সূরা আ'রাফ; (৯ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (৯ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 5:7:49 4-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৩৪-৩৮

সূরা আরাফের ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ

"প্রত্যেক জাতির একটি মেয়াদ বা নির্ধারিত সময় রয়েছে। যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে, তখন তারা না এক মুহূর্ত দেরি করতে পারবে, আর না এগিয়ে আনতে পারবে।" (৭:৩৪)

মৃত্যুর প্রতি সাধারণ মানুষ উদাসীন। কেবল মানুষেরই যে মৃত্যু ঘটে তা নয়, এমনকি অনেক বড় বড় সাম্রাজ্য ও সভ্যতাও বিলীন হয়ে গেছে চিরতরে। পবিত্র কুরআনের এই আয়াতসহ অন্য কিছু আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী যুগে যুগে অনেক সভ্যতা ও সাম্রাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু জুলুম-অত্যাচার ও লাগামহীন ভোগ-বিলাসের কারণে সেইসব সভ্যতার সূর্য অস্তমিত হয়েছে। ক্ষমতা ও সম্পদের মালিকরা সাধারণত মনে করে যে তাদের সম্পদ এবং ক্ষমতাও অক্ষয়। কিন্তু এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তিনি যখন চাইবেন তখনই কোনো জাতি বা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে, এক মুহূর্তও দেরি হবে না।

এ আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:

এক. সুযোগ-সুবিধা ও এসবের উপকরণ সব সময় থাকে না। এক সময় শেষ হয়ে যায়। তাই যথাসময়ে সুযোগ-সুবিধাগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা উচিত।

দুই. পাপী ও জালেমদের এটা ভাবা উচিত যে, তাদেরকে শাস্তি দিতে দেরি করার মাধ্যমে আল্লাহ তাদের অনুগ্রহ করছেন যাতে বিচারের আগেই তওবা ও অনুশোচনার সুযোগ নেয়া যায়।

সূরা আরাফের ৩৫ ও ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا بَنِي آَدَمَ إِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آَيَاتِي فَمَنِ اتَّقَى وَأَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (৩৫) وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ((৩৬

"হে আদম-সন্তানরা! যখনই তোমাদের মধ্য হতে রাসূলগণ তোমাদের কাছে আসবেন এবং আমার নির্দেশসমূহ শোনাবেন, তখন (তাদের অনুসরণ করবে, আর) যারা সাবধানতা অবলম্বন করবে ও নিজেদের সংশোধন করবে তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না।" (৩৫)

"আর যারা আমার আয়াত বা নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং দাম্ভিকতায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তারাই দোযখী এবং তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।" (৩৬)

এই আয়াতে ঐশী হেদায়াত মানা বা না মানার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে মতভেদ সম্পর্কে বলা হয়েছে: আল্লাহ সব সময় মানুষের মধ্য থেকেই তাদের কাছে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। আর তাঁরা মানুষকে সৎ কাজ ও ধার্মিকতার দিকে আহ্বান করেন। কিন্তু মানুষের মধ্যে যারা খোদাভীরু ও সংযমী কেবল তারাই ইহকাল ও পরকালে সৌভাগ্য অর্জন করবেন। আল্লাহর সঙ্গে লেনদেনের কারণে তাদের কোনো দুঃখ, অনুশোচনা ও এমনকি ভয়ও থাকবে না। কারণ, যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা একদিকে যেমন মানুষের অন্তঃসারশূন্য শক্তি বা ক্ষমতাগুলোকে ভয় পান না, তেমনি জাহান্নামের আগুনকেও তারা ভয় পান না।

অন্যদিকে একদল মানুষ গোঁড়ামির কারণে নবী-রাসূলদের দাওয়াত অস্বীকার করে এমনকি তাঁদের দাওয়াতকে মিথ্যা বলে অপবাদ দেয় যাতে এ পৃথিবীতে ঝামেলামুক্ত জীবন যাপন করা যায়। আসলে এ ধরনের মানুষ দুনিয়ার অস্থায়ী সুখের জন্য পরকালের চিরস্থায়ী সুখ বিসর্জন দেয় এবং পরকালে জাহান্নামই হবে তাদের চিরস্থায়ী আবাস।

এ দুই আয়াতের শিক্ষা হল:

এক. খোদাভীরুতা অর্জনের জন্য ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনের চেষ্টা জরুরি। ঘরকুণো হওয়া বা সমাজ-সংসার থেকে দূরে থাকা খোদাভীরুতা অর্জনের পথ নয়।

দুই. প্রকৃত প্রশান্তি অর্জিত হয় পবিত্রতা ও সৎ কাজের মাধ্যমে এবং এর ফলে দুঃখ-বেদনা ও ভয় দূর হয়ে যায়।

সূরা আরাফের ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِآَيَاتِهِ أُولَئِكَ يَنَالُهُمْ نَصِيبُهُمْ مِنَ الْكِتَابِ حَتَّى إِذَا جَاءَتْهُمْ رُسُلُنَا يَتَوَفَّوْنَهُمْ قَالُوا أَيْنَ مَا كُنْتُمْ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ قَالُوا ضَلُّوا عَنَّا وَشَهِدُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَنَّهُمْ كَانُوا كَافِرِينَ

"ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় অবিচারক কে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা তার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে? তারা (দুনিয়ায়) তাদের নির্ধারিত অংশ থেকে পেতে থাকবে যা (ঐশী) গ্রন্থে (তাদের জন্য লেখা হয়েছে) যতক্ষণ না আমাদের পাঠানো ফেরশতারা তাদের কাছে গিয়ে তাদের প্রাণ পুরোপুরি গ্রহণ করছে। তারা তাদের জিজ্ঞেস করবে: 'তারা কোথায় গেল, আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তোমরা ডাকতে?' তারা উত্তর দেবেঃ আমাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেছে, তারা নিজেদের সম্পর্কে স্বীকার করবে যে, তারা অবশ্যই অবিশ্বাসী ছিল।" (৩৭)

এখানে বলা হচ্ছে, কাফিররা নবী-রাসূলদের মিথ্যাবাদী বলছে। কিন্তু আসলে তারাই মিথ্যাবাদী। কারণ, তারা সত্যকে বোঝার পরও তা অস্বীকার করেছে। অবশ্য এ ধরনের মানুষ দুনিয়ার নেয়ামত বা জীবন-যাপনের উপকরণগুলো থেকে বঞ্চিত হয় না এবং পৃথিবীতে তাদের রুটি-রোজগারও কমে না। কিন্তু মৃত্যুর সময় প্রাণ হরণকারী ফেরেশতাদের প্রশ্নের জবাবে তারা তাদের পথভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির কথা স্বীকার করবে। তারা বলবে: আমরা আল্লাহর নেয়ামতগুলোর ব্যাপারে অকৃতজ্ঞ থেকেছি ও আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা বলতাম।

এই আয়াতের শিক্ষা হল:

এক. যারা সত্যকে অস্বীকার করে তারা নিজের ওপরই জুলুম করে যা সবচেয়ে বড় জুলুম।

দুই. এ পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের জন্যই সুনির্দিষ্ট ভাগ্য ও ভোগের ব্যবস্থা রয়েছে। আর আল্লাহই তা নির্ধারণ করেছেন।

তিন. বিচার দিবসে বিবেকই হবে মানুষের প্রথম বিচারক যা সেদিন মানুষের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দেবে।

সূরা আরাফের ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ ادْخُلُوا فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ فِي النَّارِ كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَعَنَتْ أُخْتَهَا حَتَّى إِذَا ادَّارَكُوا فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَاهُمْ لِأُولَاهُمْ رَبَّنَا هَؤُلَاءِ أَضَلُّونَا فَآَتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِنَ النَّارِ قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَكِنْ لَا تَعْلَمُونَ ((৩৮

"(মৃত্যুর সময় কুফরির কথা স্বীকারকারীদেরকে) আল্লাহ বলবেনঃ 'তোমাদের আগে জিন ও মানবের যেসব জাতি চলে গেছে, তাদের সাথে তোমরাও দোযখে যাও।' (অবস্থা এমন হবে) যখনই এক দল তাতে প্রবেশ করবে; তখন তাদের সঙ্গী অন্য দলকে তারা অভিসম্পাত করবে। এমনকি, যখন তাতে সবাই পতিত হবে, তখন পরবর্তীরা (বা অনুসারীরা) পূর্ববর্তীদের (বা অনুসৃতদের) সম্পর্কে বলবেঃ 'হে আমাদের প্রতিপালক এরাই আমাদেরকে বিপথগামী করেছিল। অতএব, আপনি তাদেরকে জাহান্নামের দ্বিগুণ শাস্তি দিন।' আল্লাহ বলবেন, 'প্রত্যেকের জন্যই দ্বিগুণ শাস্তি রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না'।" (৩৮)

জিন ও মানুষের মধ্য থেকে কাফির দলগুলো একে একে দোযখে প্রবেশের পর প্রত্যেক দলই অপর দলকে অভিসম্পাত দেবে। উত্তরসূরি দলগুলো পূর্বসূরি দলগুলোকে বলবে: তোমাদের কারণেই আমরা বিভ্রান্ত হয়েছি, তাই তোমাদের দ্বিগুণ শাস্তি পেতে হবে। কারণ, তোমরা নিজেরাও বিভ্রান্ত ছিলে ও অন্যদেরও বিভ্রান্ত করেছ। কিন্তু আল্লাহ বলছেন পরবর্তীদেরকেও দ্বিগুণ শাস্তি পেতে হবে। কারণ, প্রথমতঃ তারাও গুনাহ করেছে। দ্বিতীয়তঃ তারা পূর্ববর্তীদের শাস্তি দেখেও তা থেকে শিক্ষা নেয়নি।

এ আয়াতের শিক্ষা হল:

এক. বেহেশত শান্তি ও পবিত্রতায় ভরপূর। জাহান্নাম অভিশাপ ও ঘৃণার স্থান। বেহশতবাসীদের বন্ধুরা খাঁটি ও স্থায়ী বন্ধু। কিন্তু দোযখীরা (পৃথিবীতে) পরস্পরের সামনাসামনি বন্ধু হলেও পেছনে (ও পরকালে) একে-অপরকে অভিসম্পাত করবে।

দুই. মানুষের মত জিনদেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাই কুফরি বা পাপের জন্য তাদেরকেও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে।

তিন. অপরাধীরা পরকালে একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর কিংবা নিজের পাপের শরিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।