সূরা আ'রাফ; (৩২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (৩২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 6:36:26 4-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৪৭-১৪৯

সূরা আ'রাফের ১৪৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-  

  وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَلِقَاءِ الْآَخِرَةِ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ هَلْ يُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

"যারা আমার নিদর্শন ও পরকালের সাক্ষাতকে অস্বীকার করে তাদের কাজ ব্যর্থ হবে, তারা যেসব কাজ করেছে, সে অনুযায়ী তাদের প্রতিফল দেয়া হবে।" (৭:১৪৭)

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের কাজের ফল বা কাজের মূল্য তার উদ্দেশ্য বা নিয়তের উপর নির্ভরশীল। অমানবিক ও অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে ভালো কাজ করলেও তার  কোনো পুরস্কার তো থাকবেইনা বরং তাকে এ জন্যে শাস্তি বা মন্দ পরিণতি ভোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে অসাধু উদ্দেশ্যের একটি দৃষ্টান্ত হলো রিয়া বা মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কিংবা নিজেকে জাহির করার জন্যে ভালো কাজ করা। এ ধরনের কাজ কখনও কখনও এতো ক্ষতিকর হয় যে তা অন্যান্য ভালো কাজকেও ধ্বংস করে দেয়। এটা হলো সংকট বা সমস্যার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে নিজ জীবনকে বরবাদ করার মত ব্যাপার। এ আয়াতেও মহান আল্লাহ বলছেন: যারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করে এবং পরকাল বা বিচার দিবসকে পরিহাস করে, তারা আসলে তাদের সব কাজই পার্থিব উদ্দেশ্য নিয়ে করেছে; তাই পরকালে তারা থাকবে শূন্য হস্ত। হ্যাঁ, মানুষের কোনো কোনো কাজ তার অন্যান্য কাজের ওপর প্রভাব ফেলে। কোনো কাজের কারণে অন্যান্য কাজ ব্যর্থ হয়ে যাবার অর্থ হলো শাস্তিমূলক ব্যাপার। এটা মহান আল্লাহর ন্যায় বিচারের পরিপন্থী নয়।

এ আয়াত থেকে আমাদের জানা দরকারঃ

এক. পরকাল বা বিচার দিবসের মতো অনিবার্য বাস্তবতা বা মহাসত্যকে যারা অস্বীকার করে তারা তাদের সৎকাজগুলোকে শুধু দুনিয়া বা ইহলোকের মধ্যেই সিমীত করে এবং এসব কাজের প্রভাবগুলোকেও নষ্ট করে ফেলে।

দুই. পরকালের শাস্তি বা পুরস্কার মানুষের কাজের ওপর নির্ভরশীল। অবশ্য যে কাজের মাধ্যমে পরকালীন পুরস্কার আশা করা হয়, তা পারলৌকিক মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত ।

এবারে সূরা আ'রাফের ১৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَاتَّخَذَ قَوْمُ مُوسَى مِنْ بَعْدِهِ مِنْ حُلِيِّهِمْ عِجْلًا جَسَدًا لَهُ خُوَارٌ أَلَمْ يَرَوْا أَنَّهُ لَا يُكَلِّمُهُمْ وَلَا يَهْدِيهِمْ سَبِيلًا اتَّخَذُوهُ وَكَانُوا ظَالِمِينَ

"মূসার জাতি তাঁর অনুপস্থিতিতে নিজেদের অলংকার দিয়ে এক গো-বৎস গড়ে তুললো, তারা এ বাছুরটির পূজা শুরু করলো, বাছুরটি হাম্বা রব করতো । তারা কি দেখে না এ বাছুর তাদের সাথে কথা বলে না এবং তাদেরকে পথও দেখাতে পারে না? তারা একে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে জালেমে পরিণত হয়েছিল।" (৭:১৪৮)

গত আলোচনায় আমরা বলেছিলাম, মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত মূসা (আ.) তাওরাত গ্রন্থ আনার জন্যে তুর পাহাড়ে যান এবং সেখানে তাঁর অবস্থানের মেয়াদ ১০ দিন বাড়ানো হয়; ফলে তিনি সেখানে ৪০ দিন অবস্থান করেন।

