জগতের অনেক বাস্তবতা-এসব যদি মানুষের কাছে স্পষ্ট না হত তাহলে মানুষ অন্যান্য সৃষ্টি ও প্রকৃতির ওপর এত কর্তৃত্ব করতে পারত না। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রজ্ঞার প্রয়োগ ছাড়া মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির এত অগ্রগতিও সম্ভব হত না ।
সূরা আম্বিয়া’র দশ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
“আমি তোমাদের প্রতি একটি কিতাব অবর্তীর্ণ করেছি; এতে তোমাদের জন্যে সতর্কবাণী বা উপদেশ (ও সচেতনতা) রয়েছে। তোমরা কি চিন্তা কর না ? বা বোঝ না?”
মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলার জন্য সূরা জুখরুফের তিন নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আমি আরবী ভাষায় একে করেছি কোরআন,যাতে তোমরা বুঝ বা চিন্তা কর।”
সূরা নাহলের ১২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আপন পালন কর্তার পথের দিকে আহবান করুন হেকমতের মাধ্যমে বা জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দনীয় পন্থায়।”
বিবেক ও প্রজ্ঞার শাসন মেনে চলা একটি অপরিহার্য ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সূরা কাসাসের ৬০ নম্বর আয়াতে কোরআন বলছে,
“তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, তা পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা ছাড়া অন্য কিছু নয়।আর আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উত্তম ও স্থায়ী। তোমরা কি আকল খাটাও না, বা বোঝনা?”
এ আয়াতে মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কোনো মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা ও বিবেককে কতটা ভালভাবে ও কত ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করতে পেরেছে তার ওপরই নির্ভর করছে তার মূল্য বা মর্যাদাগত অবস্থান। যেসব মানুষ বুদ্ধি খাটায় না বা বিবেককে ব্যবহার করে না আল্লাহ তাদেরকে বোবা ও বধির বলে অভিহিত করেছেন। যেমন, সূরা আনফালের ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
“নি:সন্দেহে আল্লাহ্তা’আলার দৃষ্টিতে সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই মূক ও বধির, যারা উপলদ্ধি করেনা।”
সৃষ্টি জগতের বিস্ময়কর নানা নিদর্শন, বিশ্ব জগতের সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতির পরতে পরতে থাকা শিক্ষনীয় নানা দিক জ্ঞানী ও বিচক্ষণ লোকদের কাছে মহান আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। মহান আল্লাহর অশেষ মহত্ত্বের কাছে শ্রদ্ধায় নতজানু হন তারা। জ্ঞান শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তা এবং প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানোর জন্য কোরআনের অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ এ মহাগ্রন্থের অলৌকিকতার অন্যতম দিক। সূরা ফাতিরের ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ক্ষমাময়।”
আল্লাহ চান মানুষ যেন বুঝে-শুনে তথা বিবেক-বুদ্ধিকে ব্যবহার করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও তাঁর অনুগত থাকে। আর এ জন্য আল্লাহর নানা নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা জরুরি। এ লক্ষ্যেই মহান আল্লাহ প্রকৃতির নানা বিষয়, পারলৌকিক জীবন ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে কথা বলেছেন পবিত্র কোরআনে। আসলে মানুষকে এসব বিষয়ে চিন্তাশীল করা কোরআনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
যারা চিন্তা-ভাবনা করে না এবং বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে না, কোরআন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানায়। যেমন, মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষ ও পশুর মধ্যে ব্যবধানের মানদণ্ডই হল চিন্তাশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা। অন্য কথায় প্রকৃত মানুষ বিবেক ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগায়, আর যারা তা করে না তারা দেখতে মানুষের মত হলেও আসলে পশুর সমতুল্য ও এমনকি তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট। যে বুদ্ধিমত্তা ও বিবেকের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব ও মহান আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা সেই মানুষই এসব ঐশী বা খোদায়ী নেয়ামত ব্যবহার না করায় আল্লাহর সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টিতে পরিণত হয়। সূরা মুলকের দশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ( বেহেশতবাসীদের সাথে কথপোকথনের সময়) দোযখবাসীরা বলবে: “তারা আরও বলবেঃ হায়! যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।”চিরস্থায়ী সৌভাগ্য, সুপথ ও মুক্তির জন্য যে বিবেকের চোখ-কান খোলা রাখা জরুরি তা এ আয়াত থেকে স্পষ্ট।
যেসব বিষয় বা চালিকা শক্তি মানুষকে চিন্তাশীলতা ও প্রজ্ঞা থেকে দূরে সরিয়ে তাদেরকে ভুল-ত্রুটি ও অধ:পতনের অতলে তলিয়ে নিয়ে যায় সেসব বিষয়ে সতর্ক করে কোরআন। অলীক ধারণা ও খেয়ালিপনা মানুষের বিভ্রান্তির অন্যতম মাধ্যম।
কোরআনের দৃষ্টিতে যারা বুঝে শুনে আল্লাহকে মানে আর যারা না বুঝেই আল্লাহকে মানে তাদের মধ্যে প্রথমোক্ত শ্রেণীই শ্রেষ্ঠ। দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণী যে কোনো সময় শয়তানের ধোকার শিকার হতে পারে। কোরআন অমূলক বা প্রমাণহীন সন্দেহ ও অশুভ ধারণা পোষণ করতে নিষেধ করে। তাই কোনো বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ওই বিষয়ের ভালো বা খারাপ হওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। তেমনিভাবে নিশ্চিত না হয়ে কারো ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করাও ঠিক নয়।
