সূরা আত তাওবা; (১৩তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আত তাওবা; (১৩তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:45:49 4-10-1403

সূরা আত তাওবা; আয়াত ৫২-৫৫

সূরা আত তাওবার ৫২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ هَلْ تَرَبَّصُونَ بِنَا إِلَّا إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ وَنَحْنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمْ أَنْ يُصِيبَكُمُ اللَّهُ بِعَذَابٍ مِنْ عِنْدِهِ أَوْ بِأَيْدِينَا فَتَرَبَّصُوا إِنَّا مَعَكُمْ مُتَرَبِّصُونَ

“(হে পয়গম্বর! মুনাফিকদের) বলে দিন, তোমরা কি আমাদের জন্য দু’টি কল্যাণের একটি ছাড়া (অর্থাত বিজয় বা শাহাদত ছাড়া) অন্য কিছু প্রত্যাশা কর? কিন্তু আমরা প্রতীক্ষায় আছি যে, আল্লাহ তোমাদেরকে শাস্তি দেবেন সরাসরি নিজ পক্ষ হতে অথবা আমাদেরই হাত দিয়ে। অতএব তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমরাও তোমাদের সঙ্গে প্রতীক্ষায় আছি।” (৯:৫২)

আগের বেশ কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা প্রিয় নবীজী এবং মুমিন মুসলমানদের সঙ্গে কপট মুসলমানদের আচরণের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। মুনাফিকরা যে শুধু জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধই পরিত্যাগ করতো তাই নয়, বরং তারা প্রচার প্রপাগান্ডার মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীর মনোবল দুর্বল করার চেষ্টা করতো। শত্রু পক্ষের শক্তি খুব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে দেখাতো এবং মুসলিম শিবিরের পরাজয়ের খবর শোনার অপেক্ষায় বসে থাকতো। মুনাফিকদের এই মনোবৃত্তির জবাবে এই আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাস্তায় যারা জিহাদ করে তাদের যে কোনো পরিণতিই কল্যাণকর এবং মঙ্গলজনক। কারণ তারা যুদ্ধে বিজয়ী হলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরবর্তী কাজ সমাধার জন্য এগিয়ে যাবে আর যদি তারা যুদ্ধে শহীদ হয় তাহলে তারা শাহাদাতের সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে। কাজেই মুমিন মুসলমানরা সর্বাবস্থায় বিজয়ী, তাদের কোনো পরাজয় নেই। কিন্তু যারা জিহাদ পরিত্যাগ করে বা জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে বেড়ায় তাদের ভাগ্যে ঐশি শাস্তি ছাড়া অন্য কিছু জুটবে না। আল্লাহপাক নিজেই হয়তো তাদেরকে ইহকালে বা পরকালে কঠিন শাস্তি দেবেন। আবার এমন ব্যবস্থাও করতে পারেন যে, মুনাফিকরা ইহকালেই মুসলমানদের হাতে চরম হেনস্তার শিকার হবে এবং কঠিন পরিণতি ভোগ করবে।

এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মুমিন মুসলমানদের কোনো পরাজয় নেই। কারণ মুমিনরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে থাকেন, পরিণতির কথা তারা ভাবেন না। এ ছাড়া, ঈমানদার মুসলমানের কাছে জীবন ও মৃত্যুর কোনো গুরুত্ব নেই। তাদের কাছে সত্যের অনুসরণই গুরুত্বপূর্ণ।

এই সূরার ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ أَنْفِقُوا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا لَنْ يُتَقَبَّلَ مِنْكُمْ إِنَّكُمْ كُنْتُمْ قَوْمًا فَاسِقِينَ

“(যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিবর্তে অর্থ দান করার কথা বলে) তাদেরকে বলে দিন, তোমাদের অর্থ-সাহায্য ইচ্ছাকৃত হোক অথবা অনিচ্ছাকৃত হোক, তোমাদের নিকট থেকে তা গৃহীত হবে না, কারণ তোমরা সত্যত্যাগী নাফরমান সম্প্রদায়।” (৯:৫৩)

তাবুক যুদ্ধ পরিত্যাগকারী মুনাফিকদের অনেকেই অর্থ বা কিছু যুদ্ধ-সামগ্রী দান করে বিজয়ের অংশীদার হতে চেয়েছিল এবং এর মাধ্যমে তারা যুদ্ধ থেকে পলায়নের অজুহাত তৈরি কারার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এই আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের কর্তব্য ছিল যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হওয়া, কিন্তু তোমরা যেহেতু এক্ষেত্রে অবাধ্য হয়েছো তাই তোমাদের সাহায্যও গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ তোমরা দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুযায়ী কাজ করনি।