বনী ইসরাইল দীর্ঘ অনেক বছর ধরে মিশরে গরু আকৃতির মূর্তিকে পূজা করতে দেখেছে এবং তারা নীল নদ অতিক্রমের সময় মূর্তি পূজারী এক জাতিকে দেখতে পায়। তখন তারা হযরত মূসাকে বললঃ আমাদের জন্যেও ঐরকম মূর্তিগুলোর মতো কিছু খোদা তৈরি করে দিন। হযরত মূসা (আ.) তাদের এ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বা দাবীকে উড়িয়ে দেন এবং একে তাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার ফল বলে মনে করেন। কিন্তু হযরত মূসা (আ.)’র অনুপস্থিতির সূযোগে, বিশেষ করে, তুর পাহাড়ে তাঁর অবস্থানের মেয়াদ ১০ দিন বৃদ্ধির কারণে ঐ পাহাড়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে এমন গুজব জোরদার হয় । এ অবস্থায় সামেরি নামের এক কাফের বা অবিশ্বাসী শিল্পী বনী ইসরাইলের বিভ্রান্ত মানুষের চাহিদার বিষয়টি বুঝতে পেরে মহিলাদের গহনা বা অলংকার সংগ্রহ করে স্বর্ণের গো-বৎস তৈরি করে এবং সে এ বাছুরের পূজা করতে মানুষের প্রতি আহবান জানায়। সামেরি বিশেষ কৌশলের সাথে এমন এক কাজ করে যে তাতে স্বর্ণের ঐ বাছুর থেকে গরুর ডাকের মতো শব্দ শোনা যেত । আর এভাবে সে বহু মানুষের আস্থা অর্জন করে । পবিত্র কুরআনে বাছুরটির শক্তিহীনতা বা অসারতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, স্বর্ণের বাছুরটি দেখতে সুন্দর এবং বাছুরটির কথিত ডাক অনেক মানুষকে আকৃষ্ট করলেও এ পশুটি তো মানুষকে পথ  দেখাতে বা দিক নির্দেশনা দিতে সক্ষম নয় । এটা তো শুধু অর্থহীন কিছু শব্দ করতে সক্ষম। মূসার দেখানো পথ ছেড়ে দেয়া এবং একটা পশুর শব্দের দিকে আকৃষ্ট হওয়া কি নিজের ওপর জুলুম নয়?

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :

এক. সমাজে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত না থাকলে পথভ্রষ্ট লোকেরা অশুভ ও বিভ্রান্ত প্রচারণা সৃষ্টির সুযোগ পায়।

দুই. পথভ্রষ্ট বা বিভ্রান্ত লোকেরা মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্যে শিল্প ও সৌন্দর্য মাধ্যমকে ব্যবহার করে থাকে। পথভ্রষ্ট লোকদের জাঁক জমক বা চাকচিক্যময় চলা ফেরা এবং ব্যাপক ঢাক ঢোল বাজানো প্রচারণায় প্রতারিত হওয়া উচিত নয়।

সূরা আ'রাফের ১৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَمَّا سُقِطَ فِي أَيْدِيهِمْ وَرَأَوْا أَنَّهُمْ قَدْ ضَلُّوا قَالُوا لَئِنْ لَمْ يَرْحَمْنَا رَبُّنَا وَيَغْفِرْ لَنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

"তারা যখন অনুতপ্ত হলো এবং দেখলো যে, তারা বিপথগামী হয়ে গেছে, তখন তারা বললোঃ হে আমাদের প্রতিপালক, যদি আমাদের দয়া না করেন ও আমাদের ক্ষমা না করেন, তাহলে আমরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবই।" (৭:১৪৯)

হযরত মূসা (আ.) তুর পাহাড় থেকে ফিরে এসে পুণরায় তাঁর জাতি অর্থাৎ বনী ইসরাইলকে সুপথ দেখানোর পর তারা অনুতপ্ত হয় এবং তওবা করে। তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ।

হযরত মূসা (আ.) নিজ জাতিকে সুপথে আনার জন্যে মৌখিক উপদেশ দেয়ার পাশাপাশি তাদের এটা বোঝাতে সক্ষম হন যে, খোদা হওয়া তো দূরের কথা, ঐ বাছুরটির কোনো ক্ষমতাই নেই। তিনি ঐ বাছুর-মূর্তিটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। ফলে বনী ইসরাইলের কাছে ঐ মূর্তিটির অক্ষমতা আরো ভালোভাবে প্রকাশ পায় এবং তারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করে। হ্যাঁ, নবী-রাসূলগণ এভাবেই শির্ক ও মূর্তিপূজাসহ সব ধরনের কুফুরি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা বিজয়ের সময় মুশরিকদের ক্ষমা করা সত্ত্বেও তাদের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

এক. শুধু মৌখিক উপদেশ বা সতর্কবাণী উচ্চারণ যথেষ্ট নয়। অধঃপতন বা পথভ্রষ্টতার উপাদান বা মাধ্যমগুলোকেও সমাজ থেকে বিলুপ্ত করতে হবে।

দুই. মহান আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হবার বিষয়টি মানুষের জন্যে প্রকৃত ক্ষতি বা বিপর্যয়ের নামান্তর।