কোরআন আলো, আরোগ্য এবং দয়া ও করুণার আধার। মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয় এ মহাগ্রন্থ। আর এ জন্যই বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার দিকে আহ্বান সম্বলিত কোরআনের আয়াতের সংখ্যাও ব্যাপক। যেমন, পবিত্র কোরআনের ১৫ টি আয়াতে মানুষকে প্রজ্ঞা ও বিবেক-সম্পন্ন লোকদের কাতারে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এটা স্পষ্ট, কোরআন বা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মতাদর্শ বা বিশ্ব-দর্শনে বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেখা যায় না। আধুনিক যুগের দার্শনিক মরহুম আল্লামা জা’ফরী লিখেছেন:
“চিন্তা-ভাবনা করার, বুদ্ধি খাটানোর ও বিচক্ষণ বা দূরদর্শি হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছেকোরআনের যেসব আয়াতে সেসব আয়াতের মোট সংখ্যা ২১৩। আয়াতগুলোকে আবার কয়েকটি উপ-শিরোনামের আওতায় এভাবে বিন্যস্ত করা যায়: ১-আকল বা বিবেককে জোরদার করা ও বিবেকের অনুসরণ সম্পর্কিত আয়াতের সংখ্যা: ৪০।
২- যথাযথ ও গভীর উপলব্ধি সম্পর্কিত আয়াত ১৫ টি।
৩- চিন্তা সংক্রান্ত আয়াত রয়েছে ১৭টি।
৪- বোধ-শক্তি ও সচেতনতা অর্জন সংক্রান্ত আয়াত ২১টি।
৫-জ্ঞানের অনুসরণ ও অজ্ঞতা পরিহার সংক্রান্ত আয়াত ১০০টি।
৬-অস্তিত্ব-জগতের বা বিশ্ব-জগতের নানা বিস্ময় সম্পর্কে চুল-চেরা বিশ্লেষণ সংক্রান্ত আয়াত রয়েছে বিশটি।”
পবিত্র কোরআনের সুরা হিজরের ৩৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ মিথ্যা সৌন্দর্য্য ও বাহ্যিক চাকচিক্য সম্পর্কে শয়তান বা ইবলিসের ঘটনা তুলে ধরেছেন:
“সে অর্থাৎ ইবলিস বললঃ হে আমার পলনকর্তা,আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে (বস্তুগত) নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ঠ করে দেব।”
শয়তান অশ্লীলতা, পাপ, মন্দ কাজ ও অনাচার ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এসব কাজকে মানুষের কাছে সুন্দর চেহারায় তুলে ধরে যাতে তাদের সর্বনাশ ঘটে। অন্যদিকে কোরআন মানুষকে উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় ও চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়। আর এ লক্ষ্যেই সুন্দর ও আকর্ষণীয় কিছু সত্য ঘটনা বা কাহিনী তুলে ধরেছে বিশ্বনবী (সা.)’র কাছে নাজেল হওয়া মহাগ্রন্থ আল কোরআন। যেমন, ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে এ মহাগ্রন্থ হযরত আইয়ুব (আ.)’র কাহিনী বর্ণনা করেছে। তাঁর ঘটনা আমাদের এটা শেখায় যে, সংকট আর বিপদ-মুসিবৎ যত বেশি ও প্রবল হোক না কেন সেসবের মোকাবেলায় পাহাড়ের মত অবিচল ও ধৈর্যশীল হওয়া একটি অতি উন্নত নৈতিক গুণ। ধৈর্য্য মানুষের আচার-ব্যবহারকে সুন্দর করে এবং ধৈর্যশীল মানুষ অন্যদের প্রশংসা ও সম্মানের পাত্র হন। কোরআন একই ধরণের গুণ তথা ক্ষমাশীলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে হযরত ইউসুফ (আ.)’র পক্ষ থেকে তাঁরহিংসুক ভাইদের ক্ষমা করে দেয়ার ঘটনা উল্লেখ করেছে। কোরআনে বর্ণিত বিবি মরিয়ম (সা.) বা হযরত ঈসা (আ.)’র মায়ের ঘটনায় পবিত্রতা, সতীত্ব ও আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতার অনন্য মহিমা প্রকাশিত হয়েছে।
হযরত ইউনুস (আ.)’র ঘটনায় মাছের পেটে আটকা পড়া সত্ত্বেও আশাবাদী মন নিয়ে একান্ত প্রার্থনার এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে। এ ঘটনা থেকে আমরা এটা শিখতে পারি যে, চরম কষ্ট ও সংকটের সময়ও আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া উচিত নয়। এভাবে কোরআন একত্ববাদী জীবনের নানা সৌন্দর্য্য তুলে ধরে। কোরআনে বর্ণিত ফেরাউন সম্পর্কিত ঘটনায় আমরা ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আসিয়া (সা.)’র অন্যন্য চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সাহসের সৌন্দর্য্য প্রত্যক্ষ করি। ফেরাউনের মত প্রবল প্রতাপান্বিত অত্যাচারী রাজার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বিবি আসিয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ঈমানের বিপদসংকুল পথ বেছে নেন এবং রাজকীয় বিলাস, পদ-মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধাকে দু-পায়ে দূরে ঠেলে আল্লাহর পথে চরম বিপদকেও হাসিমুখে বরণ করে নেন।
এক আল্লাহর প্রতি নিবেদিত প্রাণ ও আন্তরিক ঈমানের ঘোষণার আরেকটি সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র এ ঘোষণায়: “আমি আন্তরিক বিশ্বাস নিয়ে বা একনিষ্ঠ চিত্তে মুখ ফিরিয়েছি ঐ সত্তার দিকে,যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেক বা অংশিবাদী নই।” (সুরা আনআম-৭৯)সুরা আনআমের ৭৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত এ ঘোষণা একজন মুমিন মুসলমানের জন্য অনুকরণীয় প্রধান আদর্শ ও মৌলিক নীতি-বাক্য।
কোরআনের কাহিনীগুলোর কিছু কিছু সৌন্দর্য্য বর্ণনার কৌশল ও পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত এবং কিছু কিছু নান্দনিকতা কাহিনীর উপাদান ও বিশেষ অংশের সাথে সম্পর্কিত। কোরআনে বর্ণিত ঘটনা বা কাহিনীগুলোর অপূর্ব বিন্যাস ও শৃঙ্খলাও এ মহাগ্রন্থের অলৌকিকতার এবং সৌন্দর্য্যের অন্যতম নিদর্শন। সত্য ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও এসব কাহিনীকে বিশেষভাবে সাজিয়ে বলার নৈপুণ্য ও ঘটনার শুধু বিশেষ অংশ বাছাইয়ের ক্ষমতা মানুষের সাধ্যাতীত বিষয়। ঘটনার বিভিন্ন দিকের মধ্যে সমন্বয় ও সংযোগের দিক থেকেও কোরআনের বৈশিষ্ট্য অনন্য। এসবের সুবাদে বাস্তবতা খুব স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে ফুটে উঠে পাঠক বা শ্রোতার কাছে।
কোরআনের কাহিনীগুলোতে জীবনী ও ঘটনাগুলো প্রাণবন্ত ও বাস্তব হয়ে দেখা দেয়। কোনো কোনো ঘটনা বা বর্ণনার পুনরাবৃত্তি থাকলেও সেখানেও নতুনত্ব লক্ষনীয়। আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে সুরা শোয়ারায় হযরত মুসা (আ.), ফেরাউন, হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত নুহ (আ.), হযরত হুদ (আ.), হযরত সালেহ (আ.), হযরত লুত (আ.) ও হযরত শোয়াইব (আ.) সম্পর্কিত বক্তব্যের কথা উল্লেখ করতে পারি। এই সুরায় নবী-রাসূলদের ঘটনার শুরু ও শেষের আয়াত একই ধরণের বা পুনরাবৃত্তিমূলক হওয়ায় ঐকতানের অপূর্ব সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে। কোরআনে নবী-রাসূলদের কোনো কোনো ঘটনা বা কাহিনীর পুণরাবৃত্তির কারণ হল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। এ প্রসঙ্গে মরহুম ইমাম খোমেনী (র:) বলেছেন, ” কোরআন ইতিহাসের বই নয়, বরং নৈতিকতার বই। নৈতিকতা বা উপদেশের বইয়ে পুণরাবৃত্তি জরুরি। মানুষকে নীতি-নৈতিকতা শেখাতে হলে বার বার বলতে হয় যাতে তা তাদের মধ্যে প্রভাব ফেলে, কেবল একবার বললে প্রভাব পড়ে না। কোরআনের বহু পৃষ্ঠায় আল্লাহকে ভয় করার বা তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও মূসা (আ.)’র ঘটনা বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআন নাজেল হয়েছে মানুষকে প্রকৃত মানুষ করতে, কেবল একবার বলেই তা করা সম্ভব নয়।”
কোরআনের কাহিনী বর্ণনায় ঘটনার অপ্রত্যাশিত আকস্মিক মোড় পরিবর্তন বা নাটকীয়তার সৌন্দর্য্যও লক্ষ্যনীয়। যেমন, কারুন এত সম্পদশালী ছিল যে সে জন্য তার গর্ব ও অহঙ্কারের অন্ত ছিল না। তার জাতির লোকদের অভাব অভিযোগের দিকেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কোনো কোনো মানুষ কারুণের সম্পদের বিশাল পরিমাণের কথা ভেবে অভিভুত হত এবং এমন ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে বলত, ” ইস্, আমার যদি এত সম্পদ থাকত!”। কেবল অল্প একদল লোক খোদায়ী পুরস্কারের আশা করত। হঠাৎ এমন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যে কারুন তার সমস্ত বিত্ত-বৈভব, সম্পদ ও আভিজাত্যসহ মাটির নিচে তলিয়ে যায় এবং কেউই তাকে কোনো সাহায্য করতে পারেনি।
জাতিগুলোর উত্থান-পতনের নানা ঘটনা বর্ণনায় কোরআনের শৈল্পিক উপস্থাপনাও খুবই অপূর্ব ও হৃদয়গ্রাহী। সুরা আলে ইমরানের ১৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে।”
সুরা রূমের নবম আয়াতও অনেকটা একই ধরণের। এ আয়াতে বলা হয়েছে: “তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না অতঃপর দেখে না যে; তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি কি হয়েছে? তারা তাদের চাইতে শক্তিশালী ছিল, তারা যমীন চাষ করত এবং তাদের চাইতে বেশী আবাদ করত। তাদের কাছে তাদের রসূলগণ সুস্পষ্ট নির্দেশ নিয়ে এসেছিল। বস্তুতঃ আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুমকারী ছিলেন না। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল।”
সুরা মুমিনের ২১ নম্বর আয়াতও একই ধরণের: “তারা কি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে না, যাতে দেখত তাদের পূর্বসুরিদের কি পরিণাম হয়েছে? তাদের শক্তি ও কীর্তি পৃথিবীতে এদের অপেক্ষা অধিকতর ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে তাদের গোনাহের কারণে ধৃত করেছিলেন এবং আল্লাহ থেকে তাদেরকে রক্ষাকারী কেউ হয়নি।”
প্রবল প্রতাপান্বিত খোদাদ্রোহী শক্তি ফেরাউন ও তার দলবলের ডুবে যাওয়া প্রসঙ্গে সুরা আদ দোখানের ২৫ নম্বর থেকে ২৯ নম্বর আয়াতের অপরূপ ভাষাশৈলীও এ প্রসঙ্গে চিরস্মরণীয় :
“তারা ছেড়ে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবন, কত শস্যক্ষেত্র ও সূরম্য স্থান।কত সুখের উপকরণ, যাতে তারা খোশগল্প করত। এমনিই হয়েছিল এবং আমি ওগুলোর মালিক করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে।তাদের জন্যে ক্রন্দন করেনি আকাশ ও পৃথিবী এবং তারা অবকাশও পায়নি।”
এভাবে শাশ্বত মোজেজা কোরআন বার বার পাপীদের পরিণতি তুলে ধরে ও সৎকর্মশীল বা ঈমানদারদের চূড়ান্ত সাফল্য বা সৌভাগ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মানুষকে তার প্রকৃতিগত খোদাপ্রেম, সত্য ও মহৎ গুণের দিকে আকৃষ্ট করে।
সুরা হুদের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আর আমার আদেশ যখন উপস্থিত হল, তখন আমি নিজ রহমতে হুদ এবং তাঁর সঙ্গী ঈমানদারদেরপরিত্রাণ দান করি এবং তাদেরকে এক কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করি।”
দৃষ্টান্ত বা উপমা মানুষের কাছে অনেক জটিল বা দূর্বোধ্য বিষয়কেই সহজ করে দেয়। কারণ, জটিল দলিল-প্রমাণ মানুষ খুব সহজে বুঝতে পারে না। মানুষ সাধারণত: ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোকে ভালভাবে বুঝতে পারে বা উপলব্ধি করতে পারে। তাই স্পর্শযোগ্য বিষয়ের সাথে তুলনা বা উপমা মানুষের কাছে জটিল চিন্তাগত বিষয়গুলোকে স্পর্শযোগ্য বিষয়ের মতই বোধগম্য করে তোলে।
সুরা জুমারের ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,”আমি এ কোরআনে মানুষের জন্যে সব দৃষ্টান্ত বা উপমাই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা অনুধাবন করে।” উপমা বা দৃষ্টান্ত তুলে ধরার ক্ষেত্রেও কোরআন অতুলনীয়। দু’টি বিষয়ের পার্থক্য বা তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা এবং বক্তবের উদ্দেশ্য যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য কোরআনের উপমাগুলো নজিরবিহীন।
এ মহাগ্রন্থে উল্লেখিত প্রতিটি উপমা শিল্প-সমৃদ্ধ, প্রজ্ঞাপূর্ণ, সারগর্ভ ও আকর্ষণীয়। আসলে এসব উপমাও কোরআনের অন্যতম মোজেজা। অতুলনীয় সৌন্দর্য, বাগ্মীতা ও বৈচিত্রে ভরপুর এসব উপমা মানুষের অন্তরকে খুব গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং অন্ধকারে পথহারা মানুষকে দেখায় আলোর দিশা।
