সূরা আ'রাফ; (৩৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (৩৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 17:45:40 4-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৬৩-১৬৬

সূরা আ'রাফের ১৬৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

 وَاسْأَلْهُمْ عَنِ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ إِذْ يَعْدُونَ فِي السَّبْتِ إِذْ تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهُمْ يَوْمَ سَبْتِهِمْ شُرَّعًا وَيَوْمَ لَا يَسْبِتُونَ لَا تَأْتِيهِمْ كَذَلِكَ نَبْلُوهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ

"আর তাদের কাছে সে জনপদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর যা ছিল নদীর তীরে অবস্থিত। কর্মবিরতির দিন শনিবারের নির্দেশের ব্যাপারে তারা সীমাতিক্রম করেছিল। শনিবার [সমুদ্রের] মাছগুলো প্রকাশ্যে মাথা উঁচু করে তাদের কাছে আসতো, কিন্তু কর্মবিরতির দিন ছাড়া সেগুলো তাদের কাছে আসতো না। এভাবেই আমি তাদের পরীক্ষা নিয়েছিলাম। যেহেতু তারা সীমালংঘন করতো।" (৭:১৬৩)

প্রতি শনিবার ছিল ইহুদি সম্প্রদায়ের কর্মবিরতির দিন। আল্লাহর নির্দেশে ইহুদি সম্প্রদায় সেদিন কাজ করা থেকে বিরত থাকতো এবং ইবাদত-বন্দেগি করতো। অন্যান্য কাজের মতো সেদিন মাছ ধরাও নিষিদ্ধ ছিল। অবশ্য বর্তমানেও ইহুদিদের মধ্যে ওই সংস্কৃতি প্রচলিত আছে।

যাইহোক বনি ইসরাইলের মধ্যে যারা সমুদ্রের তীরে বসবাস করত তারা লক্ষ্য করল যে, প্রতি শনিবার অনেক মাছ সাগরের তীরে তাদের অনেক কাছে চলে আসে কিন্তু অন্য দিনগুলোতে এমনটি ঘটে না। এ কারণে তারা সব সময় সমুদ্রের অনেক গভীরে গিয়ে মাছ ধরতে বাধ্য হতো। সমুদ্রের গভীরে যাওয়া মানেই কষ্টের কাজ। এ অবস্থায় তারা প্রতারণার আশ্রয় নিলো। তারা সমুদ্রের তীরে ছোট ছোট জলাধার তৈরি করলো, যাতে শনিবারে তীরে আসা মাছগুলো সেখানে আটকা পড়ে এবং পরদিন তারা তা ধরতে পারে। তারা এভাবে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল।

পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটা ছিল ওই সম্প্রদায়ের জন্য একটা পরীক্ষা। আল্লাহর নির্দেশেই কর্মবিরতির দিন শনিবার মাছগুলো তীরে আসতো। কিন্তু ইসরাইলি সম্প্রদায় ওই সব মাছ ধরার লোভ সামলাতে পারেনি। শনিবারে তীরে আসা মাছগুলোকে জলাধারে আটকে রেখে পক্ষান্তরে সেগুলোকে সেদিন শিকারই করে নিয়েছিল। এর মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল তারা।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. কোন কাজে ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়া চলবে না এবং এ ধরনের ধোঁকাবাজির পাপের পরিণতি মারাত্মক। কারণ এ ধরনের পাপ কাজ করার পর পাপী ব্যক্তি সেটাকে বৈধ মনে করে এবং তওবা পর্যন্ত করে না।

দুই. আল্লাহ এ পৃথিবীতেও অনেক সময় মানুষকে পরীক্ষা করে থাকে। আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে যেয়ে অনেক সময় হালাল কাজ থেকেও বিরত থাকতে হয়। মাছ ধরা হালাল কাজ। কিন্তু শনিবার সেই কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছিল। কাজেই তাদের সেদিন কোনভাবেই এ কাজ করা উচিত হয়নি।

সূরা আ'রাফের ১৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

"আর যখন তাদের মধ্যে থেকে এক দল লোক অন্য দলকে বলল, কেন তারা ওই সব লোকদের সদুপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দেবেন অথবা কঠোর শাস্তি দেবেন? তারা এর জবাবে বললঃ আমরা এ জন্য এটা করছি যাতে তোমাদের পালনকর্তার সামনে কৈফিয়ত দিতে পারি এবং তারা যেন তাকে (অর্থাত আল্লাহকে) ভয় করে।" (৭:১৬৪)

