একটি বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে,প্রকৃতপক্ষে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির কিরূপ সম্পর্ক রয়েছে? মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কি দু’ টি অপরিচিত সত্তার সম্পর্কের মতো? অথবা এ সম্পর্ক বন্দি ও জেলখানা বা পাখি ও খাঁচার মতো? বা ইউসুফের সঙ্গে কেনানের গর্তের সম্পর্ক? এটা উদ্ঘাটিত হওয়া আবশ্যক।
হয়তো কেউ বলবেন,বাস্তবে পৃথিবীতে মানুষের আগমন পাখির খাঁচায় বন্দি হওয়া বা কোন মুক্ত ব্যক্তিকে বন্দিশালায় বন্দি করা বা ইউসুফের কূপে বা গর্তে পতিত হওয়ার মতো বিষয়। বাস্তবিকই যদি প্রকৃতি আমাদের জন্য বন্দিশালা,খাঁচা বা কূপ হয় তবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নির্দ্বিধায় বিপরীতমুখী।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টা প্রকৃতিতে কিরূপ হওয়া উচিত? খাঁচায় বন্দি এক পাখির নিজেকে খাঁচা থেকে মুক্ত করা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই। তেমনি এক বন্দিরও জেলখানার সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই বরং সে চায় জেলখানার দেয়াল ভেঙ্গে নিজেকে মুক্ত করতে। হযরত ইউসুফও কূপে পড়ে এ প্রতীক্ষায়ই ছিলেন যে,কোন কাফেলা এসে পানি উঠানোর নিমিত্তে বালতি ফেলুক আর তিনি বালতিতে আরোহণ করে সেখান থেকে মুক্তি পান (সে ক্ষেত্রে কাফেলা পানির পরিবর্তে ইউসুফকে পাবে)।
এখন প্রশ্ন হলো কোরআন ও ইসলাম মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ককে বন্দি ও জেলখানা,ইউসুফ ও কূপ বা পাখি ও খাঁচার মতো মনে করে কিনা? অবশ্য এরফানে এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সানায়ী বলেছেন,
“ খাঁচা ভেঙ্গে এ ময়ূর উড়ে যাও আকাশে।”
অন্য একজন আরেফ বলেছেন,
“ইউসুফ! মিশরের সম্রাট হওয়ার জন্য কূপ থেকে বেরিয়ে আস।”
বন্দি ও বন্দিশালার তুলনাও এক্ষেত্রে প্রচুর এসেছে।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কৃষকের সঙ্গে ক্ষেতের বা ব্যাবসায়ীর সঙ্গে ব্যবসা ক্ষেত্র অথবা উপাসক ও উপাসনালয়ের মতো। কৃষকের জন্য কৃষিক্ষেত্র লক্ষ্য নয় বরং মাধ্যম। তার জীবনযাত্রার স্থান তার ঘর কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে কাজ করার মাধ্যমেই সে তার এ ঘরের সাফল্য ও আনন্দ হস্তগত করে। একজন কৃষককে অবশ্যই কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে লাঙ্গল চালাতে হবে,বীজ বপন করতে হবে,পানি সেচের মাধ্যমে জমিকে ফসলের উপযোগী করতে হবে,যদি আগাছা জন্মে তা পরিষ্কার করতে হবে। তারপরেই সে শস্য ঘরে তুলতে পারবে।
الدنیا مزرعة الآخرة
দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র।(কুনযল হাকায়িক,মানায়ী,দাল অধ্যায়)
তবে কোন কৃষকের কৃষিক্ষেত্র ও ঘর চিনতে ভুল করা উচিত নয়। যদি কেউ তা করে তবে বড় ভুল করবে। তেমনি বাজার ব্যাবসায়ীর জন্য কর্মক্ষেত্র অর্থাৎ যেখানে সে তার পুজি ও কর্মপ্রচষ্টাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করবে। যে হাদীসটি উপরে বর্ণনা করা হয়েছে তা রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর নিকট থেকে অপর একটি হাদীস আছে যা হচ্ছে,
الدّنیا متجر اولیاء الله
