সূরা আ'রাফ;(১ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ;(১ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 3:54:41 4-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১-৫

পবিত্র কুরআনের সাত নম্বর সূরার নাম আ'রাফ। আ'রাফ হচ্ছে বেহেশত ও জাহান্নামের মতোই পরকালীন একটি স্থানের নাম। বেহেশত ও জাহান্নামের মতো আ'রাফেও এক দল মানুষ অবস্থান করবে। সূরা আরাফের ৪৬ ও ৪৮ নম্বর আয়াতে সেখানকার বাসিন্দাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে ২৯টি সূরা হুরুফুল মুকাত্তাআত বা বিচ্ছিন্ন হরফ দিয়ে শুরু হয়েছে। এর একটি হলো সূরা আ'রাফ। সূরা বাকারা নিয়ে আলোচনার সময়ও আমরা বলেছি, হুরুফুল মুকাত্তাআত বা বিচ্ছিন্ন হরফগুলো হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যকার এক রহস্য। হযরত ইমাম মাহদি (আ.) এর আবির্ভাবের পর ওই রহস্য উন্মোচিত হবে এবং এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে বলে আশা করা হয়।

তবে অনেক মুফাসসির মনে করেন, আল্লাহ এসব হরফের মাধ্যমে মানুষকে এটাই বোঝাতে চাচ্ছেন যে, তিনি আলিফ-বা'র মতো হরফ দিয়েই কুরআন লিখেছেন এবং এ জন্য তিনি কোন বিশেষ হরফ বা ভাষা ব্যবহার করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোন মানুষই কুরআনের আয়াতের মতো একটি আয়াতও লিখতে পারবে না। বাস্তবেও অনেক আরব কবি-সাহিত্যিক এ বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন।

সূরা আ'রাফের ১ ও ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

المص (1) كِتَابٌ أُنْزِلَ إِلَيْكَ فَلَا يَكُنْ فِي صَدْرِكَ حَرَجٌ مِنْهُ لِتُنْذِرَ بِهِ وَذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ (2(

"আলিফ, লাম, মীম, সোয়াদ।" (৭:১)

"এটি একটি গ্রন্থ, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে করে আপনি এর মাধ্যমে ভীতি-প্রদর্শন করেন। অতএব, এটি পৌছে দিতে আপনার মনে কোনরূপ সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়। আর এটিই বিশ্বাসীদের জন্যে উপদেশ।" (৭:২)

প্রথম আয়াতের হুরুফুল মুকাত্তায়াত সম্পর্কে আমরা এরইমধ্যে আলোচনা করেছি। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহতায়ালা রাসূল (সা.)কে উদ্দেশ্য করে বলছেন, এ মহাগ্রন্থ নিশ্চিতভাবেই আমার পক্ষ থেকে আপনার ওপর নাজিল হয়েছে। এতে যা কিছু আছে তার সবই সত্য। মুশরিক ও কাফিররা পবিত্র কুরআনকে গ্রহণ করেনি বলে আপনি আপনার মনে কুরআন সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ দেবেন না। আপনার দায়িত্ব হলো, কুরআনের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। সত্য মেনে নিতে মানুষকে বাধ্য করা আপনার দায়িত্বের অংশ নয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. ধর্ম প্রচার তথা মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বানের দায়িত্ব পালন করার জন্য ব্যাপক ধৈর্য শক্তি ও সহ্য ক্ষমতার প্রয়োজন।

২. নবী-রাসূলদের দায়িত্ব হলো, মানুষকে সতর্ক করা এবং সৎ পথে চলার উপদেশ দেয়া। ঈমান আনতে বাধ্য করা তাদের দায়িত্বের অংশ নয়।

সূরা আ'রাফের ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ

(হে মানবজাতি!) তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং নিজেদের প্রতিপালক ছাড়া অন্য কোন অভিভাবককে অনুসরণ করো না। কিন্তু তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করো। (৭:৩)

মানুষকে সতর্ক করাই যে নবী-রাসূলের দায়িত্ব, আগের আয়াতে সে কথা উল্লেখ করার পর এ আয়াতে মানুষকে কুরআন ও আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে মানুষকে পবিত্র কুরআনের পথ ছাড়া অন্য কোন পথ অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ আয়াতে এটা স্পষ্ট যে, ঐশি গ্রন্থ কুরআনকে অনুসরণের মধ্যেই মানুষের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহর পথই হচ্ছে সহজ ও সরল পথ। আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হলে মানুষ বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে পড়ে এবং চূড়ান্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।

এ আ'রাফের ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَكَمْ مِنْ قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا فَجَاءَهَا بَأْسُنَا بَيَاتًا أَوْ هُمْ قَائِلُونَ (4) فَمَا كَانَ دَعْوَاهُمْ إِذْ جَاءَهُمْ بَأْسُنَا إِلَّا أَنْ قَالُوا إِنَّا كُنَّا ظَالِمِينَ (5(

'কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আযাব অকস্মাত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলা অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল।' (৭:৪)

'আর যখন আমার আযাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এছাড়া আর কোন কথাই ছিল না যে, "সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম।' (৭:৫)

আগের আয়াতগুলোতে ঐশি ধর্ম মেনে চলার ওপর গুরুত্ব আরোপের পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, নবী-রাসূলরা মানুষকে সৎ পথে পরিচালনার জন্য ব্যাপক চেষ্টা ও শ্রম দেয়ার পরও খুব কম সংখ্যক মানুষই তাদের উপদেশ শুনেছে এবং সত্য পথকে বেছে নিয়েছে। আর এ কারণে মানব সমাজে অনাচার-অবিচার ও অনৈতিকতা ছড়িয়ে পড়েছে এবং কখনো কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দুনিয়াতেই তাদের ওপর শাস্তি নেমে এসেছে।

যদিও এটা ঠিক যে, মানুষ তার কাজের চূড়ান্ত শাস্তি ও পুরস্কার পাবে বিচার দিবসে। তবুও অন্যদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মতো কিছু পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে এ পৃথিবীতেও কখনো কখনো  আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে। এটা এমন এক শাস্তি, যা রাত-দিন মানে না। এমনকি ঘুমন্ত অবস্থাতেও মানুষের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসতে পারে।

এ পরিস্থিতিতে মানুষ বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজেদের অপরাধের কথা স্বীকার করে বলতে থাকে, 'আমরা জালিম ছিলাম এবং নিজেদের অপরাধের কারণেই আমরা এমন শাস্তি পাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের ওপর জুলুম করেননি বরং আমরাই নিজেদের ও অন্যদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছি। এ স্বীকারোক্তিতে তাদের কোনো লাভ না হলেও অন্যদের জন্য তা শিক্ষা ও উপদেশ হিসেবে কাজ করে।' ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন করার কারণে রোম ও ইরানের মতো বিশাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে এবং অন্যরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. কিয়ামতের আগে পৃথিবীতেও মানুষের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসতে পারে। পাপাচারে আচ্ছন্ন সমাজ ও জনপদকে আল্লাহ এ পৃথিবীতেও নানাভাবে শাস্তি দিয়ে থাকেন।

দুই. আল্লাহর শাস্তি নেমে আসার আগেই আমাদের উচিত, নিজেদের ভুল-ত্রুটি ও অপরাধ স্বীকার করে তওবা করা। এভাবেই আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।