সূরা নাহল;(২৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা নাহল;(২৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:50:30 4-10-1403

সূরা নাহল; আয়াত ১০১-১০৩

সূরা নাহলের ১০১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَإِذَا بَدَّلْنَا آَيَةً مَكَانَ آَيَةٍ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يُنَزِّلُ قَالُوا إِنَّمَا أَنْتَ مُفْتَرٍ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

“যখন আমি এক আয়াতকে অন্য আয়াত দ্বারা প্রতিস্থাপিত করি-আল্লাহ্‌ ভালোভাবেই জানেন তিনি (ধাপে ধাপে) কি অবতীর্ণ করেছেন। তখন তারা (অর্থাত কাফিররা) বলে,তুমি তো প্রতারক ছাড়া কিছু নও। (আসলে এমনটি নয়) কিন্তু তাদের বেশিরভাগই (সত্য) বুঝতে অক্ষম।” (১৬:১০১)

আল্লাহ-তায়ালা তার সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু কাজের নির্দেশাবলী ধাপে ধাপে নাজিল করেন। এর অংশ হিসেবেই মদ হারামের নির্দেশ  কয়েক ধাপে নাজিল হয়েছে। আর এ জন্য কিছু বিরুদ্ধবাদী দাবি করতে থাকে, এ আয়াত আল্লাহ্‌ নাযিল করেননি। ইসলামের নবী নিজের পক্ষ থেকে এ সব নির্দেশ দিয়েছেন। এ কারণে যখনই তার মন চায় তখনই তাতে পরিবর্তন আনছেন। এ দাবির জবাবে এ আয়াতে আল্লাহ বলেন:  যখনই নতুন নির্দেশ সম্বলিত নতুন আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন কুরআন বিরোধীরা আল্লাহর এ নিয়মপদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নয় বলে রাসূল (সা.)-এর ওপর অপবাদ দিয়ে থাকে। যদিও আল্লাহ ভালভাবে জানেন, কীভাবে ও কখন কী নির্দেশ দিতে হবে এবং কখন তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় এটাকে আল্লাহর নির্দেশ বা নাসখ বলা হয়। শুধুমাত্র আল্লাহই এ নির্দেশ জারি করতে পারেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

এক. ইসলামে শুধুমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে তার সুচিন্তিত বিচার বিবেচনার আওতায় কিছু নির্দেশে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

দুই. মানুষ আল্লাহর নিয়ম-নীতি সম্পর্কে জানে না বলে  কিছু সন্দেহজনক ও অবান্তর প্রশ্ন করে থাকে।

সূরা নাহলের ১০২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ مِنْ رَبِّكَ بِالْحَقِّ لِيُثَبِّتَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَهُدًى وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ

“(হে রাসূল আপনি তাদের) বলুন : আপনার প্রভুর কাছ থেকে পবিত্র আত্মা (জিবরাইল) সত্যসহ প্রত্যাদেশ নিয়ে এসেছে যাতে মুমিনরা নিজেদের হৃদয়কে অধিকতর দৃঢ় করতে পারে এবং মুসলিমদের জন্য এ প্রত্যাদেশ পথ নির্দেশ ও সুসংবাদ স্বরূপ।” (১৬:১০২)

রাসূল (সা.) নিজের ইচ্ছে মত কুরআনের আয়াতে পরিবর্তন এনেছেন বলে কাফিররা যে অপবাদ দিয়েছিল- আগের আয়াতে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ আয়াতে কাফিরদের সে অপবাদের জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলছেন: তাদের সন্দেহের উত্তরে বলুন, ওহির ফেরেশতা হযরত জিবরাইলের মাধ্যমে কোরানের বাণী আমার কাছে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্য কোনো ধরনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়নি। যদি কোনো নির্দেশে সামান্য পরিবর্তন এসে থাকে তা করা হয়েছে মুমিনদেরকে স্থায়ীভাবে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলতে প্রস্তুত করার জন্য। যাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি তাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করানোর জন্য এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের ঈমান আরো মজবুত করানোর জন্য আল্লাহ তার নির্দেশে সামান্য পরিবর্তন করে থাকেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

এক. কুরআনের বিষয়বস্তু যেমন সঠিক ও সত্য তেমনি রাসূল (সা.)-এর উপর কুরআন নাজিল এবং তার মাধ্যমে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে সর্বোত্তম পন্থায়। কুরআনে যাতে সামান্যতম ভুল-ত্রুটি হতে না পারে সেজন্য এ পদ্ধতি মেনে চলা হয়েছে।