“দুনিয়া আল্লাহর ওলীদের ব্যাবসাক্ষেত্র।”
একদিন এক ব্যক্তি আলী (আ.)-এর সম্মুখে দুনিয়াকে তিরস্কার করছিল। লোকটি জানত আলী দুনিয়াকে তিরস্কার করেন,কিন্তু কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে তা সে জানত না। হয়তো সে ভেবেছে আলীর দুনিয়াকে তিরস্কার করা প্রকৃতি জগতকে তিরস্কার করার মতো,কিন্তু জানত না যে,আলী দুনিয়া প্রেমে নিমজ্জিত হওয়া যা সত্য ও আল্লাহ্পাকের উপাসনা থেকে মানুষকে বিরত রাখে এবং মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে সেটাকে তিরস্কার করেন (খোদ দুনিয়াকে নয়)। আলী (আ.) ঐ ব্যক্তির দুনিয়াকে তিরস্কার করাকে লক্ষ্য করে বললেন,
أیّها الذامّ للدنیا، المغترّ بغرورها، المخدوع بأباطیلها أتغتّر بالدّنیا ثمّ تذمّها ؟ أنت المتجرّم علیها أم هی المتجرّمة علیک ؟
“হে দুনিয়াকে তিরস্কারকারী ব্যক্তি! যে দুনিয়ার প্রতারণায় পড়েছ,দুনিয়া তোমাকে প্রতারিত করেনি; বরং তুমি নিজেই প্রতারিত হয়েছ। সে তোমার উপর জুলুম করেছে নাকি তুমি তার উপর জুলুম করেছ?” সুতরাং দুনিয়া মানুষকে প্রতারিত করে না,বরং মানুষ নিজেই প্রতারিত হয়।”
এ ক্ষেত্রে আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কখনো হয়তো এক বৃদ্ধা মহিলা কৃত্রিম সাজ ও প্রসাধনীর মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে প্রতারিত করে। দাঁতহীন মুখে কৃত্রিম দাঁত,চুলবিহীন মাথায় কৃত্রিম লাগিয়ে আসে। আরব কবির ভাষায়-
“কোমর বাঁকা বৃদ্ধা হারিয়েছে লাবণ্য
তবুও হতে চায় যুবতী বলে গণ্য।”
এখন যদি কোন অভাগা ব্যক্তি এ বৃদ্ধাকে যুবতী মনে করে তার পানি গ্রহণ করে ও বুঝতে পারে যে,সে ভুল করেছে তবে এ ক্ষেত্রে এ বৃদ্ধা তাকে প্রতারিত করেছে। কিন্তু কোন বৃদ্ধা যদি নিজেই বলে,“জনাব,আমার বয়স ঊনষাট বছর ছয় মাস ছয় দিন।” নিজের দাঁত ও চুল দেখিয়ে বলে,“আমার দাঁত ও চুল নেই। আমার এ দাঁত ও চুল কৃত্রিম।” এভাবে সত্যকে বর্ণনা করে বলে,“ আমাকে গ্রহণ করতে আপনি রাজী আছেন?” এমতাবস্থায় যদি সে ব্যক্তি তাকে বলে,“তোমার দাঁতহীন ঐ মুখের জন্য আমি উৎসর্গীকৃত। তোমার চুল নেই তাতে কি হয়েছে,তোমার চুলহীন মাথার জন্যই আমি নিবেদিত।” সে সত্য বলার পরও এ ব্যক্তি তাকে বলে,“বুঝতে পারছি তুমি নিজেকে গোপন করছ।” তখন কি বলা যাবে এ বৃদ্ধা তাকে প্রতারিত করেছে? না,বরং সে নিজেই প্রতারিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজেকে প্রতারিত করেছে।
আলী (আ.) বলছেন,“দুনিয়া কারো নিকট কোন কিছুই গোপন করেনি। দুনিয়া যখন কোন কিছুই গোপন করেনি কিভাবে তাকে বল : আমাকে প্রতারিত করেছে। যে দিন নিজ হাতে নিজের পিতাকে দাফন করেছ সে দিন কি দুনিয়া বলেনি : আমাকে যেরূপ দেখছ অমি এরূপই পরিবর্তনীয়,আমার স্থায়িত্ব নেই। আমাকে যেরূপ দেখছ সেরূপ অনুধাবন কর। আমি যেরূপ নই সেরূপ আমাকে ভেব না। আমার রূপ সব সময় একই এবং সব সময় আমি তা প্রকাশ করছি,কিন্তু আমি যেরূপ নই তুমি সেরূপ ভাব। তাই দুনিয়া কাউকে প্রতারিত করে না,বরং মানুষ প্রতারিত হয়।
(চিন্তা করে দেখ) দুনিয়া তোমার উপর জুলুম করেছে নাকি তুমি দুনিয়ার উপর জুলুম করেছ? দুনিয়া তোমার প্রতি খেয়ানত করেছে নাকি তুমি দুনিয়ার প্রতি খেয়ানত করেছ?
