সূরা আল আনফাল; আয়াত ৬৫-৬৯
সূরা আনফালের ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَفْقَهُونَ
“হে নবী! ঈমানদার বিশ্বাসীদেরকে সংগ্রামের জন্য উদ্বৃদ্ধ কর। তোমাদের মধ্যে কুড়িজন ধৈর্য্যশীল থাকলে তারা দুইশ’ জনের ওপর বিজয়ী হবে এবং তাদের মধ্যে একশ’ জন থাকলে এক সহস্র অবিশ্বাসীর ওপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যার বোধশক্তি নেই।" (৮:৬৫)
এর আগের আয়াতে রাসূলে খোদা এবং তার অনুসারীদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, কাফের মুশরিকরা যদি শত্রুতা ও সহিংসতার পথ পরিত্যাগ করে শান্তি স্থাপনে আগ্রহী হয় এবং এ ব্যাপারে কোনো প্রস্তাব পাঠায় তাহলে তোমরা তাদের শান্তি প্রস্তাবে সাড়া দেবে। আর এর পরিণতির ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করবে না। কারণ, মহান আল্লাহ তোমাদেরকেই সাহায্য করবেন।
৬৫ নম্বর এই আয়াতে আল্লাহ'তালা তার রাসূলকে বলেছেন, ইসলামের শত্রুরা যদি শান্তি না চায়, তারা যদি শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে তাহলে তুমি কাফেরদের বিরুদ্ধে মুমিন মুসলমানদেরকে জিহাদের জন্য প্রস্তুত কর এবং তাদেরকে বলে দাও সংখ্যায় কম হওয়ার জন্য কিংবা অনুন্নত যুদ্ধাস্ত্রের জন্য মুসলমানরা যেন ভয় না পায়। কারণ এখানে সৃষ্টিকর্তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তিনি সত্যের সৈনিকদেরকে এ ব্যাপারে অভয় দিয়ে বলেছেন, মুমিনরা যদি অসত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে রুখে দাঁড়ায় তাহলে একজন মুমিন মুসলমানের মুকাবেলায় দশজন কাফেরও টিকতে পারবে না। আর এই শক্তি আসবে ঈমানের আলো থেকে। যেটা ইসলামের শত্রুদের নেই। এমনকি তারা এ জিনিসটি অনুধাবন করতেও অক্ষম।
ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে অবশ্য এই পবিত্র আয়াতের অনেক বাস্তব দৃষ্টান্ত চোখে পড়বে। দেখা গেছে, যখনই মুসলমানরা অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে খাঁটি নিয়তে রুখে দাঁড়িয়েছে সেখানেই তাদের নজিরবিহীন বিজয় অর্জিত হয়েছে। লোকবল এবং যুদ্ধ সরঞ্জামের দিক দিয়ে মুসলমানরা অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও পরাক্রমশালী শত্রু পক্ষকে তারা নাস্তানাবুদ করেছে। বদরের যুদ্ধে এক হাজার শত্রু সেনার বিপরীতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, ওহুদ যুদ্ধে ৩০০০ এর বিপরীতে মুসলমানরা ছিলেন মাত্র ৭০০ জন, খন্দক যুদ্ধে দশ হাজার কাফেরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন মাত্র ৩০০০ মুসলমান আর তাবুক যুদ্ধে এক লক্ষ শত্রু সেনার বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে লড়াই করেছেন মাত্র দশ হাজার ঈমানদার মুসলিম। কাজেই এ আয়াতে এটাই বুঝানো হয়েছে, সত্য ও মিথ্যার যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত হয় ঈমান ও দৃঢ়তার বলে, এখানে উন্নত যুদ্ধাস্ত্র বা লোকবল মুখ্য নয়।
এই সূরার ৬৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
الْآَنَ خَفَّفَ اللَّهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ أَلْفٌ يَغْلِبُوا أَلْفَيْنِ بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ
"আল্লাহ এখন তোমাদের ভার লাঘব করলেন। তিনি অবগত আছেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে একশ' জন ধৈর্য্যশীল থাকলে তারা দুইশ' জনের ওপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের মধ্যে এক সহস্র থাকলে আল্লাহর ইচ্ছায় তারা দুই সহস্রের ওপর বিজয়ী হবে। আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথেই রয়েছেন।" (৮:৬৬)
