সূরা আ'রাফ; (২১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (২১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 6:54:53 4-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৯৪-৯৬

সূরা আল আ'রাফের ৯৪ ও ৯৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمَا أَرْسَلْنَا فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَبِيٍّ إِلَّا أَخَذْنَا أَهْلَهَا بِالْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ لَعَلَّهُمْ يَضَّرَّعُونَ (৯৪) ثُمَّ بَدَّلْنَا مَكَانَ السَّيِّئَةِ الْحَسَنَةَ حَتَّى عَفَوْا وَقَالُوا قَدْ مَسَّ آَبَاءَنَا الضَّرَّاءُ وَالسَّرَّاءُ فَأَخَذْنَاهُمْ بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ ((৯৫

"যখনই আমি কোন জনপদে কোন নবী পাঠিয়েছি, আমি তার অধিবাসীদের কষ্ট ভোগ ও দুঃখ-দুর্দশায় আক্রান্ত করেছি যেন তারা বিনয়ী বা তওবাকারী হয়।" (৭:৯৪)

"তারপর আমি তাদের দুঃখ-কষ্টকে সৌভাগ্যে পরিবর্তন করে দেই যতদিন না তারা প্রাচুর্যে ও (সন্তান) সংখ্যায় সমৃদ্ধি লাভ করে এবং (অসচেতনভাবে) বলতে শুরু করে : "আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও তো দুঃখ ও সুখ ভোগ করেছে। (এইসব তিক্ত-মধুর ঘটনা আল্লাহর ক্রোধ বা দয়ার নিদর্শন নয়)"। হঠাৎ করে আমি তাদেরকে ধরে বসি ( বা ক্রোধের শিকার করি) , যদিও তারা বুঝতে পারে না [তাদের বিপদ]।" (৭:৯৫)

পবিত্র কুরআনে হযরত হুদ, সালেহ ও শোয়াইব (আ.)'র ঘটনাগুলো তুলে ধরার পর এই আয়াতে মহান আল্লাহ একটি চিরাচরিত খোদায়ী বিধানের দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, আমরা মানুষের কাছে সত্যের দাওয়াত প্রচারের জন্য নবী-রাসূল পাঠানোর পাশাপাশি মানুষের উদাসীনতা দূর করতে ও তাদের মধ্যে সত্যকে মেনে নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে কোনো কোনো কষ্ট ও বিপদ দিয়ে থাকি। পুনরুত্থান দিবস ও মৃত্যুর কথা ভেবে তারা যেন সুপথে আসে এবং তাদের মধ্যে দুনিয়া পুজার মনোভাব কমে যায়-এটাই খোদায়ী এই কৌশলের উদ্দেশ্য। আর এ লক্ষ্যে শারীরিক অসুস্থতা, মৃত্যু ও কখনওবা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি যেমন, ক্ষরা বা বন্যার মাধ্যমে মানুষকে বিপদগ্রস্ত করা হয়।

অবশ্য এ ধরনের বিপদ-আপদ হয় স্বল্পস্থায়ী। মহান আল্লাহ আবার তাদেরকে সুখ-সমৃদ্ধি ফিরিয়ে দেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে একদল মানুষ পুনরায় সম্পদ ও ক্ষমতা পাওয়ার পর পরই আবারও আল্লাহকে ভুলে গিয়ে চরম উদাসীনতায় নিমজ্জিত হয়ে বলে, এইসব তিক্ত ও মধুর ঘটনা তো স্রেফ প্রাকৃতিক ব্যাপার! আর এ ধরনের বাড়াবাড়ির জন্য তাদের ওপর নেমে আসে আল্লাহর শাস্তি, যদিও তারা এই শাস্তির বিষয়টি বুঝতে পারে না।

এই দুই আয়াতের দুটি শিক্ষা হল:

এক. বিভিন্ন সমস্যা ও কঠোরতা মানুষের জন্য কল্যাণকর বিষয়। কারণ, এসব বিষয় মানুষকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

দুই. ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্য অসংযমী মানুষকে বাস্তবতা সম্পর্কে উদাসীন ও খোদাদ্রোহী করে। সব ধরনের সুখ বা আনন্দ আল্লাহর দয়ার নিদর্শন নয়।

সূরা আরাফের ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ((৯৬

"যদি জনপদ বা শহরগুলোর অধিবাসীরা ঈমান আনতো এবং আল্লাহ্‌কে ভয় করতো, আমি অবশ্যই তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর [সকল] কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা [ আমার নিদর্শন বা সত্যকে] প্রত্যাখ্যান করেছিলো। সুতরাং তাদের কু-কর্মের জন্য আমি তাদের [শাস্তির] অন্তর্ভুক্ত করেছি।" (৭:৯৬)

