সূরা আত তাওবা; আয়াত ৩১-৩৫
সূরা আত তাওবার ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
“তারা তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে এবং মরিয়ম পুত্র ঈসাকেও তাদের প্রতিপালকরূপে স্থির করেছে, অথচ তাদেরকে শুধু এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলা হয়েছিল। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য বা মাবুদ নেই। তারা আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করে, অথচ তিনি শরিক থেকে পবিত্র।” (৯:৩১)
খ্রিস্টান বা হযরত ঈসা (আ.)’র কথিত অনুসরারীরা তাঁকে আল্লাহর পুত্র বলে মনে করে । অথচ হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন মরিয়মের পুত্র। হযরত ঈসা (আ.)কে ‘আল্লাহর পুত্র’ বা আল্লাহ বলে মনে করার মতো নির্বুদ্ধিতা পোষণ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। এই শ্রেণীর মানুষ একদল পন্ডিত ও দুনিয়াত্যাগী লোককেও আল্লাহর মর্যাদা দিয়েছে। এর প্রমাণ হলো তারা ঐসব সন্ন্যাসীর আদেশ নির্দেশ পালনকে আল্লাহর আদেশ নির্দেশ পালনের মতোই অবশ্য-পালনীয় কর্তব্য বলে মনে করে। অথচ আল্লাহ ও তাঁর নবীর নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ মান্য করা জরুরি নয়। অবশ্য দরবেশ বা সন্যাসীদের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধার মত বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থা শুধু খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই সীমিত থাকেনি। মুসলিম ধর্মীয় নেতারাও অতীতে এই মারাত্মক বিপদ সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক করেছেন। কারণ, আউলিয়ারা যত সম্মানের অধিকারীই হোন না কেন তাঁরাও মানুষ ও কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর সমকক্ষ নন, বরং আল্লাহর দাস বা বান্দা মাত্র।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:
এক. কোনো ব্যক্তিকেই মাবুদ বা উপাস্যের সম্মান দেয়া যায় না, কারণ ব্যক্তিপূজা হলো শিরক এবং কুফরির নামান্তর।
দুই. একমাত্র মহান আল্লাহই বিধান বা নির্দেশ দেয়ার অধিকার রাখেন। যারাই আল্লাহর বিধানের খেলাপ বা বিরোধী কোনো বিধানের অনুসরণ করবে তারা হবে মুশরিক বা অংশিবাদী।
সূরা তাওবার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
“তারা ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়,অথচ আল্লাহ তাঁর নূর বা জ্যোতিকে পরিপূর্ণ করবেন যদিও কাফেরদের কাছে তা পছন্দনীয় নয়।” (৯:৩২)
যুগে যুগে জালিম শাসক ও রাজা-বাদশাহরাসহ অনেকেই ন্যায় বিচার বা সত্যকে মেনে নিতে পারেনি। বরং তারা ন্যায় বিচার প্রতিরোধের জন্যে ধর্মীয় মহাপুরুষ ও তাঁদের আদর্শ নির্মূলের লক্ষ্যে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেছে এবং অত্যাচার ও বল প্রয়োগের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু নবী-রাসূলগণের নাম ও তাঁদের আদর্শ জীবন্ত রয়েছে এবং মানুষ আজও তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। অন্যদিকে জালিমদের সেইসব প্রতাপ ও শক্তিমত্তার কিছুই অবশিষ্ট নেই এবং মানুষ তাদের স্মরণ করলেও ঘৃণাভরে স্মরণ করে।
এই আয়াতে মহান আল্লাহর এই রীতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে বলা হয়েছে, কেউ কেউ আল্লাহর নূর তথা তাঁর স্মরণ ও নামকে মিথ্যা প্রচারের স্রোতে মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলতে চায়। তারা মনে করে যে ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে ফেলা সম্ভব, অথচ সূর্যের আলোর মতোই মহান আল্লাহর নূর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ
এক. ইসলামকে নির্মূলের জন্যে ইসলামের শত্রুরা মিথ্যা প্রচার ও প্রোপাগান্ডার ওপরই সবচেয়ে বেশী জোর দিয়েছে, তাই তাদের কোনো কথায় প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়।
দুই. ইসলামের শত্রুদের এটা বোঝা উচিত আল্লাহর ইচ্ছার বাস্তবায়ন অনিবার্য এবং মিথ্যার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের যে কোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
সূরা তাওবার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
“আল্লাহ নিজ রাসূলকে সুপথ ও সত্যধর্মসহ পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ ধর্মকে অন্য সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও তা অবিশ্বাসীদের কাছে অপছন্দনীয়।” (৯:৩৩)