দুই. সব মানুষের ঈমানের স্তর সমান নয়। কিছু লোক শুধুমাত্র মুখে ঈমান এনেছে, আবার কিছু লোকের অন্তরে ঈমান গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে। তবে এ দুই ধরনের মানুষকেই কুরআন হেদায়েত ও সঠিকপথের সন্ধান দেয়।

সূরা নাহলের ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন :

وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّهُمْ يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ لِسَانُ الَّذِي يُلْحِدُونَ إِلَيْهِ أَعْجَمِيٌّ وَهَذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُبِينٌ

“আমরা জানি যে সত্যিই তারা (অর্থাত কাফিররা) বলে: তাকে তো শিক্ষা দেয় একজন মানুষ। তারা যার কথা উল্লেখ করে সে তো আরবিভাষী নয়, অথচ এই (কুরআন) হচ্ছে বিশুদ্ধ আরবি ভাষায়।” (১৬:১০৩)

আগের আয়াতে রাসূল (সা.)-এর ওপর অপবাদ আরোপের কথা উল্লেখের পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, কোনো কোনো কাফির অপবাদ আরোপের ক্ষেত্রে আরও জঘন্য পন্থা বেছে নিত। তারা কুরআনের একটি আয়াতকে নয়, বরং সম্পূর্ণ কুরআনকে অস্বীকার করত। তারা বলত কুরআন মানব রচিত এবং এক ব্যক্তির কাছে থেকে এ কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করে রাসূল নবুওয়াতের দাবি করেছেন।

কাফিরদের এ অভিযোগের জবাবে বলা যায়-

প্রথমত : যে শিক্ষক রাসূলুল্লাহ (সা.)কে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি নিজে কেন নবুওয়াতের দাবি না করে তার ছাত্রকে পয়গম্বর হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন?

দ্বিতীয়ত : কাফেররা যাদেরকে রাসূলুল্লাহর শিক্ষক বলে দাবি করেছিল তারা সবাই ছিলেন অনারব। তাদের কেউই বিশুদ্ধ আরবি জানতেন না। তাই তাদের পক্ষে এমন একটি কুরআন রচনা সম্ভব ছিল না, যাকে শত্রু-মিত্র সবাই মু’জিযা বলে উল্লেখ করেছেন। কুরআনের মু’জিযা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, শত্রুরা কুরআনকে রাসূলের জাদু বলে উল্লেখ করত। তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলত জাদুকর। তাই যখন রাসূল (সা.) কুরআন তেলাওয়াত করতেন তখন তারা মানুষকে কুরআন শুনতে নিষেধ করত, যাতে তারা মুগ্ধ হয়ে মুসলমান না হয়ে যায়।

তৃতীয়ত : যদি কেউ রাসূলের শিক্ষক হয়ে থাকেন তাহলে তিনি কেনো এতদিন নিজের নাম প্রকাশ করেননি যাতে মানুষ তার পরিচয় জানতে পেরে তার ওপর ঈমান আনে।  আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মানুষের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, যদি কারো পক্ষে সম্ভব হয় সে যেন কুরআনের সূরাগুলোর মতো একটি সূরা রচনা করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেনি।

আরেকটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন হচ্ছে, সব  আরব সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করেও যেখানে একটি সূরা রচনা করতে পারেনি সেখানে একজন অনারব কিভাবে রাসূল (সা.)কে পূর্ণাঙ্গ কুরআন শিক্ষা দিলেন?

এ ধরনের বহু প্রশ্নের উত্তর কাফিররা দিতে পারেনি। এমনকি কুরআনের ভাষার  গঠন ও বাচনভঙ্গি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিজস্ব বক্তব্য বা হাদিস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-

এক. ইসলামের শত্রুদের প্রশ্ন ও মন্তব্য সম্পর্কে ধারনা রাখার পাশাপাশি এসব প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব দেয়া উচিত।

দুই. শত্রুদের ব্যাপক অপপ্রচার যেন কুরআনের ওপর আমাদের ঈমানে ঘাটতি আনতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে সঠিক ও যুক্তি সঙ্গত উত্তরের মাধ্যমে দূর করে নিজেদের ঈমান মজবুত রাখতে হবে।