সূরা আ'রাফ; (৬ষ্ঠ পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (৬ষ্ঠ পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 5:14:15 4-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ২৪-২৭

সূরা আরাফের ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قَالَ اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَى حِينٍ (24) قَالَ فِيهَا تَحْيَوْنَ وَفِيهَا تَمُوتُونَ وَمِنْهَا تُخْرَجُونَ (25(

"আল্লাহ (আদম-হাওয়া ও শয়তানকে) বললেনঃ তোমরা নেমে যাও। তোমরা এক অপরের শত্রু। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তোমাদের জন্যে পৃথিবীতে বাসস্থান এবং জীবন যাপনের সামগ্রী রয়েছে।" (৭:২৪)

"আল্লাহ বললেনঃ তোমরা সেখানেই জীবন যাপন করবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান থেকেই আবার তোমাদের বের করা হবে।" (৭:২৫)

আল্লাহ আদম-হাওয়া (আ.)'র তওবা ও অনুশোচনা কবুল করা সত্ত্বেও আল্লাহর উপদেশ অমান্য করার প্রভাব থেকেই গেছে। ওই নিষিদ্ধ গাছ থেকে খাওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর উপদেশ অমান্য করার কারণে বেহেশতী উদ্যান থেকে বহিষ্কৃত হতে হয় তাঁদেরকে এবং নেমে আসতে হয়েছে পৃথিবীতে। তাই এই দুই আয়াতের প্রথমে আল্লাহ বলছেন, আদম-হাওয়াকে বেহেশত থেকে বের হয়ে পৃথিবীতে থাকার নির্দেশ দিয়েছি এবং বলেছি যে, এটাই তোমাদের থাকার স্থান। আদম-হাওয়া এবং শয়তান যে পরস্পরের শত্রু তাও উল্লেখ করা হয়েছে এই আয়াতে। এ থেকে বোঝা যায় পৃথিবীর জীবনে মানুষ পরস্পর শত্রুতা ও প্রতিহিংসার শিকার হবে। আল্লাহ পরের আয়াতে আদম-হাওয়া (আ.)-কে বলছেন, তোমরা পৃথিবীতেই জীবন যাপন করবে ও সেখানেই মারা যাবে এবং এরপর পৃথিবীতে যা কিছু করেছ তার হিসাব নেয়া হবে পুনরুত্থান বা বিচার দিবসে।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. বাবা-মায়ের ভুলের জন্য সন্তানদেরকেও দুঃখময় পরিণতি ভোগ করতে হয়।

দুই. এই পৃথিবী নানা স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব, শত্রুতা ও হানাহানির স্থান। স্বার্থ ও কুপ্রবৃত্তি এসব দ্বন্দ্বের মূল চালিকা শক্তি।

সূরা আরাফের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا بَنِي آَدَمَ قَدْ أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآَتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَى ذَلِكَ خَيْرٌ ذَلِكَ مِنْ آَيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ

"হে বনী-আদম আমি তোমাদের জন্যে পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং বেশভূষার মাধ্যম। (এ ছাড়াও) আত্মসংযম বা পরহেযগারীর পোশাকও রয়েছে, (আর সব পোশাকের মধ্যে) তা সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।" (৭:২৬)

আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছি, নিষিদ্ধ গাছের স্বাদ নেয়ায় আদম-হাওয়া সর্ব প্রথম যে বিপদের শিকার হন তা হল তাদের লজ্জার স্থানগুলো বা পরস্পরের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। ফলে তারা গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের ঢাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, আমি হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-কে পৃথিবীতে পাঠানোর পর তাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি। পশুর চামড়া ও পশম দিয়ে একদিকে যেমন সবচেয়ে ভাল পোশাক তৈরি হয় তেম্নি তা সৌন্দের্য্যের বা সাজ-সজ্জারও ভাল উপকরণ। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এইসব পোশাক ব্যবহার করে আসছে। আজও পশম ও চামড়ার পোশাক সবচেয়ে ভাল পোশাক হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে। তাই আল্লাহ এই আয়াতে বলছেন, শরীর ঢাকার পোশাক বস্তুগত পোশাক। কিন্তু এর চেয়েও ভাল পোশাক হল আত্মসংযম বা তাকওয়ার পোশাক। এই পোশাক মানুষকে অশ্লীলতা ও অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করে। এই পোশাক মানুষকে সচ্চরিত্রবান রাখে ও লজ্জাশীল রাখে। তাকওয়া বা আত্মসংযমের পোশাক মানুষকে আধ্যাত্মিক মুক্তি যোগায়।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখতে হবে:

এক. শয়তান মানুষের মধ্যে নগ্নতার প্রসার ঘটাতে চায়। অন্যদিকে আল্লাহ মানুষের জন্য নানা ধরনের পোশাকের উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন।

দুই. পোশাকের সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জা আল্লাহর পছন্দনীয় এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয়। এ ধরনের সাজ-সজ্জার ব্যবহার যতক্ষণ না হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়ের সীমানা স্পর্শ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ।

তিন. মানুষের পোশাক তৈরি করা হয় তুলা, পশম বা চামড়া দিয়ে। এসবই হল আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও আল্লাহরই সৃষ্টি। তাই এসবের প্রতি লক্ষ্য করলে বা এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং উদাসীনতা দূর হবে।

 

সূরা আরাফের ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا بَنِي آَدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآَتِهِمَا إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ

"হে আদম-সন্তানরা! (সাবধান!) শয়তান যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় যেমনিভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে, সে তাদের উভয়ের গোপনাঙ্গ দেখানোর জন্য তাদের পোশাক হরণ করেছে । সে এবং তার দলবল তোমাদেরকে এমন স্থান থেকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাও না। নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে না আমরা শয়তানদেরকে তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি ।" (৭:২৭)

শয়তান কেবল আদম ও হাওয়া (আ.)-র শত্রু ছিল না, তাদের সঙ্গে শত্রুতা করে সে গোটা মানব জাতির সঙ্গেই শত্রুতার বুনিয়াদ গড়ে তুলেছে। তাই আল্লাহ এ আয়াতে আদম-সন্তানদের সতর্ক করার জন্য বলছেন, তোমরাও যেন আদম ও হাওয়া (আ.)-র মত শয়তানের ধোঁকার শিকার না হও। শয়তানের ধোঁকার ফলে তাঁদের পোশাক খসে পড়েছিল, ফলে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল অশোভনীয়তা। শয়তান ও তার দলবল এমনই যে তারা তোমাদেরকে দেখতে পারে, অথচ তোমরা তাদের দেখতে পাও না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তোমাদের ওপর কর্তৃত্বশীল নয়, অর্থাৎ তারা তোমাদের দিয়ে নিষিদ্ধ কাজ করাতে বা পাপাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করতে পারে না। তারা কেবলই কুমন্ত্রণা দেয়ার ক্ষমতা রাখে। আর কেবল তারাই শয়তানের কুমন্ত্রণা অনুযায়ী কাজ করে যারা আল্লাহ ও পরকালের বিচার দিবসের ওপর ঈমান রাখে না।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. আমরা সব সময়ই শয়তানের ফাঁদের সম্মুখীন। আমরা যেন কখনও নিজেদের বিচ্যুতির আশঙ্কামুক্ত মনে না করি। ফেরেশতাদের সিজদা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও হযরত আদম (আ.) শয়তানের ধোঁকার শিকার হয়ে বেহশত হতে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।

দুই. নগ্নতা ও পর্দা খুলে ফেলা খোদার দরবার থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার চালিকা শক্তি। যেসব কর্মসূচি নগ্নতা ছড়িয়ে দেয় তা শয়তানেরই কর্মসূচি।

তিন. শয়তানের বহু অনুসার রয়েছে জিন ও মানুষের মধ্যে। তাই শয়তানকে একাকী মনে করা ঠিক হবে না।