দুনিয়া কখন তোমাকে প্রতারিত করল? কখন দুনিয়া তোমাকে প্রবৃত্তির চাহিদায় মশগুল করল?
যে সময় তোমাদের পিতারা (পিতৃপরুষ) ভূলুন্ঠিত এবং মাতারা মাটির নীচের বিছানায় শায়িত (এবং তাদের দেহ পঁচে গেছে) সে সময়ও কি দুনিয়া তোমাকে প্রতারিত করেছে?” অতঃপর বললেন,الدنیا مسجد احباء لله “দুনিয়া আল্লাহর বন্ধুদের জন্য মসজিদ। যদি মসজিদ না থাকে তাহলে বান্দা কোথায় আল্লাহর ইবাদত করবে?
ومصلی ملائکة الله و مهبط وحی الله متجر أولیاء الله
দুনিয়া ফেরেশতাদের নামায স্থল,আল্লাহর ওহী নাযিলের স্থান এবং আল্লাহর ওলীদের জন্য ব্যাবসাস্থল। যদি বাজার না থাকে ব্যাবসায়ীরা ব্যাবসা করতে ও মুনাফা অর্জন করতে পারে কি?”
যে চিন্তা দুনিয়াকে মানুষের জন্য বন্দিশালা,খাঁচা বা কূপ বলে জানে ও ভাবে যে,মানুষের দায়িত্ব হলো এই বন্দিশালা বা খাঁচা ভেঙ্গে মুক্ত হওয়া বা কূপ থেকে বেরিয়ে আসা সে চিন্তা আত্মপরিচিতি ও আত্মাপরিচিতির ক্ষেত্রে অন্য একটি মৌল বিষয়ে বিশ্বাস রাখে যা ইসলামে গ্রহণীয় নয়।
পৃথিবীতে আত্মার পূর্ণতা
ইসলাম-পূর্ব যুগে কোন কোন দেশে বিশেষত গ্রীস ও ভারতে একটি বিশেষ বিশ্বাস ছিল। তা হলো মানুষের আত্মা পূর্বে অন্য এক জগতে পূর্ণরূপে সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে একে পাখিকে যেরূপ খাঁচায় বন্দি করা হয় তদ্রূপ এ পৃথিবীতে এনে বন্দি করা হয়েছে। যদি প্রকৃতই এরূপ হয় তবে অবশ্যই মানুষের উচিত এ খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা। কিন্তু কোরআনে সূরা মুমিনুনে এ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এ আয়াতটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। মোল্লা সাদরা বলেন,“ আমি আমার‘ দেহের উৎপত্তি ও আত্মার মাধ্যমে বেঁচে থাকা (স্থায়ী হওয়া)’ তত্ত্বটি এ আয়াত থেকে উদ্ঘাটন করেছি।” এ আয়াতটি যখন মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করছে তখন প্রথমে মানুষের মাটি হতে সৃষ্টি হওয়া থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে বীর্য,আলাকা (সংযুক্ত পিণ্ড),চর্বিত মাংসখণ্ড,অস্থিপাঁজর,অস্থিপাঁজর মাংস দ্বার আবৃত হওয়ার ধাপগুলো বর্ণনার পর বলছে,ثمّ أنشأناه خلقا آخر “ আমরা তাকে অন্য এক সৃষ্টিতে পরিবর্তন করে দিলাম।” (সূরা মুমিনুন : ১৪) অর্থাৎ মৌল ও যৌগ সমন্বয়ে গঠিত প্রাকৃতিক ও বস্তুগত এ জিনিসগুলোকে অন্য এক সৃষ্টিতে (অর্থাৎ রূহতে যা বস্তুগত নয়) পরিবর্তিত করে দিলাম অর্থাৎ রূহের উৎপত্তি এর প্রকৃতি থেকেই। রূহ বা আত্মা অবস্তুগত কিন্তু এ অবস্তুর উৎপত্তি বস্তু থেকেই। সুতরাং মানুষ অন্য জগতে পূর্ণরূপে কখনই ছিল না যার কারণে বলা যাবে যে,এ প্রথিবীতে তাকে খাঁচাবদ্ধ করা হয়েছে। বরং মানুষ এ পৃথিবীতে তার মায়ের কোলেই অবস্থান করছে। প্রকৃতি মানুষের আত্মার মাতা এবং মানুষ যখন এ প্রকৃতিতে জীবন যাপন করে তখন তার মায়ের কোলেই জীবন অতিবাহিত করছে। তাই তাকে এখানেই পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। সুতরাং মানুষ পূর্বেই পূর্ণতা লাভ করেনি ও পূর্ণতা লাভের পর এ পৃথিবীতে বন্দি বা কূপে পতিত নয় যে,তা থেকে মুক্তি পেতে হবে। এ চিন্তা ইসলামী নয়।
