সূরা আ'রাফ; (১৬তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (১৬তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 5:1:51 4-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৭২-৭৬

সূরা আল আ'রাফের ৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَأَنْجَيْنَاهُ وَالَّذِينَ مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَمَا كَانُوا مُؤْمِنِينَ ((৭২

"অবশেষে আমরা তাঁকে (হুদ-আ.) ও তাঁর সঙ্গীদেরকে নিজ অনুগ্রহে পরিত্রাণ দিলাম এবং যারা আমার আয়াতগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তাদের মূলোচ্ছে করে দিলাম, আর তারা বিশ্বাস স্থাপনকারী ছিল না।" (৭:৭২)

আদ জাতি হযরত হুদ (আ.)'র দাওয়াত তো গ্রহণ করেইনি বরং মহাঔদ্ধত্য দেখিয়ে ও বিদ্রুপ করে বলেছিল, বিচার দিবস বা কিয়ামতের শাস্তি সম্পর্কে তোমার কথা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এই পৃথিবীতেই সেই শাস্তি নিয়ে আস যাতে আমরা তা দেখতে পারি!

এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহও ওই দুর্বিনীত ও গোড়া জাতিকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। একটানা সাত দিন ধরে তাদের ওপর ধ্বংসাত্মক ঝড়-তুফান প্রবাহিত হয়েছিল। ফলে তাদের লাশগুলো খেজুর গাছের মত মাটিতে পড়ে থাকে। অবশ্য হযরত হুদ (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদেরকে ওই কঠোর শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন এবং তাদের প্রতি মহাঅনুগ্রহ করেছিলেন মহান আল্লাহ। কারণ, হুদ (আ.)'র সঙ্গীরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল।

এই আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:

এক. আল্লাহ ন্যায়বিচারক। তাই তিনি শাস্তি দেয়ার সময় কেবল কাফিরদেরই শাস্তি দেন ও মুমিনদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করেন।

দুই. ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। আল্লাহ ও তাঁর ওলিদের মোকাবেলায় নামার অর্থ হল, নিজের ধ্বংস ডেকে আনা।

সূরা আল আ'রাফের ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ هَذِهِ نَاقَةُ اللَّهِ لَكُمْ آَيَةً فَذَرُوهَا تَأْكُلْ فِي أَرْضِ اللَّهِ وَلَا تَمَسُّوهَا بِسُوءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ((৭৩

"এবং আমরা সামুদ জাতির কাছে তাদের ভাই সালেহকে (পাঠিয়েছিলাম )। সে (তাদের) বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ বা মোজেজা এসে গেছে। এটি আল্লাহর উষ্ট্রী তোমাদের জন্যে এক (অলৌকিক) নিদর্শন। তাই একে আল্লাহর জমিনে যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করে খেতে দাও ছেড়ে দাও। একে কোনোভাবে কষ্ট দিও না। অন্যথায় তোমরা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি শিকার হবে।" (৭:৭৩)

আদ জাতির ঘটনা বর্ণনার পর এ আয়াতে সামুদ জাতির কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ হযরত সালেহ (আ.)-কে সামুদ জাতির মধ্য থেকে নবী হিসেবে মনোনয়ন করেছিলেন। অন্য নবী-রাসূলদের মত তিনিও নিজ জাতিকে এক আল্লাহর ইবাদতের ও মূর্তি পূজা না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই জাতির লোকেরা মোজেজা বা খোদায়ী নিদর্শন দেখতে চাইলে আল্লাহর ইচ্ছায় পাথরের পাহাড়ের মধ্য থেকে একটি উষ্ট্রী বের হয়ে আসে। ওই উষ্ট্রী একটি শাবকও জন্ম দেয় । এ ছাড়াও তার দুধ গোটা সামুদ জাতির দুধের চাহিদা মেটাত। হযরত সালেহ (আ.) এই উষ্ট্রীর কোনো ক্ষতি না করতে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন, এই পশুটির কোন ক্ষতি করলে তোমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসবে।

এ আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:

এক. জনগণের সঙ্গে নবী-রাসূলদের সম্পর্ক ছিল ভ্রাতৃসুলভ এবং তাঁরা জনগণের কাতারে থেকেই জনগণের সঙ্গে কথা বলতেন ও তাদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতেন। নিজেদেরকে জনগণের চেয়ে বড় মনে করতেন না তাঁরা।

দুই. যা কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো হয় তা পবিত্র, এমনকি তা যদি একটি উষ্ট্রীও হয়ে থাকে। এ ধরনের খোদায়ী নিদর্শনের অবমাননার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই ধর্মীয় পবিত্রতাগুলোকে সম্মান জানাতে হবে।

সূরা আল আ'রাফের ৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ عَادٍ وَبَوَّأَكُمْ فِي الْأَرْضِ تَتَّخِذُونَ مِنْ سُهُولِهَا قُصُورًا وَتَنْحِتُونَ الْجِبَالَ بُيُوتًا فَاذْكُرُوا آَلَاءَ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ ((৭৪

"এবং তোমরা স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদেরকে আদ জাতির পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন; তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এমনভাবে যে তোমরা সমতল ভূমিতে অট্টালিকা নির্মাণ করতে এবং পাহাড় কেটে বাসভবন নির্মাণ করতে। অতএব আল্লাহর নিয়ামতগুলোকে স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না।" (৭:৭৪)

হযরত সালেহ (আ.) সামুদ জাতিকে এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আদ জাতির পরিণতি তোমাদের জন্য শিক্ষা হওয়া উচিত। সত্যের প্রতি দুর্বিনীত আচরণ ও খোদাদ্রোহীতার কারণে তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ তোমরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ওই একই পথের অনুসারী হয়ো না। আল্লাহর নেয়ামতগুলোর গুরুত্ব বোঝা উচিত এবং জমিনে অশান্তি সৃষ্টি করো না। আল্লাহই তোমাদের শক্তি, উপায়-উপকরণ ও যোগ্যতা দান করায় তোমরা সমতলে এবং পাহাড়ে ঘর-বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে পারছ।

এ আয়াতের দুটি শিক্ষা হল:

এক. অতীতের জাতিগুলোর ইতিহাস ভবিষ্যতের জাতিগুলোর জন্য পথ চলার মশাল বা বাতি। তাই সব সময়ই ইতিহাস পর্যালোচনা করা ও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।

দুই. যারা অপেক্ষাকৃত বেশি ধন-সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারি তাদের উচিত আল্লাহকে বেশি স্মরণ করা, যাতে তারা অনাচার বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে না পড়ে।

সূরা আল আ'রাফের ৭৫ ও ৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِمَنْ آَمَنَ مِنْهُمْ أَتَعْلَمُونَ أَنَّ صَالِحًا مُرْسَلٌ مِنْ رَبِّهِ قَالُوا إِنَّا بِمَا أُرْسِلَ بِهِ مُؤْمِنُونَ (৭৫) قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا بِالَّذِي آَمَنْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ ((৭৬

"(তখন) তাঁর জাতির দাম্ভিক সর্দাররা দুর্বল ও (অসহায় বলে বিবেচিত) ঈমানদারদের জিজ্ঞেস করলঃ তোমরা কি নিশ্চিতভাবে জান যে সালেহ তাঁর পালনকর্তার পক্ষ হতে রাসূল? তারা বলল, নিশ্চয়ই আমরা তো তাঁর আনীত বার্তার প্রতি বিশ্বাসী।" (৭:৭৫)

"তখন ওই দাম্ভিকরা বললঃ নিশ্চয়ই তোমরা যে বিষয়ে ঈমান এনেছ, আমরা তা অস্বীকার করছি।" (৭:৭৬)

হযরত সালেহ (আ.)'র হুঁশিয়ারি ও সতর্কবাণী সত্ত্বেও সামুদ জাতির অভিজাত শ্রেণী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যখন দেখল ঐশী শিক্ষা বা নির্দেশনা তাদের স্বার্থের অনুকূল নয় তখন তারা এই মহান নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। এ ছাড়াও তারা মুমিনদের মনে সন্দেহ সৃষ্টির জন্য বলে, সালেহ যে আল্লাহর নবী ও তাঁর কথা যে আল্লাহর বাণী তা তোমরা কিভাবে নিশ্চিত হলে? কিন্তু এই বিষাক্ত প্রচারণা মুমিনদের অবিচল ঈমানে কোনো ফাটল ধরাতে পারেনি। তারা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, সালেহ (আ.)'র রেসালাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে আমাদের এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে তিনি আল্লাহর যে নিদর্শন আমাদের দেখিয়েছেন তাতে সন্দেহের আর কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু দাম্ভিক ও অবিশ্বাসীরা সাফ বলে দিল, তোমরা যেসবে বিশ্বাস করছ আমরা তা অস্বীকার করছি।

এ আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:

এক. যুগে যুগে সাধারণত ক্ষমতাধর, সম্পদশালী ও অভিজাত শ্রেণীর মানুষই নবী-রাসূল এবং তাঁদের দাওয়াতের বিরোধিতা করেছে।

দুই. দারিদ্র ও বঞ্চনা মূল্যবোধের বিষয় নয়, আবার ধন-সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্যও মূল্যবোধ বিরোধী বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঈমান ও খোদাভীতি। এ আয়াতে সব দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রশংসা করা হয়নি। বরং ঈমানদার দরিদ্র ও মজলুম ব্যক্তিদের প্রশংসা করা হয়েছে।

তিন. কুফরির মূল উতস হল অহংকার ও নিজেকে বড় ভাবার প্রবণতা এবং দম্ভ ও বড় কিছু হওয়ার বাসনা।