আগের আয়াতের ভিত্তিতে মুসলমানদের লোকবল যদি কাফেরদের দশভাগের একভাগও হয় তারপরও তাদের ওপর জিহাদের দায়িত্ব বর্তায়। অর্থাত, কাফের বা শত্রুপক্ষ যদি মুসলিম বাহিনীর দশগুণও হয় তাহলে প্রতি একজন মুসলমান দশজন শত্রুর বিপরীতে যুদ্ধের জন্য ময়দানে অবতীর্ণ হতে হবে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেখা গেল মুসলমানরা এক সময় ঈমান ও মনোবলের দিক থেকে আগের তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ফলে মহান আল্লাহ তাদের দায়িত্ব অনেকটা লাঘব করলেন এবং তিনি নির্দেশ দিলেন, প্রতি একজন মুসলমান দুইজন কাফেরের বিপরীতে যুদ্ধ করবে। এই আয়াত থেকে এটাই বুঝা যায় ইসলামী রাষ্ট্রে দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো সংকটের সময় মানুষের ওপর যাতে কোনো বাড়তি চাপ না থাকে সে জন্য কোনো কোনো আইন শিথিল করা যেতে পারে।
এই সূরার ৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُونَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآَخِرَةَ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
"দেশের মাটিতে শত্রুকে সম্পূর্ণ পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোনো নবীর জন্য সংগত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ এবং আল্লাহ চান পরলোকের কল্যাণ। আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (৮:৬৭)
আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই পবিত্র আয়াতে মুসলমানদেরকে যুদ্ধের ব্যাপারে কিছু নিয়ম-নীতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই আয়াতে বলা হয়েছে, মুসলমানরা শুধু আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য মিথ্যার উপর সত্যের বিজয় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করবে। গণিমতের মাল বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ জমা করা বা প্রতিপক্ষকে বন্দী করার চেষ্টায় যেন মুসলিম সৈনিকরা মেতে না উঠে, কারণ এসব হচ্ছে পার্থিব সম্পদ যা পরকালের সম্পদের চেয়ে অত্যন্ত নগন্য। কাজেই মুসলিম সেনারা চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে বন্দী করতে পারবে না। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাদেরকে জেহাদ চালিয়ে যেতে হবে। এই আয়াত থেকে বোঝা যায় জেহাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বিধান কায়েম করা বস্তুগত বা পার্থিব কোনো স্বার্থ হাসিল নয়।
এই সূরার ৬৮ ও ৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
لَوْلَا كِتَابٌ مِنَ اللَّهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (68) فَكُلُوا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلَالًا طَيِّبًا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
"আল্লাহর পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ তার জন্য তোমাদের ওপর মহাশাস্তি নেমে আসতো।” (৮:৬৮)
“যুদ্ধে তোমরা গণিমত হিসেবে যা লাভ করেছ তা বৈধ ও উত্তম হওয়ার কারণে তা ভোগ কর ও আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।" (৮:৬৯)
এই আয়াতেও মহান আল্লাহ জিহাদের মূল উদ্দেশ্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। এতে বলা হচ্ছে, কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়ার আগেই যদি কেউ ভুল করে ফেলে তার জন্য আল্লাহ কাউকে শাস্তি দেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই বিধান না থাকলে যুদ্ধ চলাকালে বন্দী গ্রহণের অপরাধে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর শাস্তি নেমে আসতো। এছাড়া আল্লাহ চেয়েছিলেন বদর যুদ্ধে তোমাদের বিজয় দান করবেন। তা না হলে তোমরা যুদ্ধ চলাবস্থায় বন্দী করে যে ভুল করেছো তার জন্য ঐশি শাস্তি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়তো। এর পরের অংশে বলা হচ্ছে, গণিমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ যা তোমাদের হস্তগত হয়েছে তার এক পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রের তহবিলে জমা দেয়ার পর তা তোমাদের জন্য ধৈর্য্য এবং উত্তম। ফলে তোমরা তা ভোগ করতে পারবে। তবে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করবে। তাহলে আল্লাহও তোমাদের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিবেন।