সূরা নাহল;(২৯তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা নাহল;(২৯তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 8:30:14 5-10-1403

সূরা নাহল; আয়াত ১২০-১২৪

সূরা নাহলের ১২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

“নিশ্চয় ইব্রাহীম ছিলেন (এককভাবে) এক জাতির প্রবর্তক, আল্লাহর অনুগত, বিনম্র ও সত্যমুখী ছিলেন এবং তিনি  অংশীবাদী বা শিরককারীদের দলভুক্ত ছিলেন না।” (১৬:১২০)

মহান আল্লাহর নানা নেয়ামতের বর্ণনার পর এ আয়াতে তাঁর প্রতি বিনম্র, অনুগত ও কৃতজ্ঞ বান্দার দৃষ্টান্ত হিসেবে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি কখনও শিরক বা অংশীবাদিতার শিকার হননি ও সব ধরনের বিচ্যুতি থেকে মুক্ত ছিলেন। এ আয়াতের শুরুতে ইব্রাহীম (আ.)-কে একাই একটি জাতি বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন মহান আল্লাহ। এর কারণ, সম্ভবত তিনি একাই একটি জাতির পূর্ণতাপ্রাপ্ত নানা গুণের অধিকারী ছিলেন কিংবা তাঁর দৃঢ় প্রতিরোধ ও ধৈর্যের মাধ্যমে একটি জাতিকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং একটি জাতির মতই বিচ্যুতদের মোকাবিলায় সংগ্রাম করেছিলেন।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. পরিমাণ বা সংখ্যার আধিক্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কখনও কখনও একজন খাঁটি মুমিনই একটি জাতির সমান গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাবশালী।

দুই. যা মানুষকে মহীয়ান করে তা হল আল্লাহর প্রতি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে বিনম্র এবং অনুগত থাকা তথা আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলা।

সূরা নাহলের ১২১ ও ১২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

شَاكِرًا لِأَنْعُمِهِ اجْتَبَاهُ وَهَدَاهُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (121) وَآَتَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَإِنَّهُ فِي الْآَخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ

“তিনি খোদায়ী নেয়ামতগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে মনোনীত এবং সরল পথে পরিচালিত করেছিলেন।” (১৬:১২১)

“আমি তাঁকে ইহকালে বা দুনিয়াতে দান করেছি কল্যাণকর জীবন এবং তিনি পরকালেও পুণ্যকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” (১৬:১২২)

আগের আয়াতে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র কিছু মহান গুণ বা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার পর এখানে তাঁর নবুওত ও রেসালাত সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন: ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন কৃতজ্ঞ বান্দা। আমি তাঁকে অনেক বান্দার মধ্য থেকে বাছাই করেছি এবং বিশেষ হেদায়াতের মাধ্যমে তাঁকে সরল পথে তথা আমার (খোদার) পথে পরিচালিত করেছি। তাই এটাই স্বাভাবিক যে যিনি বিশেষ ঐশী হেদায়াতের অধিকারী তিনি ইহ ও পরকাল- এ উভয় জগতেই পুণ্যময় জীবনের অধিকারী হবেন।

আল্লাহ হযরত ইব্রাহীম (আ.) যেসব সম্মানের অধিকারী করেছেন তা এই মহামানবের পূর্ণতাপ্রাপ্ত নানা গুণেরই পুরস্কার। এই মহান নবী ছিলেন অল্পে তুষ্ট, একত্ববাদী ও কৃতজ্ঞ। আর এসব গুণ অর্জন করা সহজ কাজ নয়। এইসব গুণ অর্জনের জন্য যেসব কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় হযরত ইব্রাহীম (আ.) সেইসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই আল্লাহর প্রিয়পাত্র হিসেবে মনোনীত হতে পেরেছেন।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার-

এক. মানুষ যখন ঈমানের নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তখন সে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করে।

দুই. যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞ হয় আল্লাহ তাকে বিশেষ হেদায়াত বা দিক-নির্দেশনা দান করেন, ফলে তিনি সব ধরনের বিচ্যুতি থেকে মুক্ত থাকেন।

সূরা নাহলের ১২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

“অতঃপর  আমরা আপনার কাছে প্রত্যাদেশ পাঠালাম যে, ইব্রাহীমের ধর্মপথ অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ বা সত্যমুখী ছিলেন এবং শিরককারী বা অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।”(১৬:১২৩)

মহান আল্লাহ হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে যেসব বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মান হল তিনি এ মহাপুরুষের ধর্মপথকে বিশ্বজনীন ও চিরস্থায়ী করেছেন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)সহ সব নবী-রাসূলকে ইব্রাহীম (আ.)’র অনুসারী হওয়ার ও এ বিষয়টি ঘোষণারও নির্দেশ দিয়েছেন। তাই ইসলামের অনেক রীতি বা প্রথার উতস হল ইব্রাহীমি প্রথা বা রীতি। রাসূল (সা.)ও নিজেকে ইব্রাহীমি আদর্শের অনুসারী বলে উল্লেখ করতেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি দিক হল:

এক. সব নবী-রাসূলের পথ ও লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। আর এ জন্যই হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র পর সব নবী-রাসূল সেই একই মিশন বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেছেন।

দুই. শিরক বা মহান আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার বলে মনে করা এত বড় রকমের বিপদ যে মহান আল্লাহ কয়েকটি আয়াতে বার বার হযরত ইব্রাহীম (আ.) যে অংশীবাদী ছিলেন না তা উল্লেখ করেছেন।

সূরা নাহলের ১২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন-

إِنَّمَا جُعِلَ السَّبْتُ عَلَى الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ وَإِنَّ رَبَّكَ لَيَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ

“শনিবারের (প্রতি সম্মান প্রদর্শন) দিন পালন নির্ধারণ করা হয়েছিল তাদের জন্যেই যারা এ ব্যাপারে মতানৈক্য করেছিল। নিশ্চয় আপনার প্রতিপালক বিচার দিবসে বা কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন যে বিষয়ে তারা মতভেদ করত।” (১৬:১২৪)

শুক্রবারকে  ইবাদতের দিবস ও ছুটি হিসেবে পালন করা হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র মাধ্যমে প্রচলিত অন্যতম প্রথা। কিন্তু ইহুদিরা শনিবারে এই দিবস পালন করে। তাই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মহান আল্লাহ বলছেন, শনিবারকে ছুটি করা ও এ দিবসের প্রতি সম্মান দেখানোর বিষয়টিকে শাস্তি হিসেবে ইহুদিদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। ইহুদিরা এ ব্যাপারেও মতভেদ করত। অর্থাত ইহুদিদের কেউ কেউ এ বিষয়টিকে মেনে নিয়েছিল এবং কেউ কেউ তা মেনে নেয়নি।  ইহুদিদের কেউ কেউ শনিবারেও আয়-উপার্জনে মেতে উঠেছিল।

ইসলাম ধর্মে যখন শুক্রবার বা জুমআ ইবাদতের দিন হিসেবে নির্ধারিত হয় তখন ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আপত্তি তুলে বলে যে, এটা তো ইব্রাহীমি ধর্মের পরিপন্থী। কারণ, ইব্রাহীমি ধর্ম অনুযায়ী শনিবারকে ইবাদতের দিন হিসেবে পালন করা উচিত। এর জবাবে আল্লাহ জানিয়ে দেন যে, শনিবারকে সম্মানিত করা হয়েছিল ইব্রাহীমের পর। তাই মুসলমানদের জন্য ওই দিনের সম্মান প্রদর্শন জরুরি নয়।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:

এক. অতীতের কোনো কোনো জাতির জন্য কোনো কোনো বিধান দেয়া হয়েছিল তাদের পাপের শাস্তি হিসেবে। তাই এ ধরনের বিধান সব জাতির জন্য প্রযোজ্য নয়।

দুই. মহান আল্লাহই হলেন প্রকৃত বিচারক বা ফয়সালাকারী। প্রকৃত ও পরিপূর্ণ বিচার পরকালে তথা পুনরুত্থান বা কিয়ামতের পরই অনুষ্ঠিত হবে।