সূরা আ'রাফ; (৩৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (৩৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 23:11:25 3-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৫৪-১৫৬

সূরা আরাফের ১৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

 وَلَمَّا سَكَتَ عَنْ مُوسَى الْغَضَبُ أَخَذَ الْأَلْوَاحَ وَفِي نُسْخَتِهَا هُدًى وَرَحْمَةٌ لِلَّذِينَ هُمْ لِرَبِّهِمْ يَرْهَبُونَ

"যখন মূসার ক্রোধ প্রশমিত হলো, তখন তিনি তাওরাতের ফলকগুলো তুলে নেন। তাওরাতের লেখাগুলো তাদের জন্যে যাঁরা তাঁদের প্রতিপালককে ভয় পায়। তাওরাত ছিল তাঁদের জন্যে দয়া ও পথ-নির্দেশ।" (৭:১৫৪)

আগের আয়াতগুলোর আলোচনায় আমরা জেনেছি, হযরত মূসা (আ.) তুর পাহাড় থেকে ফেরার পর তাঁর জাতিকে বাছুর পূজার মধ্যে দেখতে পেয়ে খুবই  রেগে যান এবং ক্ষুব্ধ চিত্তে তাওরাতের তাওরাতের ফলকগুলো এক কোনায় ফেলে দেন । এরপর তিনি নিজ জাতিকে তিরস্কার করতে থাকেন।

এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, হযরত মূসা (আ.) যখন শান্ত হলেন, তখন তিনি তাওরাত গ্রন্থের ফলকগুলো তুলে নিয়ে সেগুলো নিজ জাতির কাছে আনলেন । তিনি তাদেরকে তাওরাতের বিধান ও জ্ঞান শিক্ষা দিতে চাইলেন । কারণ, অন্য সব খোদায়ী গ্রন্থের মতো তাওরাতও ছিলো মানুষের জন্যে ঐশী পথ নির্দেশ ও দয়ার মাধ্যম । অবশ্য যারা আল্লাহয় বিশ্বাসী শুধু তারাই এ ধরনের খোদায়ী পথ নির্দেশ ও দয়া পেয়ে থাকেন এবং তারা মহান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতে ভয় পান ।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

মানুষ আল্লাহকে ভয় করলে তাঁর জন্যে আল্লাহর রহমতের দরজাগুলো প্রসারিত হয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই এমন যোগ্যতার অধিকারী নন যে মানুষ তাঁকে ভয় করবে এবং তাঁর সামনে বিনম্র বা বিনয়াবনত হবে।

সূরা আরাফের ১৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

  وَاخْتَارَ مُوسَى قَوْمَهُ سَبْعِينَ رَجُلًا لِمِيقَاتِنَا فَلَمَّا أَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ قَالَ رَبِّ لَوْ شِئْتَ أَهْلَكْتَهُمْ مِنْ قَبْلُ وَإِيَّايَ أَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ السُّفَهَاءُ مِنَّا إِنْ هِيَ إِلَّا فِتْنَتُكَ تُضِلُّ بِهَا مَنْ تَشَاءُ وَتَهْدِي مَنْ تَشَاءُ أَنْتَ وَلِيُّنَا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الْغَافِرِينَ

"মূসা আমার নির্দেশ অনুযায়ী তুর পাহাড়ে অবস্থান করতে নিজ জাতি হতে ৭০ জনকে মনোনীত করেছিল ; তারা (আল্লাহকে দেখার আবেদন জানিয়ে) যখন ভূমিকম্পের মাধ্যমে আক্রান্ত হলো, তখন মূসা বললেনঃ হে প্রতিপালক  আপনি চাইলে তুর পাহাড়ে আসার আগেই আমাদের সবাইকে ধ্বংস করতে পারতেন এবং আমাদের মধ্যে যারা নির্বোধ, তারা যা করছে সে জন্যেই কি আপনি আমাদের ধ্বংস করছেন? এতো আপনারই পরীক্ষা মাত্র! আপনি এ দিয়ে যাকে ইচ্ছে বিপথগামী করেন এবং যাকে ইচ্ছা (ও যোগ্য মনে করেন) তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন । আপনিই তো আমাদের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক। তাই, আপনি আমাদের ক্ষমা করুন এবং দয়া করুন। আপনিই তো শ্রেষ্ঠ মার্জনাকারী।" (৭:১৫৫)

হযরত মূসা (আ.) বনি ইসরাইলের লোকদের অনেক অলৌকিক নিদর্শন দেখিয়েছিলেন। তারপরও বনী ইসরাইলের বেশিরভাগ লোক আল্লাহকে নিজ চোখে দেখার অথবা তাঁর কথা শোনার আব্দার করে । তাই, মূসা (আ.) তাদের মধ্য থেকে ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে মনোনীত করেন যাতে তারা এর আগের ঘটনার মতো তুর পাহাড়ে আল্লাহর নূরের তাজাল্লি বা বিচ্ছুরণ দেখতে পায় এবং আল্লাহর কথা শুনতে পায়।  এ পর্যায়ে বনী ইসরাইলের লোকেরা আল্লাহর কথা শুনতে  পায় । কিন্তু তারা মূসা (আ.)কে বললেনঃ আল্লাহকে বলুন তিনি যেন আমাদেরকে দেখা দেন বা আমাদের দৃষ্টিপটে আবির্ভূত হন । এ সময় তুর পাহাড়ে প্রবল কম্পন শুরু হয় এবং তারা সবাই ভয়ে মারা গেল। হযরত মূসা (আ.)’র জন্যেও বিষয়টি খুবই কঠিন হয়ে পড়লো। তিনি ভাবতে লাগলেন ৭০ ব্যক্তির মৃত্যুর পর কিভাবে জাতির কাছে মুখ দেখাবেন! এ অবস্থায় মহান আল্লাহর কূদরতে তারা পূনরায় জীবিত হয় এবং তারা নিজ জাতির কাছে ফিরে যায়।

