সূরা নাহল; আয়াত ৯৩-৯২
সূরা নাহলের ৯৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ يُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَلَتُسْأَلُنَّ عَمَّا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
“যদি আল্লাহ্ ইচ্ছে করতেন,তবে তিনি তোমাদের এক জাতিতে পরিণত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্তিতে ছেড়ে দেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎ পথে পরিচালিত করেন। তোমারা যা কর, সে বিষয়ে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে।” (১৬:৯৩)
এ আয়াতে সার্বিকভাবে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ জোর করে কাউকে ঈমান আনতে বাধ্য করেননি, বরং আল্লাহ চান বান্দা নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করুক। কিন্তু সব মানুষ এক ধর্ম ও আকিদায় বিশ্বাস করে না বলে তারা একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী নয়। অবশ্য আল্লাহ-তায়ালা হেদায়েতের জন্য সব ধরনের উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। মানুষের প্রকৃতিগত হেদায়েত বা বিবেকের আহ্বান এবং নবী-রাসূলদের পাশাপাশি আসমানি গ্রন্থগুলোর দিক-নির্দেশনা সব মানুষকে মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কিন্তু কেউ যদি পথভ্রষ্ট হতে চায়, আল্লাহ্ তাকে বাধা দেন না। সে ভ্রান্ত পথে চলে যেতে পারে। অন্যদিকে যে সত্য পথে চলতে চায়, আল্লাহ্-তায়ালা তাকে সত্য পথের সন্ধান দেন এবং তাকে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল-সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যান।
অবশ্য এটা পরিষ্কার যে, মানুষকে দেয়া এই ইচ্ছার স্বাধীনতা তাকে জবাবদিহীতা থেকে মুক্তি দেয় না। সে যে পথটি বেছে নেবে সেই পথে চলার জন্য আল্লাহর কাছে তাকে পরকালে জবাবদিহী করতে হবে। কাজেই, মানুষ স্বাধীনভাবে হেদায়েত বা পথভ্রষ্ঠতার মধ্যে যে পথটিই মানুষ বেছে নিক না কেনো সেজন্য তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে এবং সে সাক্ষাতকারের জবাবের উপর ভিত্তি করে তাকে পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
এক. আল্লাহর নীতি হচ্ছে মানুষকে তার কাজেকর্মে স্বাধীনতা দেয়া। মানুষ জীবন চলার পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন। সে ইচ্ছা করলে ভালো ও মন্দকে গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে।
দুই.কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতে মানুষের ছোট-বড় সব কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তার ভিত্তিতে পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে।
সূরা নাহলের ৯৪ ও ৯৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
وَلَا تَتَّخِذُوا أَيْمَانَكُمْ دَخَلًا بَيْنَكُمْ فَتَزِلَّ قَدَمٌ بَعْدَ ثُبُوتِهَا وَتَذُوقُوا السُّوءَ بِمَا صَدَدْتُمْ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَلَكُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (94) وَلَا تَشْتَرُوا بِعَهْدِ اللَّهِ ثَمَنًا قَلِيلًا إِنَّمَا عِنْدَ اللَّهِ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (95(
“পরস্পরকে প্রবঞ্চনা করার উদ্দেশ্যে তোমাদের শপথকে ব্যবহার কর না,যার ফলে,পা স্থিরভাবে প্রোথিত হওয়ার পর তা পিছলিয়ে যাবে এবং আল্লাহ্র পথে (মানুষকে) বাধা দেয়ার জন্য তোমাদের মন্দ কাজের (পরিণতি) ভোগ করতে হবে। এবং তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপাতিত হবে।” (১৬:৯৪)
“আল্লাহ্র সঙ্গে করা অঙ্গীকার স্বল্প মূল্যে বিক্রি কর না, কারণ আল্লাহ্র কাছে যে (পুরস্কার) রয়েছে তা তোমাদের জন্য বহুগুণ উত্তম, যদি তোমরা জানতে।” (১৬:৯৫)
আল্লাহ তায়ালা আগের আয়াতের সঙ্গে মিল রেখে এই আয়াতে আরেকবার শপথের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করেন এবং বলেন, দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের কাজে শপথের মতো পবিত্র বিষয়ের অপব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ, এর ফলে ধর্মের প্রতি মানুষের বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সঠিক পথ হতে সে দূরে সরে যায়। তোমার এ ধরনের ব্যবহারের কারণে যেহেতু মানুষ ধর্ম হতে দূরে সরে গেছে, তার জন্য তুমি দুনিয়াতে নানা সংকটে পড়ার পাশাপাশি আখেরাতেও কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। তাই পার্থিব জীবনের সামান্য বস্তুগত স্বার্থ উদ্ধার ও অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে আল্লাহর নামে শপথ করো না।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
এক. কোনো কোনো গোনাহ বা পাপকাজ আরো বহু পাপের জন্ম দেয়। তাই সে সব পাপকাজকে চিহ্নিত করে তা বিস্তারের পথ রোধ করতে হবে।
দুই. যে কাজই ধর্মের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়, তা ছোট কিংবা বড় হোক কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
সূরা নাহলের ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
مَا عِنْدَكُمْ يَنْفَدُ وَمَا عِنْدَ اللَّهِ بَاقٍ وَلَنَجْزِيَنَّ الَّذِينَ صَبَرُوا أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (96(
“তোমাদের কাছে যা আছে তা অদৃশ্য হয়ে যাবে,কিন্তু আল্লাহ্র কাছে যা আছে তা স্থায়ী। যারা ধৈর্যের সঙ্গে অধ্যবসায়ী হয়, আমি অবশ্যই তারা যা করে তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।” (১৬:৯৬)
দুর্বল ঈমানের অধিকারি যে সব মানুষ দুনিয়ার অর্থ-সম্পদের জন্য ধর্মের পবিত্র বিষয়গুলোকে খেলার পাত্রে পরিণত করে এবং ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বিনিময়ে পরকালের চিরস্থায়ী জীবনকে বিক্রি করে দেয়- এ আয়াতে তাদের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে আল্লাহ বলছেন, অন্যায় কাজের মাধ্যমে তুমি তোমার দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিল করতে পারলেও তুমি কি জানো না, এ জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং তুমি যা অর্জন করেছো তা অচিরেই শেষ হয়ে যাবে? অন্যদিকে যদি কোন ভাল কাজ করে থাক, তাহলে তা আল্লাহর কাছে গচ্ছিত থাকবে এবং তা কখনো ধ্বংস হবে না?
অবশ্য হারামকে বাদ দিয়ে হালালকে গ্রহণ করা কঠিন কাজ, এজন্য ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা প্রয়োজন, যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ-তায়ালা আরো বলেন : যারা হারাম কাজ করা থেকে বিরত থাকে এবং কষ্ট সহ্য করে, তারা সাধারণ পুরস্কার পাবে না, বরং আল্লাহ তাদেরকে অসাধারণ পুরস্কারে ভূষিত করবেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
এক. আল্লাহর নির্দেশ পালনে অটল থাকা এবং হারাম হতে দূরে থাকা কঠিন কাজ, এজন্য কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। অবশ্য এ দুনিয়ার হারাম হতে দূরে থাকলে আখেরাতে সাফল্য পাওয়া যাবে।
দুই. মানুষের জন্য আল্লাহই সর্বোত্তম ক্রেতা। আল্লাহ স্বল্প পণ্যকে সর্বাধিক দামে কিনে নেন এবং মানুষকে সফলতা দান করেন।