সত্য ধর্ম ইসলামের শত্রুরা এই ধর্মকে নির্মূলের বৃথা চেষ্টা করছে -আগের আয়াতের এ সম্পর্কিত আলোচনার পর এ আয়াতে বলা হয়েছে, শত্রুদের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সত্য ধর্ম ইসলাম পরাজিত তো হবেই না বরং এ ধর্ম সমস্ত ধর্মের ওপর বিজয়ী হবে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ ইসলাম ধর্ম সুপথ বা খোদায়ী হেদায়াত ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ ( সা.)’র বংশধর হযরত ইমাম মাহদী (আ.)’র মাধ্যমে বিশ্বময় একটি বিপ্লব অনুষ্ঠিত হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে সে বিপ্লবের ভিত্তি। ইমাম মাহদী (আ.)- আল্লাহ তাঁর আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করুন-সব মানুষকে ইসলাম ধর্মের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ করে দিবেন এবং সে সময় প্রতিটি দেশ বা সমাজে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়বে।
এ আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:
এক. খোদায়ী ধর্মগুলোর ভিত্তি হলো সত্য ও ন্যায় বিচার এবং আদিতে প্রতিটি খোদায়ী ধর্ম সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে পরবর্তীকালে কোনো কোনো খোদায়ী ধর্ম সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।
দুই. আমাদের চলার পথকে আল্লাহর ইচ্ছের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে, তা না হলে ধ্বংস অনিবার্য।
সূরা তাওবার ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّ كَثِيرًا مِنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ (34) يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ
“হে বিশ্বাসীগণ, নিশ্চয়ই পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের অনেকেই মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে ও তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। তারা গোপনে সোনা ও রুপা সঞ্চিত করে এবং আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না। তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (৯:৩৪)
“সেদিন জাহান্নামের আগুনে এটি উত্তপ্ত করা হবে এবং এর দ্বারা তাদের কপাল, পাঁজর ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। সে সময় আযাবের ফেরেশতাগণ তাদের বলবেন, এটাই সেটা যা তোমরা নিজের জন্যে সঞ্চয় করেছিলে, সুতরাং গরীবদের না দিয়ে যা তোমরা সঞ্চয় করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর।” (৯:৩৫)
খ্রিস্টান ও ইহুদিরা তাদের পণ্ডিতদের এমন নিঃশর্ত ও অন্ধ আনুগত্য করতো যে সে রকম আনুগত্য শুধু আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারেই করা উচিত। এ আয়াতে ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের ঐসব পণ্ডিত ও সন্যাসী সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদের অনেকেই দুর্নীতি ও পাপে জড়িত। মানুষ গভীর বিশ্বাস করে তাদের কাছে যে অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখে তা তারা অন্যায়ভাবে গ্রাস করে। এ ধরনের পণ্ডিত ও সন্ন্যাসী আল্লাহর ধর্ম ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তা তো করেই না বরং তারা অপছন্দনীয় ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহর ধর্মের বিস্তৃতি ঠেকানোর চেষ্টা করে।
আয়াতের পরবর্তী অংশে ধন-সম্পদ গচ্ছিত রাখার ব্যাপারে বলা হয়েছে, কেউ কেউ অপ্রয়োজনীয় সম্পদ গচ্ছিত রাখতে অভ্যস্ত এবং নিজের জন্যে দরকারি না হওয়া সত্ত্বেও ঐ সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে বা গরীবদের কিছু দান করে না। শেষ বিচারের দিন তাদের ঐসব সোনা ও রুপা উত্তপ্ত করে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে দাগানো হবে যাতে বঞ্চিত ও দরিদ্রদের ব্যথা বেদনা বা ক্ষোভ তারা উপলব্ধি করতে পারে।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ
এক. ধর্মীয় নেতা ও পণ্ডিতদের উচিত আর্থিক অনিয়ম বা দুর্নীতিকে ভয় করা। কারণ, মানুষ তাদেরকে সৎ মনে করে তাদের কাছে অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখে।
দুই. যে সমাজে গরীব ও অভাবগ্রস্ত মানুষ রয়েছে সে সমাজে সোনা রুপা মজুত করা বৈধ নয়। এমনকি এ ধরনের সমাজে সঞ্চিত সোনা ও রুপা থেকে যাকাত দেয়া হলেও তা সঞ্চিত রাখা বৈধ নয়।
তিন. মানুষের ইহকালীন কাজ ও আচরণের সাথে পরকালীন শাস্তির মিল থাকবে। যেমন- সোনা ও রুপা সঞ্চয়কারীদের শরীর সেসব দিয়েই দগ্ধ করা হবে।