আগের আয়াতে মানুষের উদাসীনতা দূর করার জন্য দুঃখ-বিপদের মাধ্যমে তাদেরকে সচেতন করার খোদায়ী বিধান তুলে ধরার পর এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ব্যাপারটা এমন নয় যে আল্লাহ মানুষকে দুঃখ-বিপদের শিকার করতে ভালবাসেন। বরং মানুষ যদি খোদাভীরু ও ঈমানদার হত এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করত তাহলে আমি তাদের জন্য আসমানী ও পার্থিব বা স্থায়ী ও পবিত্র নিয়ামতগুলোর দরজা খুলে দিতাম। কিন্তু অনেক মানুষ  আল্লাহর অজস্র ও অসংখ্য নিয়ামত ভোগ করা সত্ত্বেও আল্লাহকেই অস্বীকার করে এবং এভাবে খোদায়ী শাস্তি ডেকে আনে।

এখানে অনেকেই বলতে পারেন তাহলে আজ কাফেররা কেন এত ভাল অবস্থায় রয়েছে এবং মুসলমানরা কেন এত দূরবস্থার শিকার? অথচ আল্লাহ বলেছেন, মানুষ যদি খোদাভীরু ও ঈমানদার হত এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করত তাহলে তিনি ঈমানদার মানুষের জন্য আসমানী ও পার্থিব বা স্থায়ী ও পবিত্র নিয়ামতগুলোর দরজা খুলে দিতেন।

এর উত্তর হল, কথিত মুসলিম দেশগুলোর বেশিরভাগ মুসলমানই নামসর্বস্ব মুসলমান মাত্র। এইসব দেশে ইসলামের বিধান উপেক্ষিত ও অবহেলিত হচ্ছে। অন্যদিকে কাফির অধ্যুষিত দেশগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা সংকটে জর্জরিত। পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া ও মানবীয় সহানুভূতির অভাব পশ্চিমা দেশগুলোর অন্যতম প্রধান সংকট। ফলে এইসব দেশে বহু মানুষ নানা ধরনের মানসিক রোগের শিকার।

পবিত্র কুরআনের সূরা আন'আমের ৪৪ নম্বর আয়াতে ক্ষণস্থায়ী ও বরকতহীন কিছু নেয়ামতের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে:  "এরপর তারা যখন ঐ উপদেশ ভুলে গেল, যা তাদেরকে দেয়া হয়েছিল, তখন আমি তাদের সামনে সব কিছুর দরজা খুলে দিলাম। এমনকি, যখন তাদেরকে প্রদত্ত বিষয়াদির জন্যে তারা খুব গর্বিত হয়ে পড়ল, তখন আমি হঠাত তাদেরকে পাকড়াও করলাম। তখন তারা নিরাশ হয়ে গেল।

উল্লেখ্য, মুমিনদের জন্যই বরকত নাজিল হয়, কাফিরদের জন্য তা নাজিল হয় না। বরকত বলতে স্থায়ী নিয়ামত ও বিপদ-মুসিবতবিহীন নিয়ামতকে বোঝায়। যেমন, আয়ু, সম্পদ ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে বরকত ইত্যাদি।

ইসলামী বর্ণনায় এসেছে, শেষ যুগে যখন ইমাম মাহদী (আ.)'র পুনরাবির্ভাব ঘটবে তখন আকাশ ও জমিন মানুষের জন্য বরকতে পরিপূর্ণ হবে। কারণ, তাঁর শাসনামলে বিশ্ব থেকে জুলুম ও অনাচার বিদায় নেবে এবং সমাজে পুরোপুরি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

এই আয়াত ক'টির শিক্ষা হল:

এক. উপভোগের সব কিছুই সমান নয়। মুমিনদের যেসব নিয়ামত দেয়া হয় সেগুলো স্থায়ী ও বরকতে পরিপূর্ণ এবং অশেষ বরকতের আধার। এইসব নিয়ামত আল্লাহর দয়ার নিদর্শন। অন্যদিকে কাফিরদের যেসব ভোগের সামগ্রী দেয়া হয় সেগুলো ক্ষণস্থায়ী, অশুভ ও খোদায়ী ক্রোধের নিদর্শন।

দুই. সমাজে বরকত নাজিল হওয়ার জন্য কেবল ব্যক্তিগত ঈমান ও খোদাভীরুতাই যথেষ্ট নয়। এ জন্য সমাজের বেশিরভাগ মানুষকেই খোদাভীরু হতে হবে।

তিন.সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করা হলে তা নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুফলও বয়ে আনে। এ ধরনের বিনিয়োগে সমাজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে এবং অর্থনৈতিক দুর্নীতি ঠেকানো সম্ভব হয়।