পবিত্র কুরআনে বনি ইসরাইলের লোকজনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক. যারা প্রকাশ্যে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করছিল। দুই. যারা আল্লাহর বিধান প্রকাশ্যে লঙঘন মেনে নিতে না পেরে মানুষকে অসত কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছিল। তিন- যারা নিজেরা আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করতো না, কিন্তু সমাজে আইন লঙ্ঘন হওয়া দেখেও নীরব থাকতো।

এই আয়াতে বলা হয়েছে, যারা সৎ পথের আদেশ দিতো তাদেরকে উদ্দেশ্য করে নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ন দলটি বলতো, তোমরা শুধু শুধু নিজেদের কষ্ট দিচ্ছ,কারণ তোমাদের কথা তো পাপীদের উপর কোন প্রভাবই ফেলছে না। তাদের ফয়সালা হবে আল্লাহর সঙ্গে এবং আল্লাহ যদি চান তাহলে তাদের কঠোর শাস্তি দেবেন। কিন্তু এর জবাবে সৎ উপদেশ দানকারী দলটি বলতো, প্রথমত: আমাদের কথায় তারা প্রভাবিত হবে না, এমন দাবি সঠিক নয় এবং পাপীরা পাপ কাজ থেকে সরে আসুক আর না আসুক আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। দ্বিতীয়ত: যদি তারা আমাদের উপদেশ নাও শুনে, তাহলেও আমরা আল্লাহর কাছে কৈফিয়ত দিতে পারব এবং এটা বলতে পারবো যে, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. সমাজে কিছু মানুষ আছে,যারা নিজেরা সৎ কাজের উপদেশ দেয় না এবং অন্যরা কাউকে উপদেশ দিক, সেটাও মেনে নিতে পারে না। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নেয়,তাদের বিরোধিতা করে।

দুই. মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেয়া ফরজ দায়িত্ব। যদি অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশে কোন কাজ না হয়, তাতেও ক্ষতি নেই। কারণ মানুষ তার দায়িত্ব পালন করেছে কিনা,সেটাই আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

সূরা আ'রাফের ১৬৫ ও ১৬৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (১৬৫) فَلَمَّا عَتَوْا عَنْ مَا نُهُوا عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ (১৬৬)

"তাদেরকে যেসব বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিলো, যখন তারা তা সম্পূর্ণ ভুলে গেলো, তখন যারা খারাপ কাজে বিরত থাকার আদেশ দিতো, তাদের বাঁচিয়ে দিলাম। কিন্তু অন্যায়কারীদের কঠোর শাস্তি দিলাম। তারা [আল্লাহ্‌র হুকুমের] সীমালংঘন করতো।" (৭:১৬৫)

"তারপর তাদেরকে যে কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছিল, তা যখন তারা অব্যাহত রাখলো, তখন বললাম-লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত বানর হয়ে যাও।" (৭:১৬৬)

এর আগের আয়াতে আমরা বলেছি, আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলের লোকদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিলেন। এখানে বলা হচ্ছে, ওই তিন শ্রেণীর মধ্যে কেবল এক শ্রেণীই আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়েছিল। আর তারা হলো ওই শ্রেণীর লোক, যারা আল্লাহর আদেশ অমান্যকারীদেরকে সৎ পথে আনার চেষ্টা করেছিল। আল্লাহর আদেশ অমান্যকারীদের পাশাপাশি যারা অন্যায়কে মেনে নিয়েছিল, তাদের উপরও আল্লাহর শাস্তি নেমে এসেছিল, কারণ তারা পরোক্ষভাবে অন্যায়ের অংশীদারে পরিণত হয়েছিল। আল্লাহ তাদেরকে বানরে পরিণত করেছিলেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, যারা বানরে পরিণত হয়েছিল, তাদের কারোরই জন্মদানের ক্ষমতা ছিল না এবং এ কারণে তাদের কোন বংশবৃদ্ধি ঘটেনি। তারা অল্প কিছু দিন বেঁচে ছিল এবং এভাবেই তাদের বংশ শেষ হয়ে যায় ।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. অসত কাজের নিষেধ করার মাধ্যমে কেউ যদি সত পথে ফিরে নাও আসে, তারপরও যারা নিষেধ করলো, তারা মুক্তি পায়।

দুই- উপদেশ আদান-প্রদানের পথ বন্ধ করার অর্থ হলো, আল্লাহর শাস্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

তিন. পাপ এবং অন্যায় কাজ দেখে যারা নীরব থাকে,তারাও ওই পাপের অংশীদার হয় এবং শাস্তি ভোগ করে।

চার. তারা যখন আল্লাহর নির্দেশের বিষয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে, তারা নিজেরাই ঠাট্টার পাত্রে পরিণত হয়।