সূরা আ'রাফ; (৩৫তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (৩৫তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:22:37 4-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৫৭-১৫৯

সূরা আ'রাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آَمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

"যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রাসূলের, যিনি উম্মী নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়, যিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; যিনি তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ এবং তাদের উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন ও বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যেসব লোক তার উপর ঈমান আনবে, তাকে সম্মান ও সাহায্য করবে এবং তার সাথে অবতীর্ণ নূরের অনুসরণ করবে, শুধুমাত্র তারাই মুক্তি পাবে।" (৭:১৫৭)

আগের পর্বে বলা হয়েছে, বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের যারা নানা অজুহাতে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়েছিল, মুসা (আ.) তাদের জন্যে দোয়া করেন এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার অনুরোধ জানান। এর জবাবে আল্লাহ বলেন, পৃথিবীর সর্বত্রই আমার রহমত বিদ্যমান, তবে কেবল পবিত্র ও মুমিন বান্দারাই তা থেকে লাভবান হতে পারবে।

এরই ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে মূলত: বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর যুগের ইহুদি তথা আহলে কিতাবদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, ইহুদিসহ আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা সর্বশেষ নবীকে মেনে নিয়ে তাকে অনুসরণ করবে তারাই কেবল মুক্তি পাবে। কারণ তাদের কাছে যে তাওরাত ও ইঞ্জিল রয়েছে, তাতে সর্বশেষ নবী সম্পর্কে বক্তব্য ও নিদর্শন রয়েছে। এমনকি রাসূল (সা.) মানুষকে সত্যের পথে চলার দাওয়াত দিতেন এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার ও ভালো কাজ করার নির্দেশ দিতেন। ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কার তাদেরকে শেকলের মতো আকড়ে ধরে বন্দীতে পরিণত করেছিল, কিন্তু রাসূল (সা.) তাদেরকে সেগুলো ত্যাগ করতে বলতেন এবং বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিতেন। রাসূল (সা.) আরব সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কহীন এক আলাদা পরিবেশে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি কোনো দিন কোনো ক্লাসে বা শিক্ষকের কাছে যাননি। তিনি ছিলেন নিরক্ষর। এরপরও তিনি সর্বোত্তম কথা বলেছেন, সর্বোত্তম পথের দিশা দিয়েছেন। আর এ থেকেই এটা প্রমাণিত হয়, তিনি যা বলতেন তা আল্লাহরই বক্তব্য।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. রাসূল (সা.) এর আগে যত নবী-রাসূল এসেছিলেন, তারা সবাই বিশ্বনবী (সা.) এর আগমনের বার্তাটি দিয়ে গেছেন। এমনকি তারা তাওরাত ও ইঞ্জিল রেখে গেছেন, যাতে বিশ্বনবীর নাম ও নির্দশনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে।

দুই. সমাজ ও দেশে প্রচলিত ভ্রান্ত রীতি-নীতি এবং কুসংস্কার শেকলের মতো মানুষকে বন্দিদশায় নিপতিত করে এবং মানুষকে এমন বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতেই আল্লাহ নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছেন।

তিন. আল্লাহর নবী-রাসূলদের উপর কেবল বিশ্বাস স্থাপন করাই যথেষ্ট নয়। তাদেরকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে এবং তাদের কাজে সহযোগিতা দিতে হবে।

সূরা আ'রাফের ১৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ

"বল, হে মানব সম্প্রদায়! আমি আল্লাহর রাসূল হিসেবে তোমাদের সবার জন্য প্রেরিত হয়েছি। [আল্লাহ্‌] যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই। তিনিই জীবন ও মৃত্যু উভয়ই দান করেন। সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহ্‌র প্রতি ও তার বার্তাবাহক নিরক্ষর নবীর প্রতি, যিনি আল্লাহ ও তার বাণীর প্রতি ঈমান এনেছে। তোমরা তাকে অনুসরণ কর যেন তোমরা সঠিক পথ পাও।" (৭:১৫৮)

ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) গোটা মানব জাতির রাসূল,এ আয়াতে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ আয়াতের মাধ্যমেই বলা হয়েছে, বিশ্বের সব মানুষের জন্য রাসূল হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে পাঠানো হয়েছে। তিনি কেবলমাত্র আরব সম্প্রদায় বা বিশেষ কোন জাতি-গোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি। অন্যান্য নবীদের মত রাসূল (সা.)ও আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছেন। তাকে সেই আল্লাহ পাঠিয়েছেন যিনি সব কিছুর মালিক এবং মানুষের জন্ম ও মৃত্যুও তারই হাতে। তিনি সর্বোত্তমভাবে আল্লাহ এবং তার বাণীর উপর ঈমান রাখেন। সুতরাং সৌভাগ্য ও কল্যাণের অধিকারী হতে চাইলে রাসূল (সা.) দিকনির্দেশনা মেনে চলতে হবে এবং তাকে অনুসরণ করতে হবে ।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের পর অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের দায়িত্ব হচ্ছে, সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে মেনে নেয়া এবং তার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।

দুই. পবিত্র কোরআন অনুসরনের পাশাপাশি আল্লাহর রাসূল(সা.) ও তার আহলে বাইতকেও মেনে চলতে হবে। অন্যথায় সঠিক পথ পাওয়া যাবে না।

সূরা আ'রাফের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمِنْ قَوْمِ مُوسَى أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ

"মূসার সম্প্রদায়ের মধ্যে এক অংশ রয়েছে যারা সত্যপথ নির্দেশ করে এবং সে অনুযায়ী ন্যায় বিচার করে।" (৭:১৫৯)

এ আয়াতে বনি ইসরাইল এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের একটা অংশের প্রশংসা করা হয়েছে। কারণ তারা অন্যদের মতো ছিলো না বরং তারা সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন এবং অন্যদেরকে সত্য পথে আসার দাওয়াত দিতেন। ইহুদিদের মধ্যে হযরত মুসা (আ.) যুগেও এ ধরনের কিছু লোক ছিল এবং তারা মূসা (আ.) এর নির্দেশ মেনে চলতেন। আর তারাই হযরত মুহাম্মদ (সা.) যুগে ইসলাম ধর্মের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈমান এনেছিল। 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. বিরোধী পক্ষের লোকদের বিষয়ে কথা বলার সময়ও ইনসাফের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের খারাপ কাজের সমালোচনার পাশাপাশি ভালো কাজগুলোর প্রশংসা করতে হবে। যেমনিভাবে পবিত্র কোরানে বনি ইসরাইলিদের মধ্যে যারা সত পথে ছিল তাদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের সেই কাজকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

দুই. মানুষকে কেবল সত ও ন্যায়ের পথে চলার পরামর্শ দিলেই চলবে না। নিজেকেও সেই কাজ করতে হবে এবং সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারক হতে হবে।