অবশ্য ইসলাম বলে তুমি সব সময় তোমার মাতৃক্রোড়ে থাকবে না। যদি সব সময় মাতৃক্রোড়ে থাকতে চাও তবে দুধের বাচ্চার মতই রয়ে যাবে,যুদ্ধের ময়দানের পুরুষ হতে পারবে না। যদি প্রকৃতি থেকে আরোহণ বা মাতৃক্রোড় থেকে উঠে উপরে না আস ও প্রকৃতিতেই থেকে যাও তবে
( ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ ) ( সূরা ত্বীন : ৫ ও ৬) ‘অতঃপর আমরা তাকে নিকৃষ্টতমদের মধ্যে নিকৃষ্টে পরিণত করি’ -এ আয়াতের নমুনায় পরিণত হবে।
আর (إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ) ‘যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে’ - এ আয়াতের নমুনায় পরিণত হতে পারবে না। যদি মানুষ হীনগ্রস্তদের মধ্যে হীনে পরিণত হয় অর্থাৎ প্রকৃতিতে বন্দি এ অর্থে— যে,এর ঊর্ধ্বে আরোহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ না করে,এ অবস্থা অন্য দুনিয়ায় (আখেরাতে) তার জন্য জাহান্নাম তৈরি করবে। যেমন সূরা আল-কারিয়াতে বলা হয়েছে,
فأمه هاویة “ জাহান্নাম তার জন্য মাতায় পরিণত হবে।” আল্লাহ্পাক কোন শিশুকে প্রকৃতিরূপ এ মাতার গর্ভে জন্মদান করেছেন যাতে সে উপরে উঠে আসে,শিক্ষা গ্রহণ করে পূর্ণতা লাভ করে ঊর্ধ্বে আরোহণ করে। এখন যদি এ শিশু চিরকাল এখানে থাকতে চায় তবে তার অবস্থা এক বয়স্ক শিশুর মত (যদিও তুলনা সম্পূর্ণ ঠিক নয়) যার বয়স পঁচিশ বছর হওয়ার পরেও চায় মা তাকে পাশে শুইয়ে মুখে ফিডার দিয়ে ঘুম পাড়াক। এ ধরনের ব্যক্তির বাস্তবে কোন মূল্য নেই।
সুতরাং ইসলামের মানব ও বিশ্ব পরিচিতিতে এমন কোন কল্পিত মোরগের অস্তিত্ব নেই যে পবিত্র জগতে উন্মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াত যাকে এ পৃথিবীতে এনে খাঁচাবদ্ধ করা হয়েছে। আরেফর ভাষায়-পবিত্র জগতের পাখি আমি শোনাব তোমায় বিচ্ছিন্নতার কাহিনী- আর তার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে এ বন্দিত্বের খাঁচা ভেঙ্গে ফেলার। ইসলাম এটা গ্রহণ করে না।
যদি আপনারা কখনো শুনে থাকেন আত্মার জগৎ বস্তু জগতের উপর প্রাধান্য রাখে সেটা এ অর্থে যে,আত্মার প্রকৃতিগত প্রাধান্য রয়েছে যা এ অস্তিত্ব জগতে বিচ্ছুরিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তার এ প্রকাশ ভিন্ন জগৎ থেকে উৎসারিত হয়েছে। কিন্তু এমন নয় যে,তার পূর্ণ রূপ সেখানে ছিল পরবর্তীতে তাকে এখানে এনে খাঁচাবদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের চিন্তা হিন্দু ধর্মের পুনর্জন্ম বা প্লেটোর চিন্তাধারার অনুরূপ। গ্রীকদের মধ্যে প্লেটো বিশ্বাস করতেন,মানবাত্মা এ বিশ্বজগতের পূর্বে অন্য এক সদৃশ জগতে ছিল,কোন এক কল্যাণমূলক উদ্দেশ্যে তাকে এখানে এনে বন্দি করা হয়েছে। তাই তাকে এ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে হবে। কিন্তু ইসলাম প্রকৃতি জগতকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না।
এরফান ও সুফীতত্ত্বের ইতিহাস সম্পর্কে অবগতদের জন্য বলছি আমার এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে,সকল আরেফই এ ভুলের মধ্যে ছিলেন বরং প্রসিদ্ধ আরেফগণের মধ্যে অনেকেই অন্ততঃপক্ষে নিজেদের লেখনীতে এ বিষয়ে লক্ষ্য রেখেছেন। তারা সমাজ বা প্রকৃতি কোনটিকেই ত্যাগ করেননি। কোরআন যে অন্তঃবিশ্ব ও বহিঃবিশ্ব দু’টিকেই পাশাপাশি এনেছে এবং দু’ টিকেই স্রষ্টার নিদর্শন ও সৌন্দর্যের প্রতিফলন বলে মনে করে- এ বিষয়ে তাদের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তাদের অন্যতম মরহুম শাবেস্তারী যিনি মহান আরেফ তিনি তার সুন্দর কবিতার মাধ্যমে মানব জগতের এ দিকটি তুলে ধরেছেন। যেমন বলেছেন,
“কর সেই মহান স্রষ্টার গুণকীর্তণ
যিনি দিয়েছেন দীক্ষা তোমায় চিন্তার
আর আপন নূরে করেছেন তোমার হৃদয়ে প্রদীপ সঞ্চার
তব অনুগহে তার দু’জাহান হয়েছে সমুজ্জ্বল
মাটির মানুষ হয়েছে সেথায় পুষ্পভূবন।”
অন্য এক স্থানে প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলছেন,
“যার হৃদয় হয়েছে উজ্জ্বল নূরে খোদার
বিশ্ব জগতেরে দেখে যেন গ্রন্থ তার
বর্ণমালা মূল তার,শাখা কারক চিহ্ন*
নির্দেশনা এ গ্রন্থের পর্যায় বিরাম চিহ্ন।”
(*আরবীতে জবর,যের,পেশ ইত্যাদিকেإعرااب বা কারক চিহ্ন বলা হয়)
আমার এ বিষয়গুলো উপস্থাপনের কারণ হলো আরেফগণ যে কখনো কখনো প্রকৃতির বিষয়ে দৃষ্টি দিয়েছেন তার নমুনা তুলে ধরা। এরূপ জামীর কবিতায় এসেছে-
“তরীকতের পীরের দাওয়াত শরাবের আসরে
সাকী এসো দ্রুত,লোকসান যে তা’ খিরে (দেরীতে)
বিশ্ব আয়নাস্বরূপ যেথা সৌন্দর্যের প্রকাশ খোদার
দেখ এ প্রতিটি আয়নাতে রূপ যে তার।”
যদি আমরা কোরআনকে একদিকে এবং এরফানকে অন্যদিকে রাখি তাহলে দেখব কোরআন প্রকৃতির বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে! আমরা বুঝতে পারব কোরআন প্রকৃতিকে এরফান অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে,অথচ মানুষের অভ্যন্তরীণ সত্তার প্রতি বিশেষ লক্ষ্যদান থেকেও দূরে সরে আসেনি। সুতরাং কোরআনের পূর্ণ মানব বুদ্ধিবৃত্তি ও আন্তরিক প্রবণতার সাথে সমাজ ও প্রকৃতি প্রবণতার দিকেও দৃষ্টি দিয়েছে।
পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই যে,কোরআনের পূর্ণ মানব আকল,হৃদয়,প্রকৃতি ও সমাজকেন্দ্রিক।