মহান আল্লাহ তাঁর লক্ষ্য সহজে বোঝানোর জন্য অনেক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। যেমন, কোরআন সত্যকে পানির সাথে আর মিথ্যাকে পানির ওপরে ভেসে ওঠা ফেনার সাথে তুলনা করেছে। আবার কোরআন কখনও সত্যকে এমন মূল্যবান ধাতব পদার্থের সাথে তুলনা করেছে যা চুল্লীতে গলে জলীয় পদার্থের রূপ নিয়েছে এবং মিথ্যাকে তুলনা করেছে ওই জলীয় পদার্থের ওপরে ভেসে ওঠা ফেনার সাথে । এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, শির্ক বা অংশীবাদীতা, কুফর বা অবিশ্বাস ও মিথ্যা টিকে থাকে না, বরং অল্প কিছু সময়ের জন্য সত্যকে ঢেকে রাখে। ফেনা যেমন কিছুক্ষণ পর উবে যায় বা বিলুপ্ত হয় তেমনি অংশীবাদীতা, কুফর বা অবিশ্বাস ও মিথ্যার বিলুপ্তিও অনিবার্য। কিন্তু সত্য কল্যাণকর বা উপকারী বিষয় হিসেবে টিকে থাকে। সুরা রা’দের ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। ফলে উপত্যকাগুলো (নদ-নদীর) গভীরতা বা সংখ্যা অনুযায়ী প্লাবিত হয় বা স্রোতধারা প্রবাহিত হতে থাকে নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী । এরপর স্রোতধারা স্ফীত ফেনারাশি বা আবর্জনা উপরে নিয়ে আসে। এবং অলঙ্কার অথবা তৈজসপত্রের জন্যে যে বস্তুকে আগুনে উত্তপ্ত করে, তাতেও তেমনি ফেনারাশি থাকে, আর ওই ফেনারাশি ফেলে দেয়া হয়। এমনি ভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের দৃষ্টান্ত প্রদান করেন। অতএব, ফেনা তো শুকিয়ে খতম হয়ে যায় এবং যা মানুষের উপকারে আসে, তা জমিতে অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহ এমনিভাবে দৃষ্টান্তগুলো বর্ণনা করেন।”
পবিত্র কোরআন আকাশ, ভূ-মণ্ডল, চাঁদ, সাগর, জীবজন্তু ইত্যাদিকে আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে বর্ণনা করেছে। এমনকি মশার মত একটি ক্ষুদ্র প্রাণীকেও মহান আল্লাহর মহত্ত্বের স্বাক্ষর হিসেবে তুলে ধরেছে এ মহাগ্রন্থ। মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আল্লাহ পাক নিঃসন্দেহে মশা বা (ক্ষুদ্রত্বের দিক হতে) তদুর্ধ্ব তথা আরো ক্ষুদ্র বস্তু দিয়েও উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুতঃ যারা মুমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভূল ও সঠিক। আর যারা কাফের তারা বলে, এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর উদ্দেশ্যই বা কি ছিল।”
কোরআনের এ উপমা প্রসঙ্গে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, “মহান আল্লাহ মশার উদাহরণ দিয়েছেন, কারণ, হাতির যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে সেই সব অঙ্গ ছাড়াও মশার আরো দুটি অঙ্গ বেশি রয়েছে। আল্লাহ এ উপমা দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকূল ও সৃষ্টি জগতের অপূর্ব সূক্ষ্ম নানা দিকের প্রতি জনগণের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন।”
অর্থাৎ কোরআনের দৃষ্টিতে বড় বা ছোট বিষয়ের সাথে তুলনা তুলনার গুরুত্বকে কমায় বা বাড়ায় না, তুলনাটি বা উপমাটি লক্ষ্যের সাথে মানানসই হল কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ যখন আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছু বা অন্য কোনো আশ্রয় স্থলের ওপর নির্ভর করতে চায় তখন সে মরিচীকার মত বিভ্রান্ত হয়। এ ধরণের আশ্রয়ের অকার্যকারিতা ও অস্থায়ীত্ব তুলে ধরে পবিত্র কোরআন। এ মহাগ্রন্থ এ ধরণের আশ্রয়স্থলকে মাকড়সার ঘরের সাথে তুলনা করেছে। সুরা হজ্বের ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে মানুষ! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না, প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন।”
সর্বশেষ ঐশী বা খোদায়ী গ্রন্থ মিথ্যা প্রভু বা মানুষের গড়া মূর্তির ও দেব-দেবীর দূর্বলতা তুলে ধরার জন্য বলেছে, এসব খোদা মাছির মত একটি ক্ষুদ্র জীবও সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না, আরো বড় জীব বা বড় কিছু সৃষ্টি করা তো দূরের কথা। অর্থাৎ পৃথিবীতে এদের কোনো ভূমিকা বা কোনো ক্ষমতাই নেই।
কোরআনের বিচিত্র উপমাগুলো মানুষের অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। পৃথিবী বা পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে এ মহাগ্রন্থের সতর্কবাণীগুলো এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন, মহান আল্লাহ সুরা কাহাফের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা তুলে ধরুন। পার্থিব জীবন পানির মত, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। পানি বর্ষণের ফলে শ্যামল সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা গজিয়ে ওঠে; কিন্তু এরপর তা এমন শুস্ক চুর্ণ-বিচুর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এ সবকিছুর উপর শক্তিমান।”
অন্য একটি দৃষ্টান্তে সুরা হাদিদের ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,”তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার মাধ্যমে উৎপন্ন শস্য-সম্ভার বা সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার মাধ্যমছাড়া আর কিছুই নয়।” পরকালে সৎকর্মের ও অসৎকর্মের নিশ্চিত প্রতিফল থাকা প্রসঙ্গে সুরা বাকারার ২৬৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,”হে ঈমানদারা! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যাক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। এরপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হওয়ায় তা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে যায়। তারা ঐ বস্তুর কোন সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফেরদের পথ দেখান না।”
পবিত্র কোরআনের উপমাগুলো মানুষের পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির জগত থেকে নেয়া হয়েছে। তাই তা সব যুগের মানুষই বুঝতে পারে এবং কখনও মলিন বা পুরনো হয় না। যেমন, দানের বরকত সম্পর্কে মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ২৬১ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজ ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ যাকে পছন্দ করেন তাকে বহু গুণ দান করেন। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।”
