কোরআন শরীফ অনুবাদের ইতিহাস
  • শিরোনাম: কোরআন শরীফ অনুবাদের ইতিহাস
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:43:38 1-10-1403



বাংলা ভাষায় কোরআন অনুবাদের কাজটি অনেক দেরীতে শুরু হয়েছে। এর পেছনে কারণও ছিলো অনেক। প্রথমত আমাদের এই ভূখন্ডে যারা কোরআনের এলেমের সাথে সুপরিচিত ছিলেন- সেসব কোরআন সাধকদের অনেকেরই কোরআন শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিলো ভারতের উর্দু প্রধান এলাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দেওবন্দ, সাহারানপুর, নদওয়া, জামেয়াতুল এসলাহ্, জামেয়াতুল ফালাহ সহ উর্দু ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এর সবকয়টির ভাষাই ছিলো উর্দু কিংবা ফার্সী, তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব দ্বীনি প্রতিষ্ঠান থেকে যারা উচ্চতর সনদ নিয়ে বের হন তাদের কোরআন গবেষণার পরিমন্ডলও সে ভাষার বাইরে ছড়াতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত পলাশীর ট্রাজেডীর ফলে আমাদের এ অঞ্চলে কোরআন গবেষণার কাজটি নানারকম পঙ্গুত্বের কারণে এমনিই দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলো। ফলে বাংলা আসামে কোরআনের আশানুরূপ কোনো অনুবাদই হয়নি। তৃতীয় কারণ হিসেবে বাংলা মূদ্রণ যন্ত্রের কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৭৭৭ সালে মুদ্রণ যন্ত্র আবিস্কার হলেও এ অঞ্চলের মুসলমানরা ১৮১৫ সালের আগে বাংলা মূদ্রণযন্ত্রের সাথে পরিচিত হবার কোনো সুযোগই পায়নি।
কে প্রথম কোরআনের বাংলা অনুবাদের সৌভাগ্যজনক এ কাজটি শুরু করেন, তা নিয়ে আমাদের মাঝে বিভ্রান্তির অন্ত নাই। কে বা কারা আমাদের সমাজে একথাটা চালু করে দিয়েছে যে, ব্রাহ্মণ ধর্মের সব বিধান মন্ডলীর নিষ্ঠাবান ধর্মপ্রচারক গিরিশ চন্দ্র সেন সর্ব প্রথম কোরআনের বাংলা অনুবাদ করেছেন। আসলে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে যাদের সর্বময় আধিপত্য বিরাজমান তারাই যে কথাটা ছড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। দুঃখ লাগে যখন দেখি আমাদের এ অঞ্চলের দু’একজন কোরআন মুদ্রাকর ও প্রকাশকও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ঐতিহাসিকভাবে অসমর্থিত এমনি একটি কথা অবাধে প্রচার করে চলেছেন। অথচ কোরআন ও কোরআনের শিক্ষার প্রতিটি ছাত্রই জানেন যে তার অনুবাদের পাতায় কোরআনের শিক্ষা সৌন্দর্য বাকধারার সাথে ব্রাহ্মবাদের প্রচারনীতিতে কোরআনের প্রতি ক্ষমাহীন বিদ্বেষ ছড়ানো রয়েছে।
গিরিশচন্দ্র সেনের ৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৭৯ সালে আরেকজন অমুসলিম রাজেন্দ্রলাল মিত্র কোরআনের প্রথম পারার অনুবাদ করেন। কলকাতার আয়ুর্বেদ প্রেস নামক একটি ছাপাখানা থেকে এক ফর্মার (১৬ পৃষ্ঠা) এই অনুবাদটি ৫০০ কপি ছাপাও হয়েছিলো।
১৮৮৫ সালে গিরিশ চন্দ্র সেনের এই অনুবাদের প্রায় ৮০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮০৮ সালে পূর্ব বাংলার রংপুর নিবাসী একজন সাধারণ কোরআন কর্মী মওলানা আমিরুদ্দীন বসুনিয়া কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদের কাজে হাত দেন। তিনি সে সময় কোরআনের আমপারার অনুবাদ সম্পন্ন করেন। যদিও তার অনুবাদের কপি এখন তেমন আর পাওয়া যায় না তবুও তিনিই যে কোরআনের প্রথম সৌভাগ্যবান বাংলা অনুবাদক এতে সন্দেহ নেই। কোনো অনূদিত কপির সব কয়টি অংশ দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য হওয়াই একথা বলার জন্যে যথেষ্ঠ নয় যে, এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ১৮৮৫ সালে বাংলা মূদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহারের পরপরই কলকাতার মীর্জাপুরের পাঠোয়ার বাগানের অধিবাসী আকবর আলী এ কাজে এগিয়ে আসেন। তিনিও মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়ার মতো শুধু আমপারা ও সূরা ফাতেহার বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। তার অনূদিত অংশটি ছিলো পুথির মতো। তার এ অনুবাদটি কোরআনের কোনো মৌলিক অনুবাদ ছিলো না। তিনি যেটা করেছেন তা ছিলো ১৭৮০ সালে অনুদিত শাহ আবদুল কাদেরের উর্দু অনুবাদের বাংলা। সরাসরি কোরআনের অনুবাদ নয় বলে সুধী মহলে এটা তেমন একটা স্বীকৃতি লাভ করেনি। আসলে ব্যক্তি যতো গুরুত্বপূর্ণ হোন না কেন তিনি যদি কোরআনকে কোরআন থেকে অনুবাদ না করেন তাহলে তাকে কখনো কোরআনের অনুবাদ বলে চালিয়ে দেয়া উচিৎ নয়। কোরআনের ব্যাকরণ, বিধি বিশেষ বাকধারা, ভাষা শৈলী, শিল্প সৌন্দর্য্য- সর্বোপরি কোরআনের ফাছাহাত বালাগাত না জেনে কোরআনের অনুবাদে হাত দেয়া কারোই উচিৎ নয়।
কোরআনের প্রথম অনুবাদক মওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া কোরআনের পূর্ণাংগ অনুবাদ করে দিতে পারেননি। পরবর্তী সময়ের গিরিশ চন্দ্র সেনের পূর্ণাংগ অনুবাদ কর্ম যেটা তখন বাজারে প্রচলিত ছিলো তাও ছিলো নানা দোষে দুষ্ট, তাই তার অনুবাদের মাত্র ২ বছরের ভেতরই কোরআনের বিশ্বস্ত ও পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ কর্ম নিয়ে হাযির হয়েছেন বিখ্যাত কোরআন গবেষক মাওলানা নায়ীমুদ্দীন।
এর আগে কলকাতার একজন ইংরেজ পাদ্রীও কোরআনের অনুবাদ করেছিলেন। শোনা যায় মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া থেকে গিরিশ চন্দ্র সেন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮০৮ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে আরো ৯ জন ব্যক্তি কোরআন অনুবাদ করেছেন। আল্লাহ তা’আলার শোকর আল কোরআন একাডেমী লন্ডন বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় কোরআনকে আমাদের মাতৃভাষায় উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছে।
সূত্র: বিডি আল কোরআন