এখানে লক্ষ্য করার একটি বিষয় হচ্ছে, এই পবিত্র আয়াতে এটাও বলা হয়েছে যে, তোমরা যে সন্তুষ্ট চিত্তে দান করছো তাও স্পষ্ট নয়। হতে পারে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ে তোমরা মন থেকে উতফুল্ল হতে পারনি এবং পরিস্থিতি ও পরিবেশের কারণে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছো।

এই আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, যে কারো কাছ থেকে যে কোনো সাহায্য গ্রহণ করা উচিত নয়। ধর্মীয় এবং যে কোনো পবিত্র কাজ ভালো ও ধার্মিক লোকজনের সাহায্যে সম্পন্ন করা উচিত। আল্লাহর কাছে মানুষের কর্ম তখনি গ্রহণযোগ্য হবে যখন পবিত্র ও পরিশুদ্ধ মনে তা করা হবে। কপটতা বা লোক দেখানোর মানসিকতা নিয়ে যত ভালো কাজই করা হোক না কেন তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।

সূরা তাওবার ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا مَنَعَهُمْ أَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ إِلَّا أَنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَبِرَسُولِهِ وَلَا يَأْتُونَ الصَّلَاةَ إِلَّا وَهُمْ كُسَالَى وَلَا يُنْفِقُونَ إِلَّا وَهُمْ كَارِهُونَ

“তাদের দান কবুল না হওয়ার এ ছাড়া আর কোনো কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে অস্বীকার করে, তারা নামাজে আসে অলসতার সাথে এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে অর্থ সাহায্য করে।”(৯:৫৪)

কপট মুনাফিকদের দান বা সাহায্য কেন গ্রহণযোগ্য নয় সে বিষয়ে ইঙ্গিত করে এই আয়াতে বলা হয়েছে তারা আসলে পরোক্ষ কুফরিতে নিমজ্জিত হয়েছে। আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি তাদের ঈমান নেই। ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের ব্যাপারেও তারা খুব সচেতন বা আন্তরিক নয়। নামাজের ব্যাপারেও তাদের মনোভাব শিথিল।

এই আয়াতের শিক্ষা হচ্ছে, ঈমান ছাড়া আমলের কোনো মূল্য নেই। মানুষের যে কোনো ভালো কাজ হতে হবে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

এই সূরার ৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ

“তাদের সম্পদ ও সন্তানসন্ততি আপনাকে যেন বিমুগ্ধ না করে, আল্লাহর ইচ্ছা হলো এগুলো দ্বারা পার্থিব জীবনে তাদেরকে শাস্তিতে নিপতিত রাখা। কাফের থাকা অবস্থায় তাদের আত্মা দেহ ত্যাগ করবে।” (৯:৫৫)

এই পবিত্র আয়াতে কপট বা মুনাফিক চরিত্রের মানুষদের পার্থিব জীবনের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। পার্থিব জীবনে বাহ্যত: মুনাফিকদের অবস্থা মুমিনদের তুলনায় ভালো হতে পারে। সন্তানসন্ততি ও সম্পদের দিক দিয়ে মুনাফিকদের অবস্থা মুমিনদের চেয়ে উন্নত হলে তাতে বিমুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই। কারণ এসব আসলে মুনাফিকদের মনে প্রশান্তি দিতে পারে না বরং এসবই দুনিয়ার জীবনে মুনাফিকদের জন্য আল্লাহর শাস্তি স্বরূপ মুনাফিকদের দুনিয়া প্রীতি এত প্রবল যে, তারা মৃত্যুর সময়ও আল্লাহর ওপর ঈমান আনার সুযোগ পায় না। কাফের অবস্থায়ই দুনিয়া ত্যাগ করে থাকে। কাজেই তারা এই জগতে কোনো ভালো কাজ করে গেলেও তা বাস্তবে ফলদায়ক হয় না।

আসলে অনেক কিছুই বাহ্যিকভাবে কল্যাণকর মনে হলেও বাস্তবে তা অকল্যাণই বয়ে আনে। সন্তানসন্ততি ও সম্পদ আল্লাহর নেয়াতম হলেও অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব প্রশান্তি ও কল্যাণকর হয়ে ওঠে না।

এই আয়াতের মাধ্যমে এই শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, মৃত্যু মানুষের ধ্বংস নয়। প্রত্যেকের শেষ পরিণতির বিষয়টিই বিবেচনা করা উচিত।