পবিত্র কোরআন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অফুরন্ত উৎস। চিরনবীন বা চিরনতুন এ মহাগ্রন্থ সুরক্ষিত। শত্রুরা কখনও এর মধ্যে কোনো বিকৃতি সাধন করতে পারবে না। কারণ, মহান আল্লাহ নিজেই এ মহাগ্রন্থ রক্ষা করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। এ মহাগ্রন্থের অলৌকিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব এত উচ্চ পর্যায়ের যে আল্লাহ নিজেই এর নামে শপথ নিয়েছেন। যেমন, তিনি সুরা ইয়াসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে বলেছেন, ” ইয়াসিন ও প্রজ্ঞাময় কোরআনের শপথ।”
বিশিষ্ট মুসলিম চিন্তাবিদ আবদুল ফাত্তাহ বলেছেন, ” কোরআনের শপথগুলো এ মহাগ্রন্থের অলৌকিকতা ও সূক্ষ্মতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই কোরআনের মধুর কাজগুলোর মধ্যে এসব শপথ অন্যতম। শপথ নেয়া একটি আন্তর্জাতিক রীতি। কোরআন বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ তুলে ধরার পাশাপাশি শপথের মত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমকেও ব্যবহার করেছে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নিজ সৃষ্টিকূলের মধ্য থেকে প্রাকৃতিক বিভিন্ন বস্তু বা বিষয়ের শপথ নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হল, এসব শপথের উদ্দেশ্য বা দর্শন কি? এ ব্যাপারে যেসব গবেষণা হয়েছে তা থেকে বোঝা যায়, মহান আল্লাহ এসব শপথের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ওইসব বিষয় বা বস্তুর ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও জ্ঞান সৃষ্টি এবং এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনার অভ্যাস গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে আল্লাহ এসব শপথের মাধ্যমে মানুষকে বিভিন্ন বিজ্ঞান যেমন, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূ-তত্ত্ব, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদ বিদ্যা এবং এমনকি মানবিক বিজ্ঞান যেমন, সমাজ বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানোর উৎসাহ দিয়েছেন।
প্রত্যেক জাতি বা গোত্র তাদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত বিষয়গুলোর শপথ নিয়ে থাকে। যেমন, অনেকেই বলে থাকেন ” আমার জীবনের শপথ, যা বলছি সত্য বলছি। ” এর মাধ্যমে তারা নিজ জীবন ও বক্তব্যের মধ্য এক ধরণের সম্পর্ক সৃষ্টি করেন, যে সম্পর্কের অর্থ হল- জীবন যেমন তাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত তেমনি তাদের কথারও মূল্য রয়েছে। অনুরূপভাবে কেউ যদি আল্লাহর নামে শপথ করে কিছু করার কথা বলে তার অর্থ হল সে অবশ্যই সর্বোচ্চ সম্মানিত সত্তা তথা স্রস্টার মর্যাদার খাতিরে তা বাস্তবায়ন করবে।
বিশিষ্ট সুন্নি মুফাসসির তানতাভি বলেছেন, “মহান আল্লাহ কোরআনে ৪০ ধরণের শপথ নিয়েছেন। এর মধ্যে বিশটি শপথ আকাশমণ্ডল ও আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে আর বিশটি শপথ বস্তু-জগতকে নিয়ে। এসব শপথের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা-ভাবনার উৎসাহ দিয়েছেন। তাই কোরআনের শপথগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাবি। ”
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র জীবনের শপথও নিয়েছেন। সবচেয়ে প্রিয় ও নির্বাচিত বান্দার জীবনের শপথ নিয়ে মহান আল্লাহ এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র জীবন যেমন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আমার এ বক্তব্য ও প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
মহান আল্লাহ সূরা তিন-এ ডুমুর ও জয়তুনের শপথ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি এসব ফলের ব্যাপক গুরুত্ব ও উপকারিতা তুলে ধরেছন। ” মাজমায়ুল বায়ান” শীর্ষক গ্রন্থে বিখ্যাত মুফাসসির তাবরেসি বলেছেন, ” আল্লাহ এসব সৃষ্টির শপথ নিয়েছেন, কারণ, এসবের মধ্যে মানুষের জন্য ব্যাপক কল্যাণ রয়েছে এবং এসব সৃষ্টি মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতার নিদর্শন বা প্রকাশ-স্থল।”
বিখ্যাত মুফাসসির সুইয়ুতি কোরআনের শপথগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: প্রথমত: নিজের য’ত বা সত্তার শপথ, দ্বিতীয়ত: নিজের কর্ম এবং তৃতীয়ত: নিজের সৃষ্ট বিষয়ের শপথ। যেমন, মহান আল্লাহ সূরা হিজরের ৯২ নম্বর আয়াতে বলেছেন,”অতএব আপনার পালনকর্তার কসম, আমি অবশ্যই ওদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব।”-এটা প্রথমোক্ত শ্রেণীর শপথ। সূরা শামসের ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,”শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন,তাঁর।”-এটা দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণীর শপথ।সূরা নযমের প্রথম আয়াতে রাব্বুল আ’লামিন বলেছেন, ” শপথ নক্ষত্রের যখন তা অস্তমিত হয়।”-এটা তৃতীয়োক্ত শ্রেণীর শপথ।
কখনও কখনও পবিত্র কোরআনে আল্লাহর শপথগুলো উচ্চারিত হয়েছে চিন্তাগত ভুল-ভ্রান্তি ও কূসংস্কারাচ্ছন্নতা মোকাবেলার জন্য। যেমন, কোরআনে বলা হয়েছে, কেউ কেউ আল্লাহকে সন্তানের অধিকারী বলে অপবাদ দিত। তারা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে অভিহিত করত। এ ধরণের বক্তব্য সত্যের বিচ্যুতি। আল্লাহর প্রতি এ ধরণের অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য আল্লাহ নিজ সত্তার কসম দিয়ে তাদেরকে শাস্তি দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন।
আল্লাহর সন্তান থাকার মত জঘন্য অপবাদ দেয়ার অপরাধে বিচার বা পুণরুত্থান দিবসে এ ব্যাপারে তাদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হবে বলে শপথ করেছেন মহান আল্লাহ।
পবিত্র কোরআনে মানুষের নামেও শপথ নিয়েছেন মহান আল্লাহ। মানুষ মহান আল্লাহর সৃষ্ট জীবকূলের মধ্যে সেরা জীব এবং তাঁর প্রিয় সৃষ্টি। এ জন্য তিনি সুরা শামসের ৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন: ” শপথ (মানুষের) প্রাণের এবং যিনি তা (সৃষ্টি ও ) সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর।”