ইহুদিরা আল্লাহকে দেখতে চাওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছিল। অন্যান্য খোদায়ী ঘটনার মতো এ ঘটনাও ছিল এক ধরনের খোদায়ী পরীক্ষা এবং এ ধরনের পরীক্ষা কারো জন্যে হেদায়াত বা সুপথ ও কারো জন্যে পথভ্রষ্টতার মাধ্যম।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

এক.  মহান আল্লাহর নবী-রাসূলগণ মানুষের বাহ্যিক দিক ও কাজ দেখে সেসবের ভিত্তিতে তাদের সাথে আচরণ করতেন, অদৃশ্য জ্ঞানের ভিত্তিতে নয় । তাই হযরত মূসা (আ.) যাদেরকে নিজের সাথে তুর পাহাড়ে নেয়ার জন্যে মনোনীত করেছিলেন, তাদেরকে বাহ্যিকভাবে ভালো মানুষ মনে হলেও তারা ছিল মূর্খ ও অযোগ্য লোক ।

দুই. দুর্যোগ ও তিক্ত ঘটনাগুলো মহান আল্লাহর পরীক্ষার মাধ্যম যাতে বোঝা যায় কারা প্রকৃত ঈমানদার ও কারা তা নয়।

সূরা আরাফের ১৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَاكْتُبْ لَنَا فِي هَذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآَخِرَةِ إِنَّا هُدْنَا إِلَيْكَ قَالَ عَذَابِي أُصِيبُ بِهِ مَنْ أَشَاءُ وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُمْ بِآَيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ

"হে প্রতিপালক! আপনি আমাদের জন্যে ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ নির্ধারণ করুন। নিশ্চয়ই আমরা আপনার দিকে ফিরে এসেছি। আল্লাহ বললেনঃ আমার শাস্তি যাকে ইচ্ছে দিয়ে থাকি। আর আমার দয়া তো প্রত্যেক বস্তুতেই ব্যাপ্ত। যারা খোদাভীরু বা মোত্তাকী, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনগুলো বিশ্বাস করে, তাদের জন্যে অচিরেই  আমি আমার দয়া নির্ধারণ করবো।" (৭:১৫৬)

এ আয়াতে কারিমা আগের আয়াতেরই ধারাবাহিকতার অংশ।  এতে মহান আল্লাহর কাছে হযরত মূসা (আ.)’র দোয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি আল্লাহর কাছে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ চাইছিলেন। আল্লাহ এর জবাবে পাপী ও অজুহাতকামী লোকদের ক্ষমা করে দেয়ার জন্যে বলেনঃ আমার রহমত বা দয়া এতো ব্যাপক ও বিস্তৃত যে তা সব কিছুতেই ব্যাপৃত। তবে তা পাওয়ার শর্ত হলো, মুমিন বা ঈমানদার হওয়া, খোদাভীরু বা মোত্তাকী হওয়া ও বঞ্চিতদের সাহায্য করা । যারা এসব গূণাবলী অর্জন করবে না তারা আমার রহমত হতে বঞ্চিত হবে এবং আমার শাস্তি ভোগ করবে ।

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, যখন এ আয়াত নাজেল হয়, তখন শয়তানও প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে এ আশায় যে সেও আল্লাহর রহমত  থেকে বঞ্চিত হবে না । কারণ, আল্লাহ বলেছেন, আমার রহমত সব কিছুতেই ছড়িয়ে আছে। অথচ এ ব্যাপক- বিস্তৃত রহমত পাবার জন্যে ঈমান, খোদীভীরুতা ও বঞ্চিতদের দিকে দৃষ্টি দেয়ার শর্ত জরুরী, আর এসব গুণাবলী শয়তান ও তার অনুসারীদের মধ্যে নেই ।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকারঃ

এক.  নবীগণের দোয়া আদর্শ দোয়া । তাঁরা দোয়া করার সময় ইহকালীন কল্যাণের জন্যে দোয়ার পাশাপাশি পরকালীন কল্যাণের জন্যেও দোয়া করতেন । তাই, তাদের মতো আমাদেরও উচিত, ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের কল্যাণের জন্যেই দোয়া করা । একটির জন্যে অন্যটিকে বিসর্জন দেয়া ঠিক হবে না ।

দুই. আল্লাহর দয়া তাঁর ক্রোধের ওপর প্রাধান্য পেয়েছে। তাই পাপীরাও ক্ষমা চাইলে ও তওবা করলে আজাব বা শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে এবং আল্লাহর দয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।