কোরআন ইসলামী জ্ঞানের প্রথম বিষয়বস্তু
  • শিরোনাম: কোরআন ইসলামী জ্ঞানের প্রথম বিষয়বস্তু
  • লেখক: আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী । অনুবাদ: আবুল কাসেম
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:33:32 1-9-1403

সারাংশ: কোরআন ইসলামী জ্ঞানের প্রথম বিষয়বস্তু। ইসলামের অন্যান্য জ্ঞান যেমন (কিরায়াত), তাফসীর, কালামশাস্ত্র, হাদীস, রিজালশাস্ত্র, অভিধান, সারফ ও নাহু (ব্যাকরণশাস্ত্র), ভাষাশৈলী ও অলংকারশাস্ত্র (ফাসাহাত ও বালাগাত), ইতিহাস ও সীরাত (জীবনী) ইত্যাদি শাস্ত্রগুলো একে কেন্দ্র করেই এবং এ সম্পর্কিত বিষয়কে ব্যাখ্যার জন্য উৎপত্তি লাভ করেছে।

মূল প্রবন্ধ: প্রথম কোন্ বিষয়টি মুসলমানদের আকর্ষণ করে ও তাদের মধ্যে জ্ঞানের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে?-এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, মুসলমানদের জ্ঞানের শুরু কোরআন দিয়ে। তারা প্রথম কোরআনের আয়াতের অর্থ ও বিষয়বস্তু অনুধাবন ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করে। অতঃপর হাদীস গবেষণা শুরু করে। তাই যে শহরটিতে সর্বপ্রথম জ্ঞানের জাগরণ শুরু হয় তা হলো মদীনা। মুসলমানদের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মসজিদ। তাদের শিক্ষার বিষয়বস্তু ছিল কোরআন ও সুন্নাহ্ এবং তাদের প্রথম শিক্ষক ছিলেন রাসূল (সা.)। ইসলামের প্রথম শিক্ষণীয় বিষয় ছিল পঠন (কিরায়াত), তাফসীর, কালামশাস্ত্র, হাদীস, রিজালশাস্ত্র, ভাষাজ্ঞান, অভিধান, সারফ ও নাহু (ব্যাকরণশাস্ত্র), ভাষাশৈলী ও অলংকারশাস্ত্র (ফাসাহাত ও বালাগাত), ইতিহাস ইত্যাদি। এ সকল জ্ঞান কোরআন ও সুন্নাতের স্বার্থে সৃষ্টি হয়েছিল। এডওয়ার্ড ব্রাউন বলেছেন,

"বিশিষ্ট আরবি ভাষাবিদ প্রফেসর দাখভিয়া এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকার বাইশতম খণ্ডে তাবারী ও অন্যান্য আরব ঐতিহাসিকদের সম্পর্কে যে প্রবন্ধ লিখেছেন তাতে প্রশংসনীয়ভাবে ইসলামী সমাজে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিকাশকে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত কোরআনের আলোকে ইতিহাসের জ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশের বিষয়টি সেখানে আলোচিত হয়েছে। তিনি এ জ্ঞানসমূহ কিরূপে ঐশী প্রজ্ঞার ভিত্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে তা উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কিত জ্ঞান প্রথমত শব্দ ও ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে শুরু হয়। যখন অন্যান্য ভাষাভাষীরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ শুরু করে তখন আরবি শব্দ ও বাক্যগঠন এবং ব্যাকরণশাস্ত্রের আশু প্রয়োজন অনুভূত হলো। কারণ পবিত্র কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কোরআনে বর্ণিত অপ্রচলিত শব্দসমূহের অর্থ বিশ্লেষণের জন্য আরবি প্রাচীন কবিতাসমূহ যথাসম্ভব সংকলনের প্রয়োজন পড়ল... এই কবিতাসমূহের অর্থ অনুধাবনের জন্য আরবদের বংশ পরিচিতিবিদ্যা (ইলমূল আনসাব) ও তৎকালীন আরবদের ইতিহাস ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা অপরিহার্য হিসেবে দেখা দিল। কোরআনে অবতীর্ণ বিধিবিধানের পূর্ণতার জন্য জীবনের বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাহাবী ও তাবেয়ীদের নিকট হতে নবীর বাণী ও কর্ম সম্পর্কিত প্রশ্নের ফলশ্রুতিতে হাদীসশাস্ত্রের জন্ম হলো। হাদীসসমূহের নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা যাচাইয়ের জন্য হাদীসের সনদ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জনের বিষয়টি অপরিহার্য বিষয় বলে পরিগণিত হলো।... গবেষণার স্বার্থে সনদের বাস্তবতা, ইতিহাসের জ্ঞান, বর্ণনাকারীদের বৈশিষ্ট্য ও চারিত্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো। এর ফলে হাদীসশাস্ত্রবিদগণের জীবনী পর্যালোচনা (রিজালশাস্ত্র), বিভিন্ন সময়ের জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও ঘটনাসমূহ সম্পর্কিত জ্ঞান উদ্ভূত হলো। এ ক্ষেত্রে আরবের ইতিহাস যথেষ্ট ছিল না। তাই প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষত ইরানী, গ্রীক, হামিরী, হাবাশী ও অন্যান্য দেশের ইতিহাস জানাও কোরআনে সন্নিবেশিত জ্ঞান ও প্রাচীন কবিতা বোঝার জন্য অপরিহার্য হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ভূগোলবিদ্যাও এ উদ্দেশ্যে উদ্ভূত হয়েছিল। এরূপ অন্যান্য বিদ্যাও ইসলামী সাম্রাজ্যে দ্রুত বিস্তারের সাথে সাথে অপরিহার্য হিসেবে উদ্ভূত হয়।”১