অস্তিত্ব জগতের বিভিন্ন বিষয়ের শপথ বিশ্ব জগতের বিশাল ব্যাপ্তি ও মহাস্রস্টা হিসেবে আল্লাহর মহত্ত্বকে স্পষ্ট করে তুলে।
অনেক সময় কোনো বিষয়ে মানুষের কিছু সন্দেহ নিরসনের জন্য কোরআনে ওই বিষয়ের শপথ নিয়েছেন আল্লাহ। যেমন, যারা কিয়ামত বা পুণরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করত বা এখনও করে তাদের এ বিষয়ে সন্দেহ দূর করার জন্য আল্লাহ কিয়ামতের শপথ নিয়েছেন। অর্থাৎ এই দিন তথা বিচার-দিবস যে অবশ্যই আসবে তাতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
মিশরীয় আলেম আল কাত্তানের মতে যারা নিজ প্রকৃতিকে পংকিল ও অসুন্দর করেনি তারা সহজেই বা সামান্য ইশারাতেই সত্যকে মেনে নেয়। কিন্তু যাদের অন্তর অজ্ঞতা ও অসচেতনতার আঁধারে কলুষিত তাদের হৃদয়কে সহজেই নাড়া দেয়া যায় না। তাঁর দৃষ্টিতে এদের জন্যই জোরালো ও কঠোর সতর্ক-বাণী দরকার হয়। শপথ কোনো বিষয়কে জোরালোভাবে বা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরার অন্যতম পদ্ধতি ও বিষয়টির সত্যতার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই অনেক সময় এ ধরণের শপথের কারণে অস্বীকারকারী ব্যক্তি বাস্তবতাকে মেনে নেয়।
কোরআনে রাত ও দিনের এবং দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ের শপথ দেখা যায়। যেমন, দিন, রাত, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, বিকাল বা অপরাহ্ন। সুরা আসরে আল্লাহ যুগের শপথ নিয়েছেন। অনেকে নিজের কষ্ট বা বিপদের জন্য যুগ বা সময়কে অশুভ কিংবা দোষী বলে মনে করে। কিন্তু কোরআনে যুগ বা সময়ের শপথ এ সংক্রান্ত ধারণাকে কুসংস্কার হিসেবে বাতিল করে দেয়। বরং সময় বা যুগ মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন। কোরআনে যুগ বা সময়ের শপথ পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের কথা ও সময়ের সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তাকে পরকালের জন্য প্রস্তুত হতে বলে।
বরফ বিক্রেতাকে যেমন সময় থাকতেই তথা বরফ গলার আগেই তা বিক্রি করতে হয়, তেমনি মানুষের জীবনকেও সময় থাকতে সংশোধন করা উচিত। নইলে দেখা যাবে জীবনের বরফ গলে গেছে, লাভ তো দূরের কথা মূল পূঁজিটুকুই বিনা মূল্যে হারাতে হয়েছে।
হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন: আল্লাহ নিজ সৃষ্টিকূলের অনেক কিছুর শপথ নিয়েছেন যাতে মানুষ যেসব বিষয়ে শিক্ষা নেয়া দরকার সেসব বিষয়ে শিক্ষা নেয় ও সচেতন হয়। যে বস্তুর নামে শপথ করা হয় তা ওই বস্তুর গুরুত্ব তুলে ধরে। ”
অজানাকে জানা তথা জ্ঞান অর্জন মানব সভ্যতার চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। প্রকৃতিকে জয় করাসহ বস্তুগত ও ইহকালীন অশেষ কল্যাণের মাধ্যম হল জ্ঞান। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও পারলৌকিক সৌভাগ্যেরও নিয়ন্তাও হল জ্ঞান। অন্যকথায় জ্ঞান কেবল অর্থই যোগায় না, যোগায় মানসিক বা আধ্যাত্মিক সুখ ও চিন্তার খোরাক। কোরআনের দৃষ্টিতে চিন্তার দারিদ্র বস্তুগত দারিদ্রের চেয়েও বেশি ধ্বংসাত্মক। অন্যদিকে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সাধনা জ্ঞান ছাড়াও কখনও অর্জিত হতে পারে না। জ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরে কোরআন প্রশ্ন করে:” যারা জানে আর জানে না তারা কি সমান?” উল্লেখ্য নবী-রাসূল ও নির্বাচিত মহাপুরুষদের মহত্ত্ব তুলে ধরতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন যে, ” আমরা তাকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছি।” এ জাতীয় অনেক আয়াত রয়েছে কোরআনে। মহান আল্লাহ কোরআনের অনেক আয়াতে সৃষ্টি জগতের নানা বিস্ময় সম্পর্কে মানুষকে চিন্তা-ভাবনার আহ্বান জানিয়েছেন। যেমন, তিনি বলেছেন, ” তবে তোমরা কি দেখছ না বা দেখতে পাও না?”, কিংবা “অত:পর তাকিয়ে দেখ।” এসব বাক্য জ্ঞান ও সচেতনতা অর্জনেরই আহ্বান।
জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে কোরআন শিক্ষক ও ছাত্রের জন্য এবং স্থান ও সময়ের দিক থেকে কোনো সীমাবদ্ধতার কথা বলেনি। মানব জাতির কোনো আদর্শ বা মতাদর্শেই জ্ঞানের প্রতি এত সীমাহীন ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেখা যায় না। কোরআনের দৃষ্টিতে আলো ও আঁধারের মধ্যে আলোই শ্রেয় এবং এ মহাগ্রন্থ জ্ঞানকে আলো, আর অজ্ঞতাকে আঁধারের সাথে তুলনা করেছে।
কোরআন যেসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করতে বলে, সেসবের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতি-বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিদ্যা, ইতিহাস ইত্যাদি। এসব বিজ্ঞান বর্তমান বিশ্বে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সূরা বাকারার ১৬৪ নম্বর আয়াতে এসেছে: “আকাশ ও ভূমণ্ডল সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে, আর যা মানুষের উপকারী জিনিসপত্র নিয়ে পানির ওপরে ভেসে বেড়ায় সেসব তরীসমূহে, আর আসমান থেকে আল্লাহ যে বারিধারা বর্ষণ করেন-তাই দিয়ে মরা মাটিকে বাঁচিয়ে তোলেন এবং তার মধ্যে যাবতীয় জীব-জন্তুর বিস্তারণে, বাতাসের গতি পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থ সঞ্চিত মেঘের সঞ্চারণে চিন্তাশীল ও জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য (আল্লাহর পবিত্র সত্তার ও তাঁর একত্বের) নিদর্শন রয়েছে। “
অন্যদিকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরাও জ্ঞানের ওপর অশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, “প্রকৃত জ্ঞান মুমিনের জন্য হারানো সম্পদ, যেখানেই তা পাও না কেন তা তার কাম্য হওয়া উচিত।”তিনি আরো বলেছেন, ” জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীনে যাও।”
বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, ” আমি যুব সমাজকে কেবল এ দুই অবস্থার মধ্যে দেখতে পছন্দ করি যে তারা হয় বিশেষজ্ঞ বা জ্ঞানী হবে অথবা জ্ঞান বিতরণকারী হবে।”
কোরআন নাজেল হওয়ার যুগে মানুষের জ্ঞানগত অবস্থান ছিল খুবই নিচে। জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যার মত বিদ্যায় মানুষের জ্ঞান ছিল খুবই সামান্য। অথচ সে যুগেই কোরআন জ্ঞানের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করেছে। সে সময় আরবরা ছিল অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন। প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও যথেষ্ট তথ্য না থাকায় সে যুগের আরবরা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শোনা রূপকথার ভিত্তিতে মনে করত যে, পাহাড়গুলোই আকাশকে উপরে ধরে রেখেছে, পৃথিবী সমতল এবং এর দুই প্রান্তে থাকা পাহাড়গুলো আকাশের নীচের স্তম্ভ। কোরআন তাদের এ জাতীয় ধারণার অসারতা তুলে ধরেছে।
সূরা রা’দের দুই নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:” আল্লাহই তিনি যিনি উর্ধ্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে কোনো ধরণের স্তম্ভ ছাড়াই।” বিশ্ব জগত সম্পর্কে কোরআনে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বাস্তবতা রয়েছে যে অনেক বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ সেগুলোকে কোরআনের অলৌকিকতার নিদর্শন বলে স্বীকার করেছেন। এভাবে কোরআন মানব জাতিকে অজ্ঞতার আঁধার থেকে মুক্ত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের ব্যবস্থা করেছে। তাই ইসলামের আবির্ভাবের পর অল্প সময়ের মধ্যেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে হিজরী তৃতীয় শতক থেকে হিজরী পঞ্চম শতকের শেষের দিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের অসাধারণ অগ্রগতি ঘটেছিল। কোরআনের উৎস ও ইসলামের বিস্তৃতির কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল বলে বেশির ভাগ গবেষক মনে করেন। ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল লিখেছেন: যদি মধ্য যুগে মুসলমানদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা না থাকত তাহলে বিজ্ঞানের পতন হত অনিবার্য। ফরাসি চিন্তাবিদ পিয়েরে রুশো ” বিজ্ঞানের ইতিহাস” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন,”ইসলামের নবী (সা.)’র ইন্তেকালের পর তিন শতক না যেতেই কর্ডোভায় দশ লাখ নাগরিকের জন্য গড়ে উঠেছিল ৮০টি কলেজ বা মহাবিদ্যালয় এবং আরবি ভাষাসহ বিজ্ঞান-চর্চার বিভিন্ন ভাষায় লিখিত ৬ লাখ বই সম্বলিত বিশাল লাইব্রেরি। ” পাশ্চাত্যে আল্লাহর সূর্য ” শীর্ষক বইয়ে জার্মান লেখিকা মিসেস জিইগ্রিদ হুনকা লিখেছেন: ” মিশরের কোনো এক খলিফার লাইব্রেরিতে ১৬ লাখ বই ছিল। এসব বইয়ের মধ্যে ছয় হাজার বই ছিল কেবল গণিত বিষয়ের এবং ১৮ হাজার বই ছিল দর্শন সম্পর্কিত।”বেলজীয়ামে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন ঐতিহাসিক জর্জ সার্টন বলেছেন, “সম্ভবত: মধ্যযুগে বিজ্ঞানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথচ সবচেয়ে কম-অনুভূত সেবাটি ছিল পরীক্ষামূলক বা অধুনিক বিজ্ঞানের চিন্তা। আর এ বিষয়টি আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ভিত্তি গড়ে তুলেছে। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতকের শেষের দিক পর্যন্ত এ চিন্তার বিকাশ ঘটেছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান এ জন্য মুসলমানদের প্রচেষ্টা ও পবিত্র কোরআনের শিক্ষার কাছ ঋণী। ”
কোরআন কেবল মানুষের জন্য উপকারী জ্ঞানকেই গুরুত্ব দেয়। উপকারী জ্ঞান মানুষকে শান্তি, সৌভাগ্য ও ন্যায়বিচারের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু যে জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষকে ক্ষমতালোভী ও আত্মকেন্দ্রীক করে এবং ডেকে আনে সমাজের ধ্বংস, তা কোরআনের কাম্য নয়।
ভুল বিশ্বাস ও পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া অযৌক্তিক ধারণার অন্ধ অনুকরণের নিন্দা জানায় কোরআন। যেমন, সূরা বাকারার ১৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “তারা ছিল এক সম্প্রদায়-যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্যে। তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না।” অজানাকে জানার জন্য জ্ঞানীদের কাছে প্রশ্ন করার গুরুত্ব তুলে ধরে কোরআনের সূরা নাহলের ৪৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর,যদি তোমাদের জানা না থাকে।” কোরআন মানুষকে অজ্ঞতাপূর্ণ কাজ ও চিন্তার ব্যাপারে সতর্ক করার পাশাপাশি তাদেরকে গভীর চিন্তা ও অনুসন্ধানের আহ্বান জানায়। আল্লামা মোহাম্মাদ তাকি জা’ফরির মতে কোরআনের প্রায় ৭৩০টি আয়াতে জ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার সুফল তুলে ধরা হয়েছে। পবিত্র ও সৌভাগ্যময় জীবনের দিক নির্দেশনা দেয়াই এসব আয়াতের লক্ষ্য।
মানুষ প্রজ্ঞা ও বিবেক-সম্পন্ন সত্তা। বিবেক ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে মানুষ সত্য ও মিথ্যা বা ভাল ও মন্দের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে। জ্ঞান ও জ্ঞান অর্জনের ভিত্তি হল আকল। প্রকৃতির বিস্ময়কর নানা দিক, জীবন ও জগতের অনেক বাস্তবতা-এসব যদি মানুষের কাছে স্পষ্ট না হত তাহলে মানুষ অন্যান্য সৃষ্টি ও প্রকৃতির ওপর এত কর্তৃত্ব করতে পারত না। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রজ্ঞার প্রয়োগ ছাড়া মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির এত অগ্রগতিও সম্ভব হত না ।
সূরা আম্বিয়া’র দশ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
“আমি তোমাদের প্রতি একটি কিতাব অবর্তীর্ণ করেছি; এতে তোমাদের জন্যে সতর্কবাণী বা উপদেশ (ও সচেতনতা) রয়েছে। তোমরা কি চিন্তা কর না ? বা বোঝ না?”
মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলার জন্য সূরা জুখরুফের তিন নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আমি আরবী ভাষায় একে করেছি কোরআন,যাতে তোমরা বুঝ বা চিন্তা কর।”
সূরা নাহলের ১২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আপন পালন কর্তার পথের দিকে আহবান করুন হেকমতের মাধ্যমে বা জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দনীয় পন্থায়।”
বিবেক ও প্রজ্ঞার শাসন মেনে চলা একটি অপরিহার্য ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সূরা কাসাসের ৬০ নম্বর আয়াতে কোরআন বলছে,
“তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, তা পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা ছাড়া অন্য কিছু নয়।আর আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উত্তম ও স্থায়ী। তোমরা কি আকল খাটাও না, বা বোঝনা?”
এ আয়াতে মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কোনো মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা ও বিবেককে কতটা ভালভাবে ও কত ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করতে পেরেছে তার ওপরই নির্ভর করছে তার মূল্য বা মর্যাদাগত অবস্থান। যেসব মানুষ বুদ্ধি খাটায় না বা বিবেককে ব্যবহার করে না আল্লাহ তাদেরকে বোবা ও বধির বলে অভিহিত করেছেন। যেমন, সূরা আনফালের ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
“নি:সন্দেহে আল্লাহ্তা’আলার দৃষ্টিতে সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই মূক ও বধির, যারা উপলদ্ধি করেনা।”
সৃষ্টি জগতের বিস্ময়কর নানা নিদর্শন, বিশ্ব জগতের সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতির পরতে পরতে থাকা শিক্ষনীয় নানা দিক জ্ঞানী ও বিচক্ষণ লোকদের কাছে মহান আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। মহান আল্লাহর অশেষ মহত্ত্বের কাছে শ্রদ্ধায় নতজানু হন তারা। জ্ঞান শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তা এবং প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানোর জন্য কোরআনের অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ এ মহাগ্রন্থের অলৌকিকতার অন্যতম দিক। সূরা ফাতিরের ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ক্ষমাময়।”
আল্লাহ চান মানুষ যেন বুঝে-শুনে তথা বিবেক-বুদ্ধিকে ব্যবহার করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও তাঁর অনুগত থাকে। আর এ জন্য আল্লাহর নানা নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা জরুরি। এ লক্ষ্যেই মহান আল্লাহ প্রকৃতির নানা বিষয়, পারলৌকিক জীবন ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে কথা বলেছেন পবিত্র কোরআনে। আসলে মানুষকে এসব বিষয়ে চিন্তাশীল করা কোরআনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
যারা চিন্তা-ভাবনা করে না এবং বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে না, কোরআন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানায়। যেমন, মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষ ও পশুর মধ্যে ব্যবধানের মানদণ্ডই হল চিন্তাশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা। অন্য কথায় প্রকৃত মানুষ বিবেক ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগায়, আর যারা তা করে না তারা দেখতে মানুষের মত হলেও আসলে পশুর সমতুল্য ও এমনকি তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট। যে বুদ্ধিমত্তা ও বিবেকের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব ও মহান আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা সেই মানুষই এসব ঐশী বা খোদায়ী নেয়ামত ব্যবহার না করায় আল্লাহর সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টিতে পরিণত হয়। সূরা মুলকের দশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ( বেহেশতবাসীদের সাথে কথপোকথনের সময়) দোযখবাসীরা বলবে: “তারা আরও বলবেঃ হায়! যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।”চিরস্থায়ী সৌভাগ্য, সুপথ ও মুক্তির জন্য যে বিবেকের চোখ-কান খোলা রাখা জরুরি তা এ আয়াত থেকে স্পষ্ট।
যেসব বিষয় বা চালিকা শক্তি মানুষকে চিন্তাশীলতা ও প্রজ্ঞা থেকে দূরে সরিয়ে তাদেরকে ভুল-ত্রুটি ও অধ:পতনের অতলে তলিয়ে নিয়ে যায় সেসব বিষয়ে সতর্ক করে কোরআন। অলীক ধারণা ও খেয়ালিপনা মানুষের বিভ্রান্তির অন্যতম মাধ্যম।
কোরআনের দৃষ্টিতে যারা বুঝে শুনে আল্লাহকে মানে আর যারা না বুঝেই আল্লাহকে মানে তাদের মধ্যে প্রথমোক্ত শ্রেণীই শ্রেষ্ঠ। দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণী যে কোনো সময় শয়তানের ধোকার শিকার হতে পারে। কোরআন অমূলক বা প্রমাণহীন সন্দেহ ও অশুভ ধারণা পোষণ করতে নিষেধ করে। তাই কোনো বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ওই বিষয়ের ভালো বা খারাপ হওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। তেমনিভাবে নিশ্চিত না হয়ে কারো ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করাও ঠিক নয়।
কোরআন আলো, আরোগ্য এবং দয়া ও করুণার আধার। মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয় এ মহাগ্রন্থ। আর এ জন্যই বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার দিকে আহ্বান সম্বলিত কোরআনের আয়াতের সংখ্যাও ব্যাপক। যেমন, পবিত্র কোরআনের ১৫ টি আয়াতে মানুষকে প্রজ্ঞা ও বিবেক-সম্পন্ন লোকদের কাতারে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এটা স্পষ্ট, কোরআন বা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মতাদর্শ বা বিশ্ব-দর্শনে বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেখা যায় না। আধুনিক যুগের দার্শনিক মরহুম আল্লামা জা’ফরী লিখেছেন:
“চিন্তা-ভাবনা করার, বুদ্ধি খাটানোর ও বিচক্ষণ বা দূরদর্শি হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছেকোরআনের যেসব আয়াতে সেসব আয়াতের মোট সংখ্যা ২১৩। আয়াতগুলোকে আবার কয়েকটি উপ-শিরোনামের আওতায় এভাবে বিন্যস্ত করা যায়: ১-আকল বা বিবেককে জোরদার করা ও বিবেকের অনুসরণ সম্পর্কিত আয়াতের সংখ্যা: ৪০।
২- যথাযথ ও গভীর উপলব্ধি সম্পর্কিত আয়াত ১৫ টি।
৩- চিন্তা সংক্রান্ত আয়াত রয়েছে ১৭টি।
৪- বোধ-শক্তি ও সচেতনতা অর্জন সংক্রান্ত আয়াত ২১টি।
৫-জ্ঞানের অনুসরণ ও অজ্ঞতা পরিহার সংক্রান্ত আয়াত ১০০টি।
৬-অস্তিত্ব-জগতের বা বিশ্ব-জগতের নানা বিস্ময় সম্পর্কে চুল-চেরা বিশ্লেষণ সংক্রান্ত আয়াত রয়েছে বিশটি।”