জর্জি যাইদানের মত এটিই যে, অন্যান্য জ্ঞানের প্রতি মুসলমানদের আকর্ষণ কোরআনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। মুসলমানগণ কোরআনের প্রতি অনুরক্ত ছিল এবং এর সঠিক তেলাওয়াত ও উচ্চারণের বিষয়ে গুরুত্ব দিত। কোরআন তাদের দীন ও দুনিয়ার সমস্যার সমাধান দিত এবং তারা কোরআনের বিধান বোঝার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাত। কোরআনের শব্দ ও অর্থ অনুধাবনের প্রচেষ্টা বিভিন্ন জ্ঞানের উদ্ভব ঘটায়। ইসলামী সমাজে যে সজীব কোষটি জন্মের পর বিকাশ ও পূর্ণতার মাধ্যমে বৃহৎ ইসলামী সভ্যতার জন্ম দেয় সে কোষটি হলো কোরআনের প্রতি মুসলমানদের সীমাহীন ভালবাসা ও প্রেম। কোরআনের প্রতি মুসলমানদের অকুণ্ঠ ভালবাসাই যে জ্ঞানের সকল দ্বার উন্মোচনে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে জর্জি যাইদান মনে করেন। তিনি বলেন,

"মুসলমানগণ কোরআন লিখন ও সংরক্ষণে যথার্থ দৃষ্টি রাখত ও এ বিষয়কে এতটা গুরুত্ব দিত যে, ইতোপূর্বে অন্য কারো ক্ষেত্রে তা লক্ষ্য করা যায়নি। তারা এমনকি স্বর্ণ, রৌপ্য ও হাতির দাঁতের পত্রের ওপরও কোরআন লিখত। কখনও রেশমী কাপড় বা দামী কোন কাপড়ের ওপর স্বর্ণ ও রৌপ্যের কালি দ্বারা কোরআনের আয়াত লিখা হতো। গৃহ, মসজিদ, গ্রন্থাগার, সভাকক্ষের দেয়াল ও দরবারসমূহ এরূপ কাপড় ও কোরআনের আয়াতের দ্বারা অলংকৃত করত। লেখার জন্য সুন্দর হাতের লেখা ব্যবহার করত। বিভিন্ন ধরনের চামড়া ও কাগজ কোরআন লিখনে ব্যবহৃত হতো এবং বিভিন্ন রংয়ের কালির মাধ্যমে লিখে তার চারিপাশের রেখাগুলো স্বর্ণ দিয়ে অলংকৃত করা হতো।... মুসলমানগণ কোরআনের শব্দ ও আয়াত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করত, এমনকি কোরআনের বর্ণসংখ্যা স্বতন্ত্রভাবে তারা গণনা করেছিল।”২

তিনি বলেছেন,

"...তাদের সকল বক্তব্য ও লেখনীতে কোরআনের পথকে তাদের কর্মপদ্ধতির আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা তাদের লেখনীতে কোরআনের আয়াতসমূহ হতে উদাহরণ নিয়ে আসত। কোরআনের শিক্ষা ও আদব তাদের দৈনন্দিন জীবনের চরিত্রে ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব রাখত। অথচ অধিকাংশ মুসলিম জাতির ভাষা কোরআনের ভাষা ছিল না এবং তারা এমন দেশে বাস করত যেখান হতে কোরআন অনেক দূরে অবতীর্ণ হয়েছিল। পূর্ববর্তী মুসলমানগণ শরীয়তের জ্ঞান ছাড়াও আরবি ব্যাকরণের বিষয়েও কোরআনের আয়াত ও অর্থ হতে উদাহরণ উপস্থাপন করত, যেমন আরবি ভাষা ও ব্যাকরণবিদ সিবাভেই তাঁর গ্রন্থে কোরআন হতে তিনশ’ আয়াত উদাহরণ হিসেবে এনেছেন। যে সকল সাহিত্যিক ও লেখক তাঁদের বক্তব্য ও লেখনীকে সুন্দর ও অলংকৃত করতে চাইতেন অবশ্যই কোরআনের আয়াতের সহযোগিতা নিতেন।”৩

জর্জি যাইদান আরো উল্লেখ করেছেন,

‘সালাউদ্দীন আইউবী মিশর অধিকারের পর দ্বিতীয় ফাতেমী খলীফা আল আযিয বিল্লাহ্ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারে স্বর্ণ দ্বারা লিখিত ও অলংকৃত তিন হাজার চারশ’ কোরআন পান। আল আযিয বিল্লার মন্ত্রী ইয়াকুব ইবনে কালাস তাঁকে এরূপ কোরআন লিপিবদ্ধ করার কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।” ৪

ইরানের মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর যাদুঘরে যে প্রাচীন কোরআন সংরক্ষিত আছে সেগুলোর আকর্ষণীয় ও আশ্চর্যজনক সুন্দর লিখনপদ্ধতি ও অলংকৃত পৃষ্ঠাসমূহ এ দেশের মানুষের কোরআনের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসার প্রমাণ।

ইসলামের জ্ঞানগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বর্ণিত পর্যায়ক্রমিক ধারাতেই বিকশিত হয়েছিল। এখন আমরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে আলোচনা করব।

যদিও ইসলামী বিশ্বের বাইরে হতে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বলিত যে সকল গ্রন্থ অনূদিত হয়েছিল তা ইরানী ছিল না, কিন্তু ইসলামী বিশ্বের ধর্মীয় ও অন্যান্য জ্ঞান বিষয়ক অধিকাংশ গ্রন্থ ইরানী মুসলিম মনীষীদের মাধ্যমেই রচিত ও সংকলিত হয়েছিল। এটিই ইসলামী শাসনামলে ইরানীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এডওয়ার্ড ব্রাউন বলেছেন,

"তাফসীর, হাদীস, কালামশাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অভিধান, জীবনী, ইতিহাস, এমনকি আরবি ব্যাকরণ ও অলংকারশাস্ত্রের বিষয়ে যে সকল গ্রন্থ আরবদের নামে প্রসিদ্ধি ও পরিচিতি লাভ করেছে তার অধিকাংশই ইরানীদের রচনা এবং ইরানীদের অংশ বাদ দিলে এ সকল জ্ঞানের উল্লেখযোগ্য ও উত্তম অংশ আর অবশিষ্ট থাকবে না।”

আমরা এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে অ-ইরানী মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকার করতে চাই না। কারণ ইসলামী সভ্যতা বিশেষ কোন জাতির নয়; বরং সকল মুসলমানের। তাই আরব, ইরানী বা অন্য কোন জাতি তাঁকে নিজস্ব বলে দাবি করতে পারে না। তবে প্রতি জাতিই তার অবদানের অংশটুকু বর্ণনা ও নির্দিষ্ট করার অধিকার রাখে।#আল-বাসাইর

সূচীপত্র:

১. তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, ৩৯১-৩৯২।

২. তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, খ. ৩, পৃ. ৯৪-৯৫।

৩. তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, খ. ৩, পৃ. ৯৩।

